হাসান রূহী
প্রতিবাদের হরেক রকম ভাষা আছে। তবে ঠিক কত রকম তা নির্দিষ্ট করা কঠিন। তবে প্রতিবাদের সবচেয়ে দুর্বলতম ভাষা বা পদ্ধতিগুলোর অন্যতম কৌতুক তথা ব্যঙ্গ। হাস্য রসাত্মক কিংবা ব্যঙ্গাত্মক কথা বলে মূলত মনের অব্যক্ত কথাগুলো কৌশলে তুলে ধরে মানুষ। তবে এ চর্চা সেসব দেশেই দেখা যায় যেখানে মূলত সহজ কথা সহজ করে বলার সুযোগ খুবই কম থাকে। সমাজের সহজাত ও সাবলীল নিয়ম কানুন যখন রসাতলে যায় তখন রসে ভরা কৌতুক ফিস ফিসিয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এই কৌতুকগুলো কখনও নিখাদ আনন্দের, কখনও কঠিন জীবনের ব্যঙ্গাত্মক প্রকাশ, আবার কখনো বা রূপক ও মর্মান্তিক অর্থেও প্রচলিত হয়ে যায়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা রাশিয়ার কথাই ধরা যাক। সোভিয়েত রাশিয়ায় কৌতুক অনেকটা পল্লী গাঁথার মত। বলা হয়ে থাকে প্রচন্ড শীতের দেশ রাশিয়া। তাই শারীরিক ও মানসিক উষ্ণতা লাভের জন্য রাশিয়ানদের নিকট তিনটি জিনিস খুব প্রিয়। আর তা হলো- আড্ডা, ভদকা ও কৌতুক। তবে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা এতটাই খর্ব হয় যে, পেপার-পত্রিকা, গণমাধ্যম তো দূরের কথা ছাপার হরফের কোন সাহিত্যকর্মেও কৌতুক পাওয়া যেত না। খাবারের স্বল্পতা, খাবার যোগাড় করতে দিয়ে লম্বা লাইনে দাঁড়ানো, অর্থনৈতিক দুর্দশা এই সবকিছু নিয়ে তখন রাশিয়ানরা কৌতুক করতো। কৌতুক আর হাস্যরস যেন দুঃখ ভোলার মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। সমাজতান্ত্রিক প্রেসক্রিপশনের বাইরে যায় এমন কিছুই রাষ্ট্রীয় টিভি বা রেডিও প্রচার করতো না। কিন্তু এতকিছুর পরেও কৌতুক ছড়িয়ে ছিল পুরো সোভিয়েত রাশিয়া জুড়েই। কিন্তু কিভাবে! বলা হয়ে থাকে রাশিয়ার আকাশে বাতাসে কৌতুক ভেসে বেড়াতো। মদ্যপানের টেবিলে, শ্রমিকদের আড্ডায়, খাবার টেবিলে, কর্মক্ষেত্রে অর্থাৎ সর্বত্রই মানুষের মুখে মুখে কৌতুক ও রসাত্মক গল্প ছড়িয়ে থাকলেও এসবের প্রকৃত রচয়িতা কে তা জানা যেত না। কিন্তু মানুষের মনের ভাষা ব্যঙ্গাত্মক অর্থে ধারণ করত বলে কৌতুকগুলো খুবই জনপ্রিয়তা পেত।
আজকের রাশিয়ার কি অবস্থা? সেখানে কি আজও মানুষ কথা বলতে পারে? কিংবা কৌতুক? বিবিসির দেয়া তথ্য মতে- ‘১৯৯০ এর দশকে নাগরিক দুর্দশা নিয়ে প্রচুর ব্যঙ্গাত্মক টেলিভিশন অনুষ্ঠান জনপ্রিয় ছিল রাশিয়াতে। কিন্তু ২০০০ সালে ভ্লাদিমির পুতিন যখন ক্ষমতায় এলেন তখন এমন ব্যঙ্গাত্মক অনুষ্ঠান রাতারাতি বন্ধ করে দেয়া হল। তিনি এসব বিষয়বস্তু নিয়ে হাস্যরস করার বিষয়টি যেনও ঠিক বুঝলেন না। ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষমতায় আসার পর শুরুতেই তার ক্ষোভের মুখে পড়েছিলো একটি ব্যঙ্গাত্মক পাপেট শো ‘কুকলী’। তিনি ক্ষমতায় আসার পর ব্যঙ্গাত্মক অনুষ্ঠানগুলো থেকে ধীরে ধীরে যেন রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়বস্তু গায়েব হতে থাকলো। এর বদলে তাতে যুক্ত হল বিদেশী শত্রুদের নিয়ে ঠাট্টা আর পুতিনের গুণগান।’
