১২ জুন ১৯৯৬ তারিখে ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের জনপ্রিয় দল বিএনপি অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান করে। পরবর্তীতে জনগণের আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানতে বাধ্য হয়।
বিএনপির এই দুর্বল সিদ্ধান্তের সুযোগ নিয়ে ইসলাম বিদ্বেষী ও ভারতীয়দের একান্ত অনুগত আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় চলে আসে। তখন থেকেই তারা সারাদেশে ইসলামী রাজনীতিকে উৎখাত করার জন্য উঠে পড়ে লাগে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডেও এর বিপরীত কিছু ছিল না।
এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালের ২২ জুলাই সীতাকুণ্ড কলেজের ছাত্রাবাস থেকে ছাত্রলীগ ৪ জন ছাত্রকে জোরপূর্বক বের করে দেয়। বলাবাহুল্য এরা প্রত্যেকেই ছিলেন সীতাকুণ্ড কলেজ ছাত্রাবাসের বৈধ ছাত্র ও ছাত্রশিবিরের কর্মী। ৪ টি সিট দখল করে তারা ছাত্রলীগের কিছু গুন্ডাকে হলে তুলে দেয়। ছাত্রশিবির এই ঘটনার প্রতিবাদ করে। কলেজ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে। কলেজ কর্তৃপক্ষ ও কর্তব্যরত পুলিশ সাহস করেনি সরকারি দলের মাস্তানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।
পরবর্তীতে ছাত্রশিবিরের জেলা নেতাদের হস্তক্ষেপে এই ঘটনার মীমাংসা হয় এবং ছাত্রলীগ গুন্ডারা ছাত্রাবাস ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ২৪ জুলাই সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ মীমাংসিত ঘটনাকে পুনরায় চাঙ্গা করে সীতাকুণ্ড কলেজ ক্যাম্পাসে তাণ্ডব চালায়। এতে আহত হয় ৪ জন শিবিরকর্মী।
২৪ জুলাই ১৯৯৬, সেদিন ছিল ৭ রবিউল আউয়াল। নবী সা.-এর মাস রবিউল আউয়াল মাসকে স্বাগত জানিয়ে র্যালি করে ছাত্রশিবির। সেই সমাবেশেও গুলি করে ছাত্রলীগ। বেশ কয়েকজন আহত হয়। কিন্তু রক্তের নেশা মেটে না ছাত্রলীগের। সেদিন বিকেলে আলিয়া মাদরাসায় হামলা চালায় ও গুলি বর্ষণ করে ছাত্রলীগ। এবার আলিয়া মাদরাসা থেকে সাধারণ ছাত্রদের সাথে নিয়ে ছাত্রশিবির বিক্ষোভ মিছিল বের করে। ছাত্রশিবিরের দৃঢ় অবস্থানে সীতাকুণ্ড পৌর এলাকা থেকে ছাত্রলীগ পালিয়ে যায়।
২৫ জুলাই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা পুলিশের উপস্থিতিতে কলেজ ক্যাম্পাসে হামলা চালিয়ে আহত করে শিবির কর্মী হেলাল উদ্দিনসহ ৩ জনকে। শিবির নেতৃবৃন্দ ঘটনা জানিয়ে পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করলেও আওয়ামী সরকারের অশুভ ইশারায় পুলিশ উল্টো হানা দেয় সীতাকুণ্ড আলীয়া মাদরাসায়। শিবির কর্মীসহ ১৫ জন সাধারণ ছাত্রকে গ্রেফতার করে পুলিশ ষড়যন্ত্রমূলক অস্ত্র মামলায় জড়িয়ে দেয়। কিন্তু এরপরও বিষাক্ত ছাত্রলীগ সীতাকুণ্ড কলেজ থেকে ছাত্রশিবিরের ছাত্রদের বের করে দেয়ার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে পারে নি।
২৯ জুলাই ১৯৯৬। সেদিন ছিল ১২ রবিউল আউয়াল। নবী সা.-এর ওফাতের দিন। বিকেল ৪ টায় সীতাকুণ্ড কলেজের ইসলামী আন্দোলনের কর্মী মো. শাহজাহান তাঁর বন্ধু নুর হোসেনসহ কলেজসংলগ্ন রাস্তা দিয়ে রিকশায় চড়ে তাদের বাসায় যাচ্ছিলেন। ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা তাঁদের দুইজনকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যায়। সন্ধ্যার পর কলেজ সংলগ্ন মাঠে ইট, রড, লাঠি দিয়ে পিটিয়ে শাহজাহান ও নুর হোসেনের সমস্ত শরীর থেঁতলে দেয়। মারাত্মক আহত শাহজাহান পানি চাইলে খুনি দুলাল চন্দ্র দে তাঁর মুখে প্রস্রাব করে।
