সোহরাব হাসান
দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনে ফাঁকা কেন্দ্রের ছবি ছেপেছে প্রায় সব পত্রিকাই। কিন্তু ডেইলি স্টারের দ্বিতীয় পাতায় প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, পাবনার চাটমোহর উপজেলার অমৃত কুণ্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ভেতরে ভোট গ্রহণের দায়িত্ব নিয়োজিত ব্যক্তিরা অলস বসে আছেন। মাঠে কোনো ভোটার নেই, যদিও দড়ি দিয়ে যে ভোটারদের লাইন চিহ্নিত করা হয়েছিল, সেই দড়িগুলোও আছে। দুটি ফাঁকা টুলের পাশে একটি ছাগল দাঁড়িয়ে আছে। ছাগলটির গায়ের রং কালো। যে ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের আসার কথা, সেই ভোটকেন্দ্রে ছাগল এল কীভাবে? এখানে তার কী কাজ?
একই দিন প্রথম আলোর তৃতীয় পাতায় বগুড়ার পিটিআই ভোটকেন্দ্রের আরেকটি ছবি ছাপা হয়েছে—দুপুরবেলা যেখানে ভোটকেন্দ্রে কোনো ভোটার ছিলেন না। একজন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা টেবিলের ওপর মাথা রেখে অলস সময় কাটাচ্ছেন। তাঁর পাশের স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সটিও তখন বিশ্রাম নিচ্ছিল। ছবি মিথ্যা কথা বলে না।
যেসব প্রার্থী উপজেলায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের নির্বাচিত বলবেন না বাছাইকৃত বলবেন, তা নিয়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন। এর আগে তিনি বলেছিলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচনে জৌলুশ নেই। কেন জৌলুশ নেই? বিএনপিসহ অনেক বিরোধী দলই নির্বাচন বর্জন করেছে। যারা বর্জন করেনি, তাদের মধ্যে ছোট ছোট দলের অবস্থা যে কতটা শোচনীয়, তার পক্ষে কিছু তথ্য তুলে ধরেছেন রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে। তিনি জাতীয় সংসদের সাংসদ, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি এবং মহাজোট সরকারের সাবেক মন্ত্রী। মহাজোটের শরিক দলের প্রধান যখন বলেন, বাক্স্বাধীনতা ঝুঁকিতে আছে, তখন অন্যদের বাক্স্বাধীনতা কী অবস্থায় আছে, তা অনুমান করা কঠিন নয়।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা ইভিএমের মাধ্যমে রাতে ব্যালট পেপারে সিল মারার সংস্কৃতি বন্ধ করার ইঙ্গিত দিয়ে চুপ মেরে গেছেন। ভোট নিয়ে এখন আর কথা বলেন না। মানুষকে আর কত অসত্য বয়ান করা যায়? মানুষ দেখছে, ভোটকেন্দ্রের এক চেহারা, নির্বাচন কমিশন রাতে খবর দিচ্ছে অন্য রকম। তিনি আগে বলেছিলেন, বিরোধী দলকে নির্বাচনে আনার দায়িত্ব ইসির (নির্বাচন কমিশনের) নয়। এখন বলছেন, প্রধান বিরোধী দলের অংশ না নেওয়ায় উপজেলা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম। কিন্তু বিরোধী দল কেন নির্বাচনে আসেনি, তার ব্যাখ্যা নেই।
ডেইলি স্টারের ছবিতে যে কেন্দ্রে কোনো ভোটারের দেখা পাওয়া যায়নি, সেই কেন্দ্রের কর্মকর্তারা বেলা তিনটায় দাবি করেছেন, ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে। কারা ভোট দিলেন, কখন দিলেন—এই প্রশ্নের উত্তর কি নির্বাচন কমিশনের জানা আছে?
