যেহেতু দেশের সংস্কার চলছে, তাই একটি গুরুত্বপূর্ণ আলাপ তুলতে চাই।
১। আমাদের দেশে গত এক যুগে আমরা যা দেখেছি তা হলো, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা অস্ত্রের জোরে ক্ষমতায় টিকে গিয়েছিল। প্রথমত সে পিলখানায় একটা ফেইক বিদ্রোহ তৈরি করে ভাড়াটে খুনীদের দিয়ে সেনাবাহিনীর সৎ ও ডানপন্থী অফিসারদের খুন করেছে। তারপর এইসব খুনের দায় চাপিয়ে দিয়েছে সাধারণ বিডিআর সৈনিকদের ওপর।
এরপর বাকীদের সে বিভিন্ন দুর্নীতির সুযোগ করে দিয়ে তাদের হাতে রেখেছে। পুলিশকে ব্যপক ক্ষমতা দিয়ে জবাবদিহিতার উর্ধ্বে নিয়ে গেছে। পুলিশ এত অপরাধের সাথে জড়িত হয়েছে যে, হাসিনার ক্ষমতায় থাকা পুলিশের জন্য বেশি জরুরি ছিল। পুলিশ ও সেনাবাহিনী তাদের নিজের স্বার্থেই হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখা জরুরি হয়ে গিয়েছে। তাই তারা মরণপণ লড়াই করেছে হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে। সহস্রাধিক মানুষকে খুন করেছে।
হাসিনার বিরুদ্ধে ২০১৩ সাল থেকেই বিপুল জনমত গঠন হলেও হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে নামানো যায়নি। ২০২৪ সালে হাসিনার পক্ষে জনগণের আনুমানিক মাত্র ৫ শতাংশ ছিল। ৯৫% শতাংশের বিরোধীতা থাকা সত্ত্বেও হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে নামানো যায়নি।
২। আমেরিকায় একটি বিতর্কিত বিষয়ের নাম হলো অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন। আমেরিকা এমন একটি দেশ যে দেশে জনসংখ্যার চাইতেও বেশি রয়েছে লাইসেন্সকৃত অস্ত্রের পরিমাণ। শত শত বছর ধরে আমেরিকায় এই নিয়ে বিতর্ক থাকলেও আমেরিকা এখন পর্যন্ত অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করার কথা ভাবতে পারে নি। আপনারা জানেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে আমেরিকা। এর কারণ হলো তাদের ‘চেক এন্ড ব্যালেন্স’ নীতি। চেক এন্ড ব্যালেন্সের কারণের আমেরিকা জনগণের হাতে অস্ত্র দেওয়াটাকে কঠিন করে রাখেনি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘চেক এন্ড ব্যালেন্স’ নীতি এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এর মানে হলো প্রতিষ্ঠানগুলো একটি অপরটির ক্ষমতাকে কন্ট্রোল করতে পারে। আমেরিকায় যে কারণে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না এর অন্যতম কারণ হলো ‘চেক এন্ড ব্যালেন্স’ নীতি। জনগণের কাছে যদি অস্ত্র না থাকে তবে যে কোনো সময়ই অস্ত্রধারী বাহিনীগুলো ক্যু করে ক্ষমতা দখল করবে। অথবা কোনো ফ্যাসিবাদী শাসকের দোসর হয়ে জনগণকে নির্যাতন করবে। জনগণের কাছে অস্ত্র থাকায় আমেরিকান সেনাবাহিনী আজ পর্যন্ত জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেনি। শত শত বছরে আমেরিকান পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখলের নজির নেই।
৩। এবার আপনি চিন্তা করে দেখুন, আমাদের ২০২৪ এর আগস্ট বিপ্লবের সময় যদি আমরা আমাদের নিরাপত্তার জন্য অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ থাকতো তবে তা এতদূর গড়াতো না। পুলিশ স্বৈরাচারের পক্ষ নিতে পারতো না। পুলিশ এতোটা বেপরোয়া হতো না। হাসিনা অনেক আগেই জনগণের দাবি মেনে পদত্যাগ করতে বাধ্য হতো। জনগণের সমর্থন ছাড়া কেউ ক্ষমতায় থাকতে পারতো না। বাংলাদেশে সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের মিলিত সংখ্যা হলো ৩ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিশ কোটি। বিশ কোটি মানুষের হিসেবে অস্ত্রধারী বাহিনীর সংখ্যা মাত্র ০.১৭৫ শতাংশ।
এর সাথে সরকারি আমলা, দুর্নীতিবাজ ও স্বৈরাচারের দালালদের যুক্ত করলে সর্বোচ্চ ১% হতে পারে। এই ১ % মানুষের কাছে জিম্মী হয়ে পড়েছে বাকী ৯৯% শতাংশ মানুষ। এর মূল কারণ সাধারণ মানুষের সামরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নেই। অর্থাৎ এখানে ক্ষমতার ব্যালেন্স করা হয়নি। যদি আমেরিকার মতো চেক এন্ড ব্যালেন্স থাকতো
৪। ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে একটা বিষয় গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করে আসছে, তাহলো জামায়াত দেশের প্রতিটি শিক্ষিত ও কর্মক্ষম তরুণকে (২০ বছর – ৩০ বছর) পর্যায়ক্রমে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে চায়। এতে লাভ হবে দুইটি, ১। দেশের ক্রান্তিকালে ও বহিঃশত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে দেশের জনগণকে কার্যকর জনশক্তি হিসেবে পাওয়া যাবে। ২। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ অস্ত্রধারী ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বাহিনীর কাছে জিম্মি হবে না।
৫। আমার পরামর্শ হলো আমেরিকার গাইডলাইন ফলো করে ডিসেন্ট, শিক্ষিত ও ভায়োলেন্স করার রেকর্ড নেই এমন মানুষদের নিরাপত্তার জন্য প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া উচিত। এটা যেহেতু একটু রিস্কি শুরুতেই ঢালাওভাবে না প্রয়োগ না করে ধাপে ধাপে কার্যকর করা উচিত। এই অস্ত্র নিয়ে আমেরিকায় যে প্রবলেম হয়, তা হলো কেউ কেউ মাতাল হয়ে এলোপাথাড়ি গুলি করে মানুষ খুন করে। আমাদের দেশে যেহেতু সাধারণভাবে মদ নিষিদ্ধ তাই এই সমস্যা কম হবে। তারপরও মদের বারগুলো বন্ধ করে মাতালের সংখ্যা কমিয়ে ফেলতে হবে।
- লেখক – রাজনৈতিক বিশ্লেষক
Discussion about this post