বাংলাদেশে সড়কে মৃত্যু একটি বড় ধরণের সমস্যা। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে। অ্যানালাইসিস বিডি’র দীর্ঘ অনুসন্ধানে দেখা যায় গত দশবছরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন প্রায় ৬৩০০০ মানুষ। বাংলাদেশের সড়ক চূড়ান্ত পর্যায়ে অনিরাপদ। বছরে ক্ষতি অন্তত ৩৪ হাজার কোটি টাকা। বহু কারিগরি কারণ ও রাজনৈতিক প্রশাসনিক দুর্বৃত্তপনা এর জন্য দায়ী। আমাদের রাস্তাগুলো কেন মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে, তা নিয়েই হবে আজকের আলোচনা।
সম্প্রতি শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দু’জন ছাত্র ছাত্রী নিহত হওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে মৃত্যু নিয়ে ঠাট্টা করেছিলেন নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান। সেই সূত্র ধরে সারা ঢাকায় নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে নেমে পড়ে স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা। সরকার কয়েকদিন পর্যবেক্ষণে রেখে কঠোর হস্তে দমন করে এই আন্দোলনকে। পুলিশ ও ছাত্রলীগ মিলে বহু ছাত্র-ছাত্রীকে নির্যাতন করেছে এবং বহু ছাত্রকে গ্রেপ্তার করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন ছাত্ররা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। তিনি ছাত্রদের এই ধরণের আন্দোলনের জন্য ধন্যবাদ দিলেও তার প্রশাসন তাদের নির্যাতন করেছে। এই আন্দোলনের পরও সড়কে শৃঙ্খলা আসেনি। নিয়মিত মৃত্যুর মিছিল চলছেই।
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি, যাত্রী কল্যাণ সমিতি, আসক, নিরাপদ সড়ক চাই ইত্যাদি অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায় গত দশ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে ৬২ হাজার ৯৫৯ জন। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ৪৯৫৮ জন, ২০১০ সালে ৪৬৪৬ জন, ২০১১ সালে ৫৯২৮ জন, ২০১২ সালে ৫৯৫৪ জন, ২০১৩ সালে ৬৮১৩ জন, ২০১৪ সালে ৮৭৯৮ জন, ২০১৫ সালে ৮৬৪২ জন, ২০১৬ সালে ৬৭০০ জন, ২০১৭ সালে ৭৩৯৭ জন, ২০১৮ সালে ৩১৩২ জন মানুষ নিহত হয়েছেন।
যোগাযোগের ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে আছে পরিবহন খাতে মাফিয়াতন্ত্রের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হওয়া। এই মাফিয়াতন্ত্র কার্যকর আইন প্রণয়ন, তদারকি ও শাস্তিদানের ব্যবস্থার সামনে বড় বাধা হয়ে আছে। পরিবাহন খাত সরকারের মন্ত্রী, সাংসদসহ আওয়ামী লীগের নেতা এবং তাঁদের আত্মীয়দের কবজায়। ক্ষমতার ছায়ায় থাকা চালকেরাও হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। অ্যানালাইসিস বিডি’র অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা, সদস্যরা বেনামে পরিবহন ব্যবসায় যুক্ত হওয়ায় রাস্তায় আর কোনো আইনি নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে।