রাশিয়ার বাকস্বাধীনতার হালচাল কিংবা কৌতুক হাস্যরস নিয়ে লিখতে গেলে বড় বড় বই লেখা সম্ভব। কিন্তু সে পথে আজ যাচ্ছি না। নিজের দেশেই আপাতত ফিরে আসা যাক। গত ৩০ ডিসেম্বরের পূর্ব থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত একটি ভিডিও ক্লিপ ও সেই ক্লিপের কিছু কথা বাংলাদেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীদের নিউজফিড দখল করে রেখেছে। বিভিন্ন জন বিভিন্ন ভঙ্গিমায় হাস্যরস ও ব্যঙ্গ করে বিষয়টি উপস্থাপন করছে। সেটি হলো- ‘মনে করেন ভাল লাগে, খুশিতে, ঠ্যালায়, ঘোরতে…’।
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় ঢাকা-৫ আসনের দনিয়া একে হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রের ভোটের চিত্র নিয়ে খবর সংগ্রহ করছিলেন মাই টিভির সাংবাদিক মাহবুব সৈকত। লাইভ সম্প্রচারের এক পর্যায়ে তিনি ভোটকেন্দ্রের বাইরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন নারীকে দেখে সন্দেহ হলে তাদের কাছে জানতে চান যে তাদের হাতে ভোট দেয়ার অমোচনীয় কালি দেয়া আছে, অর্থাৎ তাদের ভোট দেয়া হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও তারা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন কেন ?
সাংবাদিকের এমন প্রশ্নে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে এক নারী তখন বলেছিলেন যে, ‘এই থাকতে মনে করেন। খুশিতে ঠ্যালায়, ঘোরতে।’
এই ভিডিওটি যে সময়ে প্রচারিত হয়েছিল তখনও বেশ সাড়া ফেলেছিল। তবে এবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই অংশটুকু সোশ্যাল মিডিয়ায় নতুন করে ভাইরাল হচ্ছে। বেশি সাড়া ফেলতে দেখা গেছে দুই তরুণীর ‘টিকটক’ ভিডিও থেকে।
যাইহোক, প্রশ্ন হচ্ছে- ২০১৪ সালের একটি ভিডিও যেখানে ভোটকেন্দ্রে অনিয়ম ও জালিয়াতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, সেই ভিডিও এতবছর পরে এসে কেন আলোচিত হচ্ছে? কেনইবা তা মানুষের ব্যঙ্গ-রসের উপাদান হয়ে উঠেছে? এর উত্তরে যা বলা যায় তা অনেকের কাছেই অপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে। আর অপ্রিয় হলেও সত্য কথা এই যে, জাতি হিসেবে আমাদের গোল্ডফিস বা গন্ডারের সাথে তুলনা করলে গোল্ডফিস আর গন্ডারকে অপমান করা হতে পারে। অর্থাৎ গোল্ডফিসের ধর্ম সে সহজেই তার নিকট অতীতকেও ভুলে যায়। আর গন্ডারের গায়ের চামড়া নাকি অনেক পুরু। আর এ দু’টি গুণই জাতি হিসেবে আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। আমরা খুব সহজেই ভুলে যাই। আবার আমাদের চামড়া এতটাই পুরু যা অনেক ক্ষেত্রে গন্ডারকেও হার মানাতে পারবে।
২০১৪ সালের নির্বাচনেও ২০১৮ সালের নির্বাচনের মতই অনেকটা খোলামেলাভাবেই ভোট ডাকাতি হয়েছে। কিন্তু মিডিয়ায় উপস্থাপিত উপর্যপুরি প্রমাণ ও সচক্ষে ভোট ডাকাতির কার্যক্রম দেখলেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর কলঙ্কিত নির্বাচন তথা প্রহসনের বিরুদ্ধে এদেশের জনগণ রুখে দাঁড়াতে পারেনি। বিরোধী দলের পরিচয়ে যারা শত সহস্র জুলুম নির্যাতন সহ্য করেও ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র রক্ষায় রুখে দাঁড়াতে চেষ্টা করেছিলেন তাদেরকে দেয়া হয়েছে ‘আগুন সন্ত্রাসী’র তকমা। সরকারি জুলুম নির্যাতনের তীব্রতায় সাধারণ জনগণ শীতনিদ্রায় যাওয়ার ফলে টিকে যায় একটি জনসমর্থনহীন সরকার। আর তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে যতগুলো নির্বাচনই হয়েছে সবগুলোতেই কিছু মানুষকে খুশিতে, ঠ্যা লায় জালভোট আর ভোট ডাকাতির উৎসব করতে দেখা গেছে। আর এভাবেই ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের আগের রাতেই ভোট ডাকাতির মহোৎসবের সুযোগ পায় ক্ষমতাসীনরা। বাংলাদেশের জনগণ তাই এখন অনেকটাই সোভিয়েত রাশিয়ার জনগণের মত নিরূপায় হয়ে পড়েছে। তাই কৌতুক, ব্যঙ্গ হয়ে উঠেছে তাদের প্রতিবাদের ভাষা।
