মো. এবাদুর রহমান শামীম
ওয়াজ মাহফিল বাঙালি মুসলমানদের হাজার বছরের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। উপমহাদেশে ইসলামের শাশ্বত বাণীর প্রসার ও প্রসারে ওয়াজ মাহফিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। একসময় হক্ক্বানী আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখগণ ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে ক্বুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামের মৌলিক বিধিবিধান [সালাত, সাওম, হজ, যাকাত, সুদ, ঘুষ, হালাল, হারাম, শিরক্, বিদ’আত প্রভৃতি], নবী-রাসূল ও সাহাবায়ে কেরামদের জীবনাদর্শ, ইসলামের ইতিহাস ও অতীত ঐতিহ্যের গৌরবগাঁথা কাহিনী গ্রাম-বাংলার সাধারণ মুমিন-মুসলমানদের কাছে পৌঁছে দিতেন। সময়ের বিবর্তনে ওয়াজ মাহফিলের ধরণ কিছুটা পরিবর্তিত হলেও জনপ্রিয়তা একটু হারায়নি। বরং ওয়াজ মাহফিলের কলেবর আরো বর্ধিত হয়েছে। তাফসিরুল ক্বর’আন মাহফিল, শানে রিসালাত মাহফিল, ক্বিরাত মাহফিল, ইসলামি গজল সন্ধ্যা, ইসলামি কবিতার আসর ও সাহিত্য আড্ডা এবং ইসলামি কনফারেন্স সবই এর বিবর্ধিত রূপ।
বাংলাদেশে তাফসিরুল ক্বুর’আন মাহফিলের ব্যাপক প্রসার ও জনপ্রিয়তা লাভের নেপথ্য কারিগর বিশ্বনন্দিত মুফাসসির আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। শুধু বাংলাদেশ নয়; গোটা দুনিয়ায় ক্বুর’আনের তাফসির করে বেড়িয়েছেন ক্বুর’আনের পাখি খ্যাত এই বিশ্বনন্দিত মুফাসসির। ওয়াজ মাহফিল উপমহাদেশে জনপ্রিয় হলেও বাঙালির হাত ধরে বিশ্বব্যাপী দ্বীন প্রচারের সবেচেয়ে সহজ ও কার্যকর মাধ্যম হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। শুধু ইসলাম প্রচার কিংবা প্রসার নয়; বরং বাঙালির আন্দোলন-সংগ্রামে জাতিগত ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় ওয়াজ মাহফিলের ভূমিকা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই।
শান্তির ধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, ইসলাম বিরোধী আইন পাশ, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, হক্ক্বানী আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখ সম্পর্কে কটূক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক ও শান্তিপূর্ণ মোকাবেলায় সময়ে সময়ে ওয়াজ মাহফিল মিডিয়ার ভূমিকা পালন করে আসছে। দাউদ হায়দার, তাসলিমা নাসরিন, আবদুল লতিফ এবং দেশদ্রোহী ও ইসলাম ধর্মবিদ্বেষী শাহবাগী চৌর্যবৃত্তিক চেতনাবাজদের কুকীর্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ওলামায়ে কেরাম সকল মুমিন-মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে। এমনকি ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ, ধর্মীয় দাঙ্গা, আইএস এবং খেলাফত প্রতিষ্ঠার নামে মানুষ হত্যার কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতায় ওয়াজ মাহফিলের অবদান সর্বজন স্বীকৃত।
ওয়াজ মাহফিল/তাফসির মাহফিল শীতকালীন গ্রাম-বাংলার অতি পরিচিত ও দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য। যা মুমিন-মুসলমানদের দৃষ্টি ও আত্মার খোরাক। ওয়াজ মাহফিলে ক্বুরআন ও সুন্নাহর আলোকে উপর্যুক্ত বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা ও দিকনির্দেশকমূলক জ্ঞানগর্ভ নসিহত পেশ করেন দেশবরেণ্য হক্ক্বানী আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখগণ। তাঁদের নসিহত শুনে ও সংস্পর্শে এসে লক্ষ লক্ষ মানুষ সুন্নাহর অনুযায়ী জীবন অতিবাহিত করছেন। অমুসলিমরাও ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় লাভে ধন্য হচ্ছেন ওয়াজ মাহফিলের বদৌলতে। ফলে তথাকথিত বাম ও ইসলাম বিদ্বেষিরা ওয়াজ/তাফসির মাহফিল বন্ধ করতে বহুমুখী ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পেতে আসছে। জঙ্গিবাদের দোহাই দিয়ে শুক্রবারে মসজিদের ইমাম কর্তৃক প্রদত্ত খুতবা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে বারংবার। কিন্তু তাঁরা সফলকাম হয়নি। হবেও না, ইন-শা-আল্লাহ্।
ওয়াজ/তাফসির মাহফিল মূলত হক্ক্বানী আলেম-ওলামা ও ইসলাম প্রিয় মুসলমানদের মিলন মেলা। এমনকি শরিয়তসম্মত এক প্রকার উত্তম বিনোদনও বটে। ওয়াজ মাহফিলে সাধারণত রাজনৈতিক নেতাদের আনাগোনা খুব বেশি দেখা যায় না। অবশ্য নির্বাচন আসলে বসন্তের কোকিলের মতো মাথায় টুপি দিয়ে ওয়াজের মঞ্চে মঞ্চে দু’আর নামে ভোট চেয়ে মানুষের বিরক্তি ও ঘৃণার খোরাক হন আমাদের নীতিহীন রাজনৈতিক নেতারা। সম্প্রতি প্রায়শই দেখা যায়, ওয়াজ মাহফিলের প্রধান অতিথি স্থানীয় সংসদ সদস্য কিংবা ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতাধর রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তি। রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিদের অতিথি না করলে অনুমতিও পাওয়া যায় না। এটা আমাদের জন্য একপ্রকার অশনি সংকেত।