উপস্থিত জনগণ পুলিশকে খবর দিলেও পুলিশ আসেনি। খবর পেয়ে ছাত্রশিবিরের কর্মীরা একত্র হয়ে সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ করে। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। শাহজাহান ভাই ও নূর হোসেন ভাইকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। নূর হোসেন ভাই জীবন ফিরে পেলেও আল্লাহ তায়ালা শাহজাহান ভাইকে কবুল করে নিয়েছিলেন। অমানুষিক নির্যাতন ও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে শাহদাতবরণ করেন সীতাকুণ্ড কলেজের এইচএসসি পরিক্ষার্থী মুহাম্মদ শাহজাহান ভাই।
৩০ জুলাই চট্টগ্রাম লালদিঘীতে জানাযা ও পরে শহীদের ক্যাম্পাস সীতাকুণ্ড কলেজ মাঠে জানাজা হয়ে শহীদের মীরসরাইয়ে নিজ গ্রামে তাঁকে দাফন করা হয়।
এই ঘটনায় মামলা হয়। মামলার বাদি ছিলেন শাহজাহান ভাইয়ের চাচাতো ভাই রায়হান উদ্দিন। সরাসরি যারা খুনের সাথে জড়িত ছিল তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে মামলা করা হয়। তারা হলো, নুরুচ্ছাফা, বিজয় চক্রবর্তী, মো. শাহজাহান, রুহুল আমিন, দুলাল চন্দ্র দে, আমিনুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন, পাপন চন্দ্র দে ও আলাউদ্দিন।
তদন্ত শেষে সীতাকুণ্ড থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইফতেখার হোসেন ১৯৯৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। আসামীদের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়। আদালতের দীর্ঘসূত্রীতার সুবিধা নিয়ে বেশ কয়েকবছর জেলে থেকে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসে খুনীরা। বিচার কাজ এগিয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে।
২০১৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আওয়ামী সরকার হস্তক্ষেপ্ত করে এই মামলায়। এই মামলায় থাকা ৯ আসামীর মধ্যে ১ম সাত আসামীকে তারা নির্বাহী আদেশে মামলা থেকে অব্যাহতি প্রদান করতে চায়। এই ৭ জন খুনি এখন সীতাকুণ্ড উপজেলার আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত। বাকী দুইজন এখন আওয়ামী লীগ করে না বিধায় তাদের ব্যাপারে সরকারের কোনো বক্তব্য নেই।
২০১৩ সাল থেকে এই প্রসেস শুরু হলেও এটি কার্যকর হয় ২০২৩ সালে। ২০২৩ সালের ১৭ জুলাই বিচার বিভাগের ওপর নজিরবিহীন হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মামলা থেকে আসামীদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বলেন, ‘মামলাটি আগে চতুর্থ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন ছিল। জেলা পিপি হিসেবে আমি আসামির নাম প্রত্যাহারের আবেদন করলে আদালত তা মঞ্জুর করেন।’
এই কেমন বিচারব্যবস্থা! বাদী অভিযোগ করেছে খুনীদের বিরুদ্ধে। অথচ সরকারের ইশারায় আদালত বিচার না করে, বাদীর সাথে আলোচনা না করে, খুনের মামলার মতো স্পর্শকাতর মামলার আসামীদের কোনো প্রকার তদন্ত ছাড়াই মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে দেয়।
অব্যাহতি পাওয়া এই খুনীরা হলো, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহজাহান, সীতাকুণ্ড উপজেলা যুবলীগের সহসম্পাদক নুরুচ্ছাফা, সদস্য বিজয় চক্রবর্তী, সীতাকুণ্ড আওয়ামী লীগের সদস্য রুহুল আমিন, যুবলীগের কর্মী দুলাল চন্দ্র দে, আমিনুল ইসলাম ও আনোয়ার হোসেন।
- লেখক : ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
Discussion about this post