রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত গণহত্যার চিহ্ন মুছে দিতে বুলডোজার চালিয়ে গণকবরগুলো মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে মিয়ানমার সরকার। একটি মানবাধিকার পর্যবেক্ষক সংস্থা এ কথা জানিয়েছে।
রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বৌদ্ধদের পরিচালিত গণহত্যা বিষয়ে দু’টি বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েট প্রেস (এপি) ও রয়টার্সের অনুসন্ধানের পরই গণকবর নিশ্চিহ্ন করার এই অভিযোগ উঠলো। ওই সংস্থা দু’টির অনুসন্ধানেও গণহত্যা ও গণকবরের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করতে কাজ করছে আরাকান প্রজেক্ট নামের একটি সংস্থা। সংস্থাটি সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ানকে বেশ কিছু প্রমাণ সরবরাহ করেছে। এর মধ্যে একটি ভিডিওতে রয়েছে গণকবরগুলো ধ্বংস করার আগের চিত্র। ওই ভিডিওতে দেখা গেছে একটি বনাঞ্চলের পাশে মাটির ভেতর থেকে কাপড়ের ব্যাগে মোড়ানো একটি লাশের পা বের হয়ে আছে।
আরাকান প্রজেক্টের পরিচালক ক্রিস লিওয়া মনে করেন, সংবাদমাধ্যমে গণকবরের কথা প্রকাশ হওয়ার পর সব প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করে দিতে বুলডোজার চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা জানি অন্তত দু’টি গণকবরের কথা মিডিয়ায় এসেছে; কিন্তু গত বৃহস্পতিবার আরেকটি গণকবর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। এর অর্থ হচ্ছে গণহত্যার প্রমাণ ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে।’ এই মানবাধিকার কর্মী আরো বলেন, ‘বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এই বুলডোজার চালানোর কাজ করছে। তারা রাখাইন রাজ্যের নয়, মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় অঞ্চল থেকে এসেছে। তবে এসব যে সরকারের নির্দেশে ঘটছে সেটি স্পষ্ট।’
যে গণকবরটি গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে সেটির অবস্থান রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলীয় বুথিডং পৌরসভার মাউং নু এলাকায়। এই এলাকায় গত আগস্টে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া লোকদের বরাত দিয়ে আরেক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, আগস্টের সেই গণহত্যার সময় এই গ্রামের লোকেরা নিরপত্তার জন্য একটি বাড়িতে জমা হয়েছিল। মিয়ানমার সেনারা তাদের গুলি, ছুরিকাঘাত ও ধর্ষণ করেছে। কয়েক ডজন লোককে সেদিন এক সাথে হত্যা করা হয়েছিল। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তোলা কিছু ছবি হিউম্যান রাইটসের হাতে এসেছে, যাতে দেখা গেছে ওই ঘটনার পর পুরো মাউং নু এলাকাটিই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।
রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রহীন মুসলিম জনগোষ্ঠী। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে কয়েক দশক ধরে পরিকল্পিত নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গারা। ২০১২ সাল থেকে অন্তত তিনটি গণহত্যা চালানো হয়েছে তাদের ওপর। যদিও মিয়ানমার সরকার প্রতিটি অভিযোগই অস্বীকার করছে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের জাতিগত স্বীকৃতি দেয় না। তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছে, এমনকি রোহিঙ্গা নামটিকেও তারা স্বীকার করে না। রোহিঙ্গাদের ‘অবৈধ বাঙালি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে।
গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে কথিত একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হামলার সূত্র ধরে রেহিঙ্গাদের ওপর শুরু হয় সর্বশেষ গণহত্যা ও নিপীড়ন অভিযান। এই অভিযানে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসিলমকে হত্যা করে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বৌদ্ধরা। প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। গত সপ্তাহে মিয়ানমারের মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসঙ্ঘের নিযুক্ত বিশেষ দূত ইয়াংহি লি রাখাইনের বর্বরতাকে ‘গণহত্যার প্রতীক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। দীর্ঘ দিন ধরেই রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো বর্বরবতা অস্বীকার করার পর গত জানুয়ারিতে ইন দিন নামের একটি গ্রামে ১০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করার পর গণকবর দেয়ার কথা স্বীকার করে। তবে রেহিঙ্গা গণহত্যার তদন্তের বিষয়ে মিয়ানমার সরকার আগের অবস্থানেই আছে। জাতিসঙ্ঘের একটি অনুসন্ধান দলকে মিয়ানমারে প্রবেশ করতে দেয়নি দেশটির সরকার। এ ছাড়া জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক দূতকেও ঢুকতে দেয়া হয়নি দেশটিকে।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক উপপরিচালক ফিল রবার্টসন বলেছেন, ‘মাউং নুতে গণকবর বুলডোজার দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেয়ার কথা শুনেছি আমরা। বার্মিজ নিরাপত্তা বাহিনীর অত্যাচারের কথা চাপা দিতে এ কাজ করা হচ্ছে বলে আমরা উদ্বিগ্ন।
গত সপ্তাহে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির একটি রিপোর্টে রাখাইনের অন্য একটি অংশে বুলডোজার চালানোর কথা জানা গেছে। আকাশ থেকে তোলা ছবিতে দেখা গেছে, সেনা অভিযানে ক্ষতিগ্রস্ত একটি রোহিঙ্গা গ্রামের অবশিষ্ট স্থাপনাগুলো গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
বুলডোজার দিয়ে রোহিঙ্গাদের গণকবরের চিহ্ন মুছে ফেলার বিষয়ে জানতে চাইলে মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র জ তে বলেন, ‘রোহিঙ্গা নয়, দয়া করে বাঙালি বলুন’। এরপর তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার জায়গাগুলো পরিষ্কার করছে। সেখানে কোনো বাড়ি নেয়, শুধু সমতল জমি। আমরা সেখানে নতুন গ্রাম তৈরি করবো ফিরে আসা রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য।
গণকবর নিশ্চিহ্ন করার অভিযোগকে তিনি ‘বাঙালিদের বানানো গল্প’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
সূত্র: নয়াদিগন্ত