যোগ্যতাসম্পন্ন চালক সরবরাহে বড় সমস্যা নৌমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের তদবির। সেখান থেকে নির্দেশ এলে যে-কাউকেই ড্রাইভিং লাইসেন্স না দেওয়ার সাধ্য কারও নেই; যদিও বলা হয় সিস্টেম ডিজিটাল! বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) থেকে জানা যায়, ১৯৯২ সাল থেকে নৌমন্ত্রীর সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের দেওয়া তালিকা ধরে প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার চালককে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ ২০১১-১২ সালেও শাজাহান খানের স্বাক্ষরসংবলিত তালিকা ধরে যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া হাজার হাজার লাইসেন্স পেশাদার চালককে দেওয়া হয়েছে।
বিআরটিএ অত্যন্ত হাস্যকর মানের ড্রাইভিং পরীক্ষা নিয়ে লাইসেন্স দিয়ে থাকে, যা এখনো ঘুষের বিনিময়ে পাওয়া যায়। বিআরটিএর গাড়ির ফিটনেস যাচাই মান ভয়ংকর পর্যায়ের নিম্ন। এই ধরনের মানহীন ফিটনেস পরীক্ষার কোনো সুফল নেই। এরপরও বেশিরভাগ চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নাই এবং বেশিরভাগ গাড়িরই ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই। তারপরও তারা রাস্তায় চলতে পারে কারণ ঘুষের বিনিময়ে পুলিশ তাদের চলাচল নির্বিঘ্ন করে দিচ্ছে। অদক্ষ চালক ও গাড়ির যান্ত্রিক ত্রুটি হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী।
যাত্রী ও পণ্যবাহী প্রতিটি বাহনে ব্যাপক চাঁদাবাজি সড়কে বিশৃঙ্খলার অন্যতম কারণ। এই চাঁদাবাজির কারণে কম ট্রিপে অনিরাপদ সড়কে বেশি মাল ও যাত্রী পরিবহনের ঝোঁক প্রাধান্য পায়। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৭ জুলাই প্রথম আলোর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বলছে, দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যেতে ৪৩৯ কিলোমিটার চলতে একটি ১০ টনের পণ্যবাহী ট্রাকে ২২ হাজার টাকা শুধু চাঁদাবাজি হয়। পাঁচ বছর পর অঙ্কটা আরও বাড়ার কথা। এটাই নৌপরিবহনমন্ত্রীর ক্ষমতার উৎস। আর পরিবহন খাতটা তাঁর নিয়ন্ত্রণে থাকায় বিশাল শ্রমিক বাহিনীকে জিম্মি করে তিনি সরকারের কাছেও অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন।
আরেকটি বড় সমস্যা অনিরাপদ ও ভাঙ্গা সড়ক। এসব রাস্তায় বড় বড় আধুনিক যাত্রী ও পণ্যবাহী বাস-ট্রাকের উপযোগী লেনের স্পেস এবং ভার বহন সক্ষমতা কম। প্রয়োজনের সঙ্গে সমন্বয় করে রাস্তায় প্রশস্ত লেন, সহনীয় বাঁক, সমতল পিঠ নির্মাণ করা হয় না। রাস্তার বাঁক বৈজ্ঞানিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি, নেই সঠিক ও পর্যাপ্ত সড়ক সংকেত। নির্মাণসামগ্রী নিম্নমানের, পিচে নিম্নমানের বিটুমিন দেওয়া হয়, তাও আনুপাতিক হারে দেওয়া হয় না। অতি নিম্নমানের ইট ব্যবহৃত হয়। দুর্নীতির কারণে রাস্তায় হামেশাই গর্ত হয় প্রচুর, রাস্তার উপরিতল বেশ উঁচু-নিচু। মহাসড়কে ঢোকা ও বের হওয়ার জন্য আলাদা লেন নেই, রাস্তায় সার্ভিস লেন নেই, নেই বাস বা ট্রাকের স্ট্যান্ড, একেবারে সাইডের লেন ওঠানামার জন্য প্রশস্ত নয়। নেই নিম্নগতির বাহনের জন্য আলাদা রাস্তা, চুরি করতে গিয়ে রাস্তা প্রশস্ত না করে হাঁটার জায়গাও পিচঢালা পথে দখল হয়ে পড়ে।
