২০০২ সালের অপারেশন ক্লিনহার্টের পর তৎকালীন জোট সরকার মনে একটা বিশেষায়িত বাহিনীর প্রয়োজন। যারা বড় ধরণের সন্ত্রাস, মাদক চোরাচালান, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস ইত্যাদি নিয়ন্ত্রন করবে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের প্যারেডে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে এ বাহিনী। একই বছরের পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে র্যাব তাদের আনুষ্ঠানিক অপারেশন কার্যক্রম শুরু করে।
মোট সাতটি ব্যাটালিয়ন পাঁচ হাজার ৫২১ জন লোকবল নিয়ে যাত্রা শুরু হয় র্যাবের। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌ-বাহিনী, বিমানবাহিনী, বাংলাদেশ পুলিশ, বিজিবি, আনসার, কোস্টগার্ড ও সিভিল সাভির্সের চৌকস সদস্যদের নিয়ে এ বাহিনী গঠন করা হয়। শুরুতেই সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয় র্যাব। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে সন্ত্রাসীদের মূর্তিমান আতঙ্ক। দেশের নানা দুর্যোগ আর বিপদশঙ্কুল পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের ভরসার স্থল হয়ে ওঠে। এখনো মনে পড়ে র্যাবের গাড়ি দেখলেই সাধারণ মানুষ সামরিক কায়দায় স্যালুট দিত। কোন এলাকার সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার হলে র্যাব সদস্যের ফুল দিত। আনন্দ মিছিল করতো। মিষ্টি বিতরণ করতো।
বিশেষত দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি আর শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নানামুখি অত্যাচারে জনগণের জীবন অতিষ্ঠ উঠলে এর দমনে র্যাবের ভূমিকা ছিলো সব মহলে প্রশংসনীয়। চরমপন্থী, জঙ্গি, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ও মাদক নিয়ন্ত্রণে র্যাবের বহু সফল অভিযানের নজির রয়েছে। সন্ত্রাস দমন করে আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি, জাতীয়, সামাজিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে এ বাহিনী। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩টি জেলায় একযোগে সিরিজ বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয় জঙ্গি সংগঠন জেএমবি। ওই ঘটনায় নিহত ও আহত হয়েছেন অনেকে।
এ ঘটনার পর জঙ্গি সংগঠনটির শক্তির উৎস ও তাদের দমনে মাঠে নামে র্যাব। এ বাহিনীর অত্যন্ত চৌকস গোয়েন্দা বিভাগ জেএমবিসহ বিভিন্ন ধর্মীয় জঙ্গি সংগঠনের আস্তানা, এদের মূল হোতা ও শক্তির যোগানদাতাদের খুঁেজ বের করে। র্যাবের অভিযানে গ্রেফতার হয় জেএমবি ও বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের কয়েকশ সদস্য। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জেএমবি প্রধান শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলাভাই, সামরিক শাখার প্রধান আতাউর রহমান সানি প্রমুখ। র্যাবের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো তারা এদেশের জঙ্গীগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রন করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে সক্ষম হয়, যা পৃথিবীর অন্য কোন দেশে সম্ভব হয়নি। এছাড়া সরকারের পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নান, আরমানসহ অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করে র্যাব ।
