রাজধানীর মহাখালীর ফ্লাইওভারে গাড়িচাপায় পথচারী সেলিম ব্যাপারী নিহত হওয়ার ঘটনায় সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে টাকার বিনিময়ে মামলা তুলে নেয়ার প্রস্তাব পেয়েছে নিহতের পরিবার।
নিহত সেলিম ব্যাপারীর (৫৫) পরিবার বলছে, অন্তত ‘মাস চলার মতো’ কিছু টাকা ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করে দেয়ার বিনিময়ে মামলা তুলে নেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তাদের।
সেলিম ব্যাপারী যেখানে চাকরি করতেন, সেই নাওয়ার প্রোপার্টিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমরান হোসেন বলেন, এমপি এমরামুল করিম চৌধুরী বৃহস্পতিবার রাতে তাকে ফোন করে ‘সমঝোতার প্রস্তাব’ দেন।
ইমরান হোসেন বলেন, এমপি চান, নিহতের পরিবারের পাশে থাকার বিনিময়ে তারা কাফরুল থানায় করা মামলা প্রত্যাহার করে নেবে। ফোনে কথা বলার পর এমপি সাহেব আমার বারিধারার অফিসে লোক পাঠিয়েছিলেন সমঝোতার বিষয়ে আলোচনার জন্য।
ইমরান হোসেন জানান, এমপি বা তার পরিবার বা পুলিশের কেউ ওই বৈঠকে ছিল না। তবে নিহত সেলিম ব্যাপারীর স্ত্রী, মেয়ে, মেয়ের জামাইসহ কয়েকজন আত্মীয় সেখানে ছিলেন।
তিনি বলেন, সেলিম ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার পরিবার যেন বাঁচতে পারে সেজন্য ৩০ লাখ টাকার একটা ফিক্সড ডিপোজিট করে দিতে এমপি সাহেবকে অনুরোধ করেছি।
সেলিমের পরিবার সমঝোতায় রাজি কি না জানতে চাইলে ইমরান বলেন, টাকা পয়সা দিয়ে তো জীবনের দাম হবে না। আবার মামলা চালিয়েই বা কী হবে? পরিবারটির দিকে তাকিয়েই মূলত এমপি সাহেবের সমঝোতার প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছি। এমপি সাহেব কথা দিয়েছেন, দু-একদিনের মধ্যে এর মীমাংসা করবেন। তার প্রতি আমরা আস্থা রেখেছি।
সমঝোতার আলোচনার সময় দুর্ঘটনায় শাবাবের সম্পৃক্ততার বিষয়ে কথা হয়েছে কি না জানতে চাইলে ইমরান হোসেন বলেন, এমপি সাহেব সেটা সরাসরি স্বীকার না করলেও তাদের গাড়িতেই যে দুর্ঘটনা ঘটেছে এটা স্বীকার করেছেন। তিনি ভবিষ্যতেও সেলিম ব্যাপারীর পরিবারের পাশে থাকবেন বলে কথা দিয়েছেন।
সমঝোতার বিষয়ে সেলিম ব্যাপারীর মেয়ের জামাই আরিফ ভূঁইয়া বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে ইমরান স্যারের অফিসে আমরা এমপি সাহেবের লোকজনের সঙ্গে সমঝোতার বিষয়ে কথা বলেছি। এখানে ইমরান স্যার যা সিদ্ধান্ত দেবেন সেটাই আমাদের পরিবারের সিদ্ধান্ত।
টাকার বিনিময়ে আপসের বিষয়ে জানতে চাইলে নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম যুগান্তরকে বলেন, ‘এ বিষয়ে তো আমি কিছু জানি না, এটা আপনারাই জানেন, আই ডোন্ট নো। টাকার বিনিময়ে হোক আর যাই হোক, যেহেতু দেশে আইন আছে, আইনের মাধ্যমে যেটা হয় সেটাই দেখব।’
যুগান্তরের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘আইন কি জিনিস সেটা আপনারা বোঝেন, আপনাদের যুগান্তর বোঝে? আপনারা কি জানেন এই এক্সিডেন্ট আইনে কী হয়?’
এর আগে শুক্রবার সকালে মামলার অগ্রগতির বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করলে কাফরুল থানার ওসি শিকদার মোহাম্মদ শামিম হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘মামলার তদন্ত চলছে।’
বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া শাখার উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেছিলেন, সেলিম ব্যাপারী নিহত হওয়ার ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে অভিযুক্ত চালককে শনাক্ত করে অভিযান চালানো হবে।
ওসি শিকদার মোহাম্মদ শামিমের কাছে ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যগ্রহণ ও ঘাতক গাড়ি জব্দ করার বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য জানতে চাওয়া হলে তিনি প্রথমে বলেন, নতুন কোনো তথ্য এলে গণমাধ্যমকে জানানো হবে।
এরপর তিনি বলেন, এ বিষয়ে জানতে ডিসি মিডিয়া মাসুদুর রহমানের সঙ্গে কথা বলুন।
শুক্রবার দুপুর পৌনে ১টা পর্যন্ত মাসুদুর রহমানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
নিহত সেলিম ব্যাপারী দুই যুগের বেশি সময় ধরে নাওয়ার প্রোপার্টিজের গাড়িচালক হিসেবে চাকরি করে আসছিলেন। গত মঙ্গলবার রাতে ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে একটি গাড়ির ধাক্কায় তিনি নিহত হন।
এ ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, বেপরোয়া গতিতে আসা গাড়িটি প্রথমে ফ্লাইওভারে এক পথচারী পায়ের ওপর তুলে দেয়। তিনি (পথচারী) ওই গাড়ির বাম্পার ধরে ফেলেন। গাড়িটি ব্যাক গিয়ারে এসে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন। গতি বাড়িয়ে তিনি আবারও সামনের দিকে এগিয়ে যান। ওই পথচারী ছিটকে ফ্লাইওভারের গার্ডারে গিয়ে পড়েন। মুহূর্তেই মাথা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় ওই পথচারীর। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, ঘটনার পর তিনিসহ কয়েকজন মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারে করে ওই গাড়ির পিছু নেন। গাড়িটি ন্যাম ভবনের সামনে গিয়ে থামে। এ সময় এমপিপুত্র শাবাবের সঙ্গে তাদের বাগ্বিতণ্ডা হয়। ঘটনার কথা কাউকে জানালে প্রাণনাশের হুমকিও দেন শাবাব। তিনি মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন বলে মনে হয়েছে।
তবে শাবাবের মায়ের ভাষ্য, দুর্ঘটনার সময় গাড়িটি চালাচ্ছিলেন তাদের একজন ড্রাইভার, শাবাব নয়।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যানুযায়ী, ঘাতক গাড়িটি শাবাবের মা কামরুন নাহার শিউলির নামে নিবন্ধিত। তিনি কবিরহাট উপজেলা চেয়ারম্যান।
ওই ঘটনায় কাফরুল থানায় গাড়ির নম্বর উল্লেখসহ অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন নিহত সেলিমের মেয়ের জামাই আরিফ ভূঁইয়া।
তবে ঘটনার পর ৩৬ ঘণ্টা পার হলেও অভিযুক্ত শাবাব চৌধুরীকে গ্রেফতার ও ঘাতক গাড়িটি জব্দে কোনো অগ্রগতি নেই পুলিশের।
সূত্র: যুগান্তর