প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়াসহ পাবলিক কানেক্টেড সব সেক্টর ইসলাম বিদ্বেষি ও ধর্মহীনদের দখলে। শুধু ওয়াজ মাহফিল ব্যতীত। ইসলাম বিদ্বেষি শকুনরা বিভিন্ন যড়যন্ত্রে ব্যর্থ হয়ে কৌশল পরিবর্তন করেছে। এখন তাঁদের চোখ ওয়াজ মাহফিলের দিকে। রাজনৈতিক নেতারা সব জায়গায় নিজেদের আধিপত্য সমুন্নত রাখতে সক্ষম হয়েছে। ওয়াজ মাহফিলের প্রধান অতিথির পদ অলংকৃত করার খায়েশ অপূর্ণ রয়েছে। তাঁরা ইসলামের বন্ধু সেজে ওয়াজ মাহফিলে ওয়াজ করে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ আবার নাকি হাদিয়াও পাচ্ছে বলে শোনা যায়। এমনকি আলেম-ওলামাদের নসিহত করার মতো ধৃষ্টতা ও দুঃসাহসও দেখাচ্ছে।
রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওয়াজ মাহফিলে দাওয়াত দেওয়া হবে, তাঁরা মাহফিলে ওয়াজ শুনতে আসবেন; এটাতো স্বাভাবিক ও আনন্দের বিষয়। তাইবলে রাজনৈতিক নেতাদের প্রধান অতিথি করতে হবে কেন? এই ধরণের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে আমাদের সরে আসা উচিত। অতি উৎসাহী হয়ে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবেন না। ইতিহাস ভুলে যাবেন না, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস ভুলে গেলেও শাপলাচত্বরের দুঃসহ স্মৃতি এতো সহজে ভুলে যাবেন! দয়াকরে এই ব্যাপারে সচেতন হোন। নইলে তজ্জন্য একসময় চরম মূল্য দিতে হবে। এর সুদূরপ্রসারী কুফল সম্পর্কে এখনই সচেতন হওয়া দরকার। আমাদের সম্মানিত আলেম-ওলামাদের উচিত, যেসব মাহফিলে সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ও প্রচলিত যেকোন রাজনৈতিক নেতাদের প্রধান অতিথি করা হয়, সেসব মাহফিলের দাওয়াত গ্রহণ না করা। এই মহান ও সাহসী দায়িত্ব আলেম-ওলামাদেরকেই নিতে হবে। এই ধরণের ওয়াজ মাহফিলে দাওয়াত গ্রহণ বা বয়ান পেশ করা অনেকটা নৈতিক পরাজয়ও বটে।
৭ ডিসেম্বর ২০১৭ নারায়নগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার তুরকুনীতে অনুষ্ঠিত ইসলামী মহাসম্মেলনের প্রধান বক্তা প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন, সুবক্তা ও লেখক মুফতি হাবিবুর রহমান মিছবাহ এবং সম্মেলনের প্রধান অতিথি স্থানীয় সংসদ সদস্য জনাব নজরুল ইসলাম বাবুর মধ্যকার বাকবিতণ্ডার ভিডিও ৮ ডিসেম্বর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। ভিডিওটি নেটিজেন ও সিটিজেন উভয় দুনিয়ায় আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছে। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে একজন সংসদ সদস্যের এহেন বুনো আচরণে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তাঁর কুরুচিপূর্ণ ও অসভ্য আচরণ উপস্থিত হাজার হাজার এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখেছে। ওয়াজ মাহফিলে এই ধরণের দৃশ্য এখন প্রায়শই দেখা যায়। এমনকি ওয়াজ মাহফিলে হামলা, ওয়াজের ওপর হামলা ও মামলা মতো ঘটনা ঘটছে। আড়াইহাজারি ঘটনায় সবকিছু ছাপিয়ে আলোচনায় মুফতি হাবিবুর রহমান মিছবাহ সাহেবের ইখলাস, সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ জবাব। তৎসময়ে তিনি যে অসম সাহসীকতার সাথে সংসদ সদস্যের ঔদ্ধত্যপূর্ণ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তা গোটা আলেম সমাজের জন্য এক শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত বটে। বয়ান শেষে ঐ মাহফিল থেকে সসম্মানে বীরের বেশে নিজ পরিবার, মাদ্রাসা ও ওয়াজের মঞ্চে ফিরে এসেছেন, এটাও নিঃসন্দেহে আল্লাহর সাহায্য। দু’আ করি রাব্বে কারিম যেন তাঁর জবান, সাহস, ইলম ও হায়াতে বরকত দান করেন।
মুফতি হাবিবুর রহমান মিছবা ও শাইখ মামুনুল হকের ফেবু স্ট্যাটাসের মধ্যদিয়ে ইতোমধ্যে সবাই জেনে গেছেন যে, বিষয়টি সুষ্ঠুভাবে সুরাহা হয়েছে। মাননীয় সংসদ সদস্য বুঝতে সক্ষম হয়েছেন ভোটের রাজনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। আর সম্ভবত এই কারণেই নিজ উদ্যোগে বিষয়টি সুরাহা করার চেষ্টা করেছেন। উদ্দেশ্য যাইহোক না কেন, অন্তত নিজের ভুল বুঝতে পেরে দুঃখ প্রকাশ করেছেন- এটা কম কিসের। তজ্জন্য তিনি অবশ্যই সাধুবাদ পাবার যোগ্য।
লেখক: শিক্ষক, কলামিস্ট ও কর আইনজীবী
Discussion about this post