জোট সরকারের পরিবর্তন হয়ে নানা ঘটনা-উপঘটনার মধ্য দিয়ে দুই বছরের জন্য আসে মঈন-ফখরুদ্দিনের অবৈধ সরকার। শুধুমাত্র বড় ধরণের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে তৈরী হওয়া র্যাব রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার হতে শুরু হয়। রাজনৈতিক নেতাদের (মন্ত্রী-এমপি) হয়রানি, গ্রেপ্তার, ষড়যন্ত্র ইত্যাদি কাজে র্যাবের ব্যবহারই র্যাবকে ধীরে ধীরে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়। এরপর বর্তমান হাসিনা সরকার একে পুরোপুরি পুলিশের মতই ব্যবহার করে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য, বিরোধী দল নির্মূল করার জন্য র্যাবের ব্যবহার করে হাসিনা।
র্যাবও নিজেকে সর্বেসর্বা ভাবতে শুরু করে। র্যাবকে দিয়ে সরকার এমনসব কাজ করিয়েছে এবং এমনসব কাজের সাক্ষী হয়ে আছে যা সরকারের জন্য বিব্রতকর এবং ভয়ংকর। ফলশ্রুতিতে র্যাব জবাবদিহীতার উর্ধ্বে একটি সামরিক বাহিনীতে পরিণত হয়। যাকে ইচ্ছা খুন করা, গুম করা, পঙ্গু করে দেয়া, গ্রেপ্তার করে টাকা আদায় করা র্যাবের নৈমিত্তিক কাজে পরিণত হয়েছে।
আপনাদের মনে থাকবে লিমনের কথা। একটি খুনের মিথ্যা অভিযোগে গরীব এই কলেজছাত্রকে পঙ্গু করে দেয় র্যাব। মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করতে গিয়ে ওর বাম পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে র্যাব। ঘটনাটি ২০১১ সালের। তখন এই ঘটনা এত মারাত্মক হিসেবে দেশের মানুষের কাছে প্রতিভাত হয়েছে যে ডজন ডজন রিপোর্ট এবং ডজন ডজন মন্তব্য প্রতিবেদন ও উপসম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। দেখুন লিমন ট্রাজেডি।
আজকে এই ধরণের ঘটনা এত বেশী হয়েছে যে, এই টাইপের ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করাটাই হাস্যকর মনে হবে। প্রায় প্রতিদিন র্যাবের হাতে মানুষ খুন হয়। আর সাথে থাকে র্যাবের সেই গথবাঁধা গল্প। সম্প্রতি সেই গল্পের একটা পটভূমি পাওয়া গিয়েছে। নারায়নগঞ্জের সাত খুন র্যাবের সমস্ত অতীত কর্মকান্ডকে ছাপিয়ে অনেক বড় এক কলঙ্ক। র্যাব টাকা নিয়ে খুন করে স্রেফ ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবে। যদিও এই ঘটনার বিচার হয়েছে, একটা রায়ও হয়েছে। ১৮ জন র্যাব সদস্যকে শাস্তির আদেশ দেয়া হয়েছে। এর একটা বড় কারণ হল এখানে র্যাব যাদের মেরেছে তারা ক্ষমতাসীন দলের লোক।
বিরোধী দলের লোক খুন করার নির্দেশ সরাসরি সরকার দিয়ে থাকে বলে সে ঘটনার বিচার তো দূরস্থান মামলাই নেয়া হয় না। কিছুদিন আগে হানিফ মৃধা নামে একটি সাধারণ ব্যবসায়ীকে এরেস্ট করে তার থেকে ৭ লক্ষ টাকা ঘুষ নেয় ছেড়ে দেবে বলে। ছেড়ে তো উল্টো জঙ্গী দেখিয়ে তাকে খুন করে। এরকম একটি দু’টি নয় শত শত ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের ঘটনার পর র্যাব-১১’র তৎকালীন অধিনায়ক লে. কর্নেল (বরখাস্ত) তারেক সাঈদ, মেজর (বরখাস্ত) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (বরখাস্ত) এম এম রানাসহ ২৫ সদস্যের নাম উঠে আসার পর দেশ-বিদেশে তোলপাড় শুরু হয়। র্যাবের ভাবমর্যাদা সংকটে পড়ে। পরে র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে গোয়েন্দা শাখা তদন্তে নামে। তদন্তে জানা যায়, তারা নিরপরাধ লোকজন ধরে র্যাব অফিসে এনে নির্যাতন চালিয়ে অর্থ আদায় করতেন। যারা নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের গুম করা হয়েছে। এভাবে অন্তত ২০ জনকে তারা গুম করেছেন বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ২০১৪ সালে ১৫৪ জন, ২০১৫ সালে ১৯২ জন ২০১৬ সালে ১৯৭ জন খুন হন। গুমের সংখ্যা এর চাইতেও বেশী। আর পঙ্গু বা নির্যাতন হিসেবছাড়া।