স্ত্যালিন যখন রাশিয়ার দোর্দণ্ড প্রতাপশালী শাসক তখন অবস্থা ছিল এমন যে, তার অনুমতি ছাড়া গাছের পাতা নড়লেও খবর করে দিতেন। কম্যুনিজম, স্ত্যালিন বা ক্ষমতাসীন সরকার সম্পর্কে প্রকাশ্যে কেউ কোন কথা বলেন না। সোভিয়েত বিরোধী কথাবার্তা মানে রাষ্ট্রদ্রোহের মত অপরাধ। হাঁচি কাশি দিলেও কেজিবি’র নজরে পড়ে যান। এমতাবস্থায় কারাগারগুলো ভরে যেতে লাগলো। রয় মেদোভেদ নামের একজন ইতিহাসবিদ স্ত্যালিনের রাজনৈতিক বন্দীদের তালিকা যাচাই বাছাই করে দেখেন যে বন্দীদের মধ্যে প্রায় দুই লক্ষ শুধুমাত্র কথার কারণে (যেমন কৌতুক বলা, সরকারের সমালোচনা করা) প্রিজন ক্যাম্পে বন্দী ছিলেন।
এধরনের কয়েদীদের শারীরিক অত্যাচারের সাথে সাথে মানসিকভাবে হেদায়েত করার জন্য প্রিজন ক্যাম্পে নিয়মিত শিক্ষা দেয়া হত। এ নিয়েও মজার কৌতুক আছে। একটা এরকম- একজন প্রিজন ক্যাম্প শিক্ষক স্ত্যালিন, মাতৃভূমি রাশিয়া ও সমাজতন্ত্রের গুনাগুণ সম্বন্ধে ভালো করে কয়েদীদের শেখালেন। শেষে বুঝেছে কিনা পরীক্ষা করার জন্য প্রশ্ন করলেন-
– আচ্ছা বলতো, তোমাদের পিতা ও মাতা কে?
– কয়েদীদের একজন হাত তুলে বললেন, ‘আমার মা হচ্ছে রাশিয়া আর আমার পিতা হচ্ছেন স্ত্যালিন’।
– বাহ্, কি সুন্দর কথা! এবার বল, তোমরা যখন সুস্থ মানসিকতার হবে তখন কি হতে চাও?
– সমস্বরে উত্তর আসলো, ‘আমরা এতিম হতে চাই’।
বাংলাদেশের অবস্থাও এখন অনেকটা তেমনই। এখন ক্ষমতাসীন দলের প্রধান যা বলবেন দেশের প্রায় ১৮ কোটি জনগণকেই তা ‘জো হুকুম’ বলে মেনে নেয়ার কোন বিকল্প দেখা যাচ্ছে না। ক্ষমতাসীন দলের কোন পাতি নেতার বিরুদ্ধে কিংবা তাদের দলীয় কোন অন্যায় কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কথা বললেই অবস্থা খারাপ। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, তথ্যপ্রযুক্তি আইন কিংবা ৫৭ ধারা কোন একটা কিছু দেখিয়ে একদম লাল দালানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। যাকে লাল দালান দেখানো হবে সে যদি সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হন, তাহলে তার সাজা বাড়বে অন্তত ৬৪ গুণ। অর্থা দেশের ৬৪ টি জেলাতেই তার নামে মামলা হবে। সেই মামলায় হাজিরা দিতে গেলেও হামলা হবে। সে হামলায় প্রাণ হারালেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে সবকিছুই জায়েজ করে নেয়া হবে, তাতে কোনই সন্দেহ নেই। দেশের জনগণ সব হারিয়ে ফেসবুকে এভাবে কতদিন আর ‘খুশিতে, ঠ্যালায়, ঘোরতে’ ধরণের কৌতুক করতে পারবে তাও ভেবে দেখার সময় এসেছে।
ঠুনকো কিংবা গায়েবি অভিযোগে লাখ লাখ মানুষ কারাগারে পুরে দিয়ে যে অবস্থা তৈরী করা হয়েছে তাতে দেশের মানুষ ‘ক্বওমী জননী’কে হারিয়ে এতিম হতে আগ্রহ প্রকাশ করলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।