অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেত্রী প্রিয়া সাহা গত বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে গিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে তথা ইসলামী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর ও জমিদখলের অভিযোগ করেছেন। প্রিয়া সাহার অভিযোগ-ইসলামী মৌলবাদীরা দেশ থেকে ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দুকে বের করে দিয়েছে। তাদের জায়গা জমি দখল করে নিয়েছে। ভিডিওতে দেখা গেছে, তার অভিযোগ শুনে প্রেসিডেন্ট খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছেন। আর এমন অভিযোগ শুনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্ষুব্ধ হওয়ারই কথা।
প্রিয়া সাহার এই বক্তব্যের ভিডিও প্রকাশের পরই এনিয়ে সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়ে গেছে। নড়েচড়ে বসেছে সরকারও। একথায় সবাই প্রিয়া সাহার দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তি দাবি করছে। রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুই দিন ধরে শুধু প্রিয়া সাহাকে নিয়ে চলছে আলোচনা সমালোচনা। প্রিয়া সাহা এই দুঃসাহস কোথায় থেকে পেল এমন প্রশ্নই ঘুরেফিরে তুলছেন সকল শ্রেণি পেশার মানুষ।
এদিকে, সরকারের মন্ত্রীরাও প্রিয়া সাহার এই অভিযোগকে দেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র বলে মনে করছেন। প্রিয়ার বক্তব্যকে দেশদ্রোহী বলেও মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আর অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারলে প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়ে দেশের বিরুদ্ধে তথা মুসলিম সম্প্রদায়ের অভিযোগ করে প্রিয়া সাহা যে গর্হিত অপরাধ করেছেন তাতে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। তার এই বক্তব্যে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। এমনকি এটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তথা এদেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্রও বটে।
এখন প্রশ্ন হলো-প্রিয়া সাহা মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়ে দেশের বিরুদ্ধে এমন মিথ্যা অপপ্রচার করার সাহসটা কোথায় পেল? বিদেশে গিয়ে দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার কি শুধু প্রিয়া সাহাই করেছেন নাকি আগেও এমন হয়েছে? বিগত দিনের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, এমন অপপ্রচারের সঙ্গে এক সময় শেখ হাসিনা এবং তার দলের নেতারাও জড়িত ছিলেন।
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে দুটি এজেন্ডা নিয়েই মাঠ গরম করতে দেখা যায়। তারা সরকারে থাকলে বিরোধী দলকে আর বিরোধী দলে থাকলে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে একটি বিষয়ে বেশি প্রচারণা চালিয়ে থাকে। এটি হলো হলো সংখ্যালঘু নির্যাতন। দলটি অতিমাত্রায় ভারতঘেঁষা হওয়ার কারণে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনও তাদের একটু বেশি ভালবাসে। আর এ সুযোগটাকেই আওয়ামী লীগ কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। তারা নিজেরাই সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ও আগুন দিয়ে মন্দির, প্যাগোডা ও গির্জা পুড়িয়ে দিয়ে পরে বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা চালায়। বাংলাদেশের কিছু কিছু জায়গায় বিভিন্ন সময়ে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা-ভাংচুর ও আগুন দেয়ার যে ঘটনা ঘটেছে তদন্তের পর দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের লোকেরাই জড়িত ছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে গিয়ে তাদের জন্য হিতে-বিপরীত হয়েছে।
বিশেষ করে ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক ভরাডুবির পর বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোট সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ইস্যু নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন শেখ হাসিনা। ঢাকায় অবস্থিত বিদেশি দূতাবাসগুলোতেই শুধু অভিযোগ দেননি। বিদেশে গিয়েই শেখ হাসিনা অভিযোগ করেছেন যে, বাংলাদেশ এখন তালেবানি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে খালেদা জিয়া দেশকে আফগানিস্তান বানানোর চেষ্টা করছে। বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর চালাচ্ছে। তাদের জমি দখল করে নিচ্ছে। তারা এখন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এসব প্রচারের কাজে শেখ হাসিনা তখন আওয়ামী পন্থী বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত শাহরিয়ার কবিরসহ অন্যদেরকেও ব্যবহার করেছেন।