প্রথম আলোর প্রতিনিধি পাবনার বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে যে চিত্র তুলে ধরেছেন, তা-ও কৌতূহলোদ্দীপক। জেলার নয় উপজেলার মধ্যে আটটিতে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হয় গত সোমবার। অধিকাংশ উপজেলায় আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ‘বিদ্রোহী’রা। সকালে ভোট গ্রহণ শুরুর পর থেকে বিকেল পর্যন্ত জেলার সুজানগর, সাঁথিয়া, আটঘরিয়া, চাটমোহর, ভাঙ্গুরা ও ফরিদপুর উপজেলার বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে প্রায় একই চিত্র মিলেছে। অধিকাংশ কেন্দ্রেই ছিল শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। তবে ভোটার উপস্থিতি ছিল হাতে গোনা। দীর্ঘ সময় পরপর দু-চারজন করে ভোটার আসছিলেন, ভোট দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। এ কারণে ভোটারের কোনো সারি চোখে পড়েনি।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আটঘরিয়া উপজেলার দেবোত্তর পাইলট বালিকা বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ২০ থেকে ২৫ জন ভোটার দাঁড়িয়ে আছেন। তবে তাঁদের অধিকাংশই নারী। কর্তব্যরত প্রিসাইডিং কর্মকর্তা জানান, ওই কেন্দ্রের ৩ হাজার ৮৬১ ভোটারের মধ্যে তখন পর্যন্ত ৪২১ জন ভোট দিয়েছেন। বেলা একটার দিকে চাটমোহর উপজেলার ভাদরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে ভোটারের তেমন কোনো উপস্থিতি দেখা যায়নি। দায়িত্বরত প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম জানান, তখন পর্যন্ত তিনি ২৫ শতাংশ ভোট গ্রহণ করেছেন।
চাটমোহর ডিগ্রি কলেজ ভোটকেন্দ্রের সামনের একটি চায়ের দোকান। বেলা একটার দিকে ষাটোর্ধ্ব দুই প্রবীণ সেখানে বসে কথা বলছিলেন। ভোট কেমন হলো, জানতে চাইলে তাঁদের একজন বললেন, ‘এক দলের ফুটবল খেলা দেখতি যেমবা লোক হয় না, উপজেলার ভোটও হলো সেমবা।’ প্রথম আলোর তথ্য অনুযায়ী বগুড়ায় উপজেলা নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল অনেক কম।
কিন্তু অনিয়মের মাত্রা বেশি। সোমবার বগুড়া জেলার ১২ উপজেলায় নির্বাচন হয়। এর মধ্যে শেরপুর ও আদমদীঘি উপজেলায় পরিষদের চেয়ারম্যান পদে ভোটের প্রয়োজন হয়নি। উপজেলা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আলোকচিত্রীসহ প্রথম আলোর সাতজন সাংবাদিক আট উপজেলার ৬৩টি কেন্দ্র ঘুরে দেখেন। এ সময় বেশির ভাগ কেন্দ্রেই ভোটার উপস্থিতি কম দেখা যায়। শহর বা গ্রাম সব জায়গাতেই প্রার্থীর সমর্থক ছাড়া ভোটারদের উপস্থিতি তেমন ছিল না। তবে কিছু কিছু এলাকায় ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীদের তৎপরতায় ভোটারের উপস্থিতি তুলনামূলক ভালো ছিল।
দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটের দিকে সদর উপজেলার শেখেরকোলা এলাকায় ভান্ডারপাইকা শেখ মুজিব উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের দোতলায় ৭ নম্বর বুথে দেখা যায়, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার টেবিলে ব্যালটের তিনটি বইয়ের মধ্যে চেয়ারম্যানের কোনো ব্যালট নেই। ভাইস চেয়ারম্যানের দুটি ব্যালট বইয়ে সিল দেওয়া। জানতে চাইলে পোলিং কর্মকর্তা ও এজেন্টরা জানান, একদল তরুণ এসে জোর করে নৌকা প্রতীকে সিল মেরে বাক্সে ভরেছেন। সাংবাদিক আসার খবর পেয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে যাওয়ার কারণে ভাইস চেয়ারম্যানের সিল মারা ব্যালটগুলো বাক্সে ফেলতে পারেননি।
এ বিষয়ে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা রেজাউল করিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে থাকেন। এবারের উপজেলা নির্বাচনে এ রকম অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলবে না।
নির্বাচন কমিশন কী বলবে?
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক
সূত্র: প্রথম আলো