খুব সম্প্রতি র্যাব যাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে খুনী বানায় তাদের একটি প্রশিক্ষণের অডিও রেকর্ড পেয়েছে সুইডিশ রেডিও। যার খুব অল্প অংশ তারা প্রচার করেছে। তারা বলেছে যে ব্যক্তি এই রেকর্ড ইংরেজিতে অনুবাদ করেছে সে অস্থির হয়ে গিয়েছিল। বারবার সে প্যানেল থেকে বের হয়ে পানি খাচ্ছিল।
অডিওতে র্যাবের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তাকে বলতে শোনা যায়, “তোমরা যদি তাকে(টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে) খুঁজে পাও, শুট এন্ড কিল হিম(গুলি করো এবং হত্যা করো), যেখানেই থাকুক। এরপর তার পাশে একটি অস্ত্র রেখে দাও।”
বিচারবহির্ভুত হত্যার এমন রোমহর্ষক নির্দেশ দেয়ার পর পুলিশের এলিট ফোর্স কিভাবে কাকে হত্যা করবে এসব তালিকা কিভাবে নির্বাচন করে এসব নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়। এমনকি এই কর্মকর্তা নিজেই যে অসংখ্য হত্যার সাথে জড়িত তা নিজেই উল্লেখ করে।
র্যাব কর্মকর্তা বর্ণনা করেন কীভাবে পুলিশ সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে ঘুষ নেয়। এমনকি তারা অবৈধ অস্ত্র কিনে মানুষকে খুন করে সেই অস্ত্র তার পাশেই রেখে দেয়। আসলে সাধারন মানুষ কখনো অবৈধ অস্ত্র রাখে না। কিন্ত পুলিশ যাকে হত্যা করছে তারও পুলিশকে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল এই ধরনের বিষয় প্রমানের জন্য, বলতে গেলে আত্মরক্ষার্থে তারা গুলি ছোড়ল, এই বক্তব্যের যথার্থতার জন্য নিহতের পাশে অস্ত্র রেখে দেয়া হয়।
দুইঘণ্টাব্যাপী এই গোপন রেকর্ডিং খুবই স্পর্শকাতর। আর র্যাব যে হত্যা এবং জোরপূর্বক গুম করে এই বিষয়টি এই কর্মকর্তা তার বক্তব্যে বার বার উল্লেখ করেন।
গুমের ক্ষেত্রে তিন ধরনের কৌশল ব্যবহার করে থাকেন-
(১) টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে অপহরন
(২) তাকে হত্যা করা
(৩) তার লাশ চিরতরে গুম করে ফেলা।
আলাপকালে তিনি বলেন, কোন লাশ নদীতে ফেলে দেওয়ার আগে তারা লাশের সাথে ভারি ইট বেঁধে দেয়। সেই কর্মকর্তা আরো কথা বলে যা অনেকেটা সিনেমার মত- যেসব অফিসার এই ধরনের অপারেশনে যায়,তারা অনেকে নিখুঁতভাবে এই কাজ করে। এটাও সত্য গুম এরপর হত্যা, এই ধরনের কাজে সব পুলিশ দক্ষ না। তাই এই ধরনের অপারেশনে কোন প্রকার ক্লু বা সামান্য চিহ্নও যাতে না থাকে, এমনকি আমাদের আইডিকার্ড, আমাদের গ্লাভস পরতে হয় যাতে আংগুলের ছাপ পাওয়া না যায়। এমনকি জুতার মধ্যেও আলাদা আবরন লাগানো হয়।
এই কর্মকর্তার মতে, রাজনীতিতে বিরোধীদলের বিশাল একটা অংশকে নিশ্চিহ্ন করাই এই ধরনের অপারেশনের লক্ষ্য।
এই র্যাব কর্মকর্তা বলেন, আসলে র্যাব যাদেরকে ধরে নিয়ে আসে, তাদের ভাগ্য আসলে উপরের নির্দেশের উপর নির্ভর করে। তিনি এই গোপন রেকর্ডিংয়ে গুমকৃত ব্যক্তিদের উপর কিভাবে অত্যাচার করা হয় এই বিষয়গুলোও বলেন। আসলে একটা অন্ধকার কক্ষের ঠিক মাঝখানে একটি হালকা আলোর বাতি দিয়ে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে নগ্ন অবস্থায় ঝুলিয়ে রাখা হয়। তাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে রাখা হয়, আর তার অন্ডকোষে ইট বেঁধে দেয়া হয়। ইটের ওজনের কারনে তার অন্ডকোষ অনেকেটা মুছড়িয়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে এই ধরনের ব্যক্তি অবচেতন হয়ে যায়, আর বুঝাই যায় না সে কি মৃত না জীবিত।
ফাঁস হওয়া অডিওটি শুনতে ও তাদের প্রতিবেদন পড়তে সুইডিশ রেডিওর ওয়েবসাইট দেখুন।
এখন র্যাবের একটাই পরিচয় সারা দেশে “র্যাব একটি সরকারি সন্ত্রাসী বাহিনী”। না এটা শুধু বাংলাদেশে নয় সারা বিশ্বেই তাদের এই পরিচয়। আগে র্যাব ছিল সন্ত্রাসীদের মূর্তিমান আতঙ্ক, আর এখন সাধারণ মানুষদের।
আহমেদ আফগানী এর ব্লগ থেকে
Discussion about this post