আর সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় ছিল-বিদেশিদের কাছে করা এসব অভিযোগ প্রমাণ করতে শেখ হাসিনা তার সোনার ছেলে ছাত্রলীগ-যুবলীগ দিয়ে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর করিয়েছে। নারীদের ওপর নির্যাতন করিয়েছে। আগুন দিয়ে হিন্দুতের বাড়িঘর পুড়ে এগুলোর ফুটেজ ও ছবি বিদেশিদের হাতে দিয়েছে।
এখানে পাঠকদের জন্য সেই সময়কার অল্প কিছু ঘটনা তুলে ধরছি- ১৪ অক্টোবর ২০০১ তারিখে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বিষ্ণপুর গ্রামের নিশিপাড়ায় কালিমন্দির ভাঙ্গা হয়। আওয়ামী লীগের লোকজন এর দায় চাপায় বিএনপি-জামায়াতের ওপর। পরে পুলিশ রিপোর্টে বেরিয়ে আসে আসল তথ্য। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরাই এর সাথে জড়িত ছিল। এ রিপোর্ট প্রকাশের পর পুরো এলাকায় হৈচৈ পড়ে যায়। গা-ঢাকা দেয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা। আবার অনেকে আপস করার জন্য ধরনা দেয় পুলিশের কাছে।
৮ অক্টোবর ২০০১ তারিখে খুলনার পাইকগাছা থানার কাশিমনগর গ্রামের আলোপাড়া পূজামণ্ডপ ভাংচুরের কারণে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ৪ নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়।
১২ অক্টোবর ২০০১ তারিখে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে হিন্দু-বদ্ধ-খৃস্টান ঐক্যপরিষদের উদ্যোগে মাইনোরিটিস সংখ্যালঘু নির্যাতন: কারণ ও প্রতিকার শীর্ষক এক সেমিনারে সংখ্যালঘু নেতারাই অভিযোগ করেছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। এরা সংখ্যালঘুদের উস্কানি দিয়ে তাদের বিপাকে ফেলে তা থেকে ফায়দা লুটতে চান।
আর সংখ্যালঘু নির্যাতনের কল্পিত কাহিনী তৈরির মূলহোতা ছিল ঘাদানিক নেতা শাহরিয়ার কবির। শাহরিয়ার কবির ১১ নবেম্বর ২০০১ তারিখে ভারতে গিয়ে কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের নামে হিন্দুদের দিয়ে প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল এগুলোকে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দেয়া। ২৪ নভেম্বর ২০০১ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিমানবন্দরে আপত্তিকর ক্যাসেটসহ শাহরিয়ার কবির আটক হয়। শাহরিয়ার কবিরের কাছ থেকে জব্ধ করা ক্যাসেটের দৃশ্য দেখে গোয়েন্দারাও হতবাক হয়ে পড়েছিল। তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের পর বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। এর পরই মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যায় আওয়ামী লীগের। কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ধোঁয়া তুলে জোট সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে আওয়ামী লীগ যে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করেছিল তা ফাঁস হয়ে পড়ে।
এছাড়া সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় ছিল-বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের দলীয় অফিসে লঙ্গরখানা খুলে সারা দেশের সংখ্যালঘুদের এখানে এসে আশ্রয় নেয়ার আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। তাদের এই লঙ্গরখানায় যারা আশ্রয় নিয়েছিল তারা কেউ নির্যাতিত ছিল না। বস্তির বাসিন্দা, ফুটপাত ও পার্কে অবস্থানকারীরা খাওয়ার জন্য তাদের এই কথিত লঙ্গরখানায় আশ্রয় নিয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো আওয়ামী লীগের এই লঙ্গরখানায় অবস্থানকারীদের অর্ধেকই ছিল মুসলমান ভিক্ষুক। ঢাকার বাইরে থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নির্যাতিত কোন লোক না আসায় অবস্থা বেগতিক দেখে এক পর্যায়ে তারা লঙ্গরখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে অভিযোগ তারা তুলছিল তা ছিল সম্পুর্ণ মিথ্যা।
এসব ঘটনা থেকে নিশ্চয় প্রমাণিত হয় যে, বিদেশ গিয়ে দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের সূচনা মূলত করেছিলেন শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতারা। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মূলত শেখ হাসিনাই শুরু করেছিলেন। এদেশের ইসলামী দলগুলোকে নির্মূল করার জন্য তাদেরকে সন্ত্রাসী ও জঙ্গি হিসেবে প্রমাণ করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে যত লবিং করার দরকার ছিল শেখ হাসিনা ও তার ছেলে জয় সবই করেছেন। এখন প্রিয়া সাহা শুধু তাদের সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করছেন মাত্র।