সড়ক ধারণ ক্ষমতার ধারণা বাস্তবায়িত নয় একেবারেই। যেনতেন মানের ইট ও বালু দিয়ে ১, ৩ ও সর্বোচ্চ ৫ টন ধারণ ক্ষমতার যানবাহনের জন্য সড়ক বানানো হয়, অথচ টাটার ট্রাকই ১৫ টন বহনে সক্ষম। রাস্তায় জ্যাম, সেতুতে টোলের কারণে ট্রাকচালক ও মালিক ৫ টনের কথা বলে ১২ থেকে ১৫ টন বহন করেন। এটা মালিক-চালকের একতরফা সমস্যা নয়, বরং অদূরদর্শী অবকাঠামো, বাস্তবায়নকারীদের চুরি ও ব্যক্তির ব্যবসায়িক লাভের চাহিদা ইত্যাদি বহুমাত্রিক হীনতার প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক আচরণের মিশ্রণ। যানবাহনের ভারের অনুপাতে ভিত্তি তৈরি না থাকার ফলে পিচের নিচের মাটি উঁচু-নিচু হয়ে ও বড় বড় গর্ত তৈরি করে মরণফাঁদ তৈরি করে রাস্তায় রাস্তায়।
ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদানের স্টান্ডার্ড অনলাইন-অফলাইন কোর্স কারিকুলাম, শিক্ষণপদ্ধতি, বেসরকারি এজেন্টভিত্তিক প্রক্রিয়া প্রণয়ন করা করা হয়নি, করা হয়নি মানসম্মত পরীক্ষাপদ্ধতি প্রবর্তন। শিক্ষাহীন, কর্মহীন কিশোর-যুবক দীর্ঘদিন হেলপারি করে পেটেভাতে ঠেলা-গুঁতা খেয়ে ড্রাইভিং শেখে, কিন্তু রাস্তার সংকেত বোঝার বাধ্যবাধকতা তার থাকে না। অর্থাৎ অতি নিম্নমানের রাস্তায় অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা নেওয়া চালক নিজেও বড্ড নিরাপত্তা ঝুঁকিতে গাড়ি চালান।
যানজটে ব্যয়িত শ্রমঘণ্টা এবং পণ্য নষ্ট। ফলে একই পরিবহন (বাস, ট্রাক) দিয়ে চাঁদাবাজি এবং যানজটে ব্যয়িত ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে নির্দিষ্ট সময়ে বেশি ট্রিপ দিতে বাধ্য হন চালক। এতে করে এমনিতেই অনিরাপদ সড়কে যেনতেনভাবে ফিটনেসহীন গাড়ি চালিয়ে, একটানা অতি সময় ঘুমহীন শ্রান্তভ্রান্ত চালককে গন্তব্যে পৌঁছার আর্থিক, মানসিক ও স্বাস্থ্যগত তাড়নাগুলো তাড়িয়ে বেড়ায়। পরিবহনশ্রমিকেরা ব্যাপক গরম, দীর্ঘ যানজট, অধিক ট্রিপের বাধ্যবাধকতা, অনিয়মিত কিংবা স্বল্প আহার, মালিকের গালিগালাজ, যাত্রীর ভিড় ও ভাড়াসংক্রান্ত টানাপোড়েন, অধিক ভাড়া আদায়ের চাপে ফলে হররোজ লম্বা সময়ের অবসরহীন একটানা পরিশ্রমের ক্লান্তি দূর করতে ব্যাপকভাবে মাদক ও ইয়াবার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। সব মিলে আমাদের সড়ক প্রাণহানির এক সাক্ষাৎ উপকরণ। নাগরিক যেন জান হাতে নিয়ে যানে ওঠেন।
বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) একটি সমীক্ষা বলছে, দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য, আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। ঘণ্টায় মাত্র সাত কিলোমিটার গড় গতিবেগের রাজধানীতেও আশঙ্কাজনক হারে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে, কোনো হিসাবেই এমন জ্যাম ও এমন নিম্নগতির রাস্তায় প্রাণহানি তৈরির মতো দুর্ঘটনা হওয়ার কথা নয়। আজকের অনিরাপদ সড়ক ও মৃত্যুর মিছিল বিচ্ছিন্ন নয় বরং বহু নৈরাজ্যের ফসল। গত দশ বছরে আওয়ামীলীগ আমলে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নৈরাজ্যতন্ত্র ও বেশুমার দুর্বৃত্তপনার কাছে সড়ক পরিবহন খাতের সব ব্যবস্থাপনা হেরে গেছে, তারই প্রতিচিত্র আমাদের রাস্তার মৃত্যুর মিছিলগুলো।