সংবিধান রক্ষা নিয়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি কথা কে বা কারা বলেছেন বা বলেন, গবেষণা হলে নাম জানা যেত। গবেষণা ছাড়াও যার যার অবস্থান থেকে তা মনে বা স্মরণ করতে পারা অসম্ভবও নয়। সেদিকে যাচ্ছি না। সংবিধান থেকে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করছি।
‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে। এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’
সংবিধান দেশ পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণের বিষয়টি পরিষ্কারভাবে নিশ্চিত করেছে। এবার আসি স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯ প্রসঙ্গে। গত কয়েকদিন দেশের মানুষের এই আইনটি সম্পর্কে কিছুটা জানার সুযোগ হয়েছে। এই আইনের ১২(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘… ফৌজদারী মামলায় অভিযোগপত্র আদালত কর্তৃক গৃহীত হইয়াছে, সেই ক্ষেত্রে সরকার, লিখিত আদেশের মাধ্যমে, ক্ষেত্রমত, মেয়র বা কোন কাউন্সিলরকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করিতে পারিবে।’
সংবিধান জনগণকে যে ক্ষমতা দিয়েছে, এই আইনে সেই ক্ষমতা অস্বীকার বা অসম্মান করার সুযোগ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ সংবিধান জনগণকে সম্মান-মর্যাদা দিয়েছে, এই আইন মানুষকে অসম্মান এবং মর্যাদাহানী করেছে। দেশের মালিক জনগণ ভোট দিয়ে তার প্রতিনিধি নির্বাচন করছেন, সেই প্রতিনিধিকে বরখাস্ত করে জনগণের সম্মান এবং মর্যাদাহানী করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত আদালতের রায় কী হবে জানি না। আদালত যে বলছেন, কেন সিটি করপোরেশনের এই আইনকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না- তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত পোষণ না করার কোনও সুযোগ নেই। আদালত ইতিমধ্যে মেয়রদের বরখাস্ত করার আদেশ স্থগিত করেছেন এবং সাময়িক বরখাস্তের আদেশ কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়েছেন। আদালতের এই জানতে চাওয়ার সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ নেই। সংবিধানকে সামনে রেখে ধীর-স্থির প্রক্রিয়ায় বিচক্ষণ পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন আদালত। বাংলাদেশের দল-মত নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষকে, তা স্বাগত জানানো দরকার। দানবীয় ক্ষমতার মার্কিন প্রেসিডেন্টকে আটকে দেয় সে দেশের আদালত। আমরা তার প্রশংসা করি। এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমাদের আদালত যখন এমন সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়, সংবিধান এবং জনগণের পাশে দাঁড়ায়, তার প্রশংসা অবশ্যই করতে, বিশেষ করে উচ্চ আদালতের কার্যক্রমকে। একজন মাননীয় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র নাথ সিনহা বিচারালয়কে শক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেওয়ার প্রচেষ্টায় ইতিমধ্যে যে অনেকখানি সফল হয়েছেন, তার প্রশংসা যেমন করতে হবে -পাশেও থাকতে হবে যার যার অবস্থান থেকে। সততা, নৈতিকতা এবং সাহস ছাড়া দানবীয় ক্ষমতার সরকারকে অপকর্ম থেকে নিবৃত্ত করা যায় না। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র সিনহার কাজ, জীবনযাপনে এই তিনটি উপাদানই দৃশ্যমান। তার এই উপাদানগুলো বিচারালয়ের অন্যান্যদের মাঝে তো বটেই, সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ুক- এটাই প্রত্যাশিত।
২.
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করার সিদ্ধান্তগুলো সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত, না কোনও মন্ত্রী বা মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব সিদ্ধান্ত, যার সঙ্গে সামগ্রিকভাবে সরকারের সম্পৃক্ততা নেই?
সিলেট-রাজশাহীর দুই মেয়র, তারপর হবিগঞ্জের মেয়রকে সাময়িক বরখাস্ত এবং আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বক্তব্যের ‘প্রধানমন্ত্রী জানেন না’র পর তেমনটাই মনে হয়েছিল। এই মনে হওয়াটা দূর হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। তিন মেয়রের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ যখন আদালত স্থগিত করে দিলেন, কেন ‘আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত নয়’ জানতে চাইলেন, তখন আরও ৫ জন মেয়রকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। এই বরখাস্তের মধ্য দিয়ে এটা বলার আর কোনও অবকাশ থাকল না যে, এটা শুধুই একজন মন্ত্রী বা একটি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত। প্রধানমন্ত্রীর না জানার বিষয়টিও আর প্রাসঙ্গিক থাকল না। প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল, যা কিছু ঘটছে, তা সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত। এবং এই সিদ্ধান্ত সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক তো বটেই, উচ্চ আদালতের যে ‘জানতে চাওয়া বা পর্যবেক্ষণ’ তার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। সংবিধান এবং আদালতের প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধা রাখার সরকারের যে মৌখিক ভাষ্য, তার সঙ্গে কৃতকর্ম সাংঘর্ষিক।
৩.
এখন পর্যন্ত বরখাস্ত করা ৮ জন মেয়রের মধ্যে ৭ জন বিএনপি-জামায়াতের। একজন রাজনৈতিক দল নয়, তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য। তিনি দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর পৌর মেয়র মুরতজা সরকার মানিক। বিএনপি-জামায়াতকে তো বটেই, সরকার যে অন্য কোনও দল বা সংগঠনের কাউকেই কোথাও স্থান দিতে চাইছে না, মুরতজা সরকারের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করলে তা বোঝা যায়।
ফুলবাড়ীতে কূখ্যাত এশিয়া এনার্জিবিরোধী যে আন্দোলন, সেই আন্দোলনের একজন স্থানীয় সংগঠক মুরতজা সরকার মানিক। সরকার এবং এশিয়া এনার্জি প্রলোভনের কাছে বিক্রি না হয়ে, জনগণের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিদানে তিনি মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। জনগণ ভোট দিয়ে তাকে নির্বাচিত করেছেন।
ফুলবাড়ী আন্দোলন এবং তার সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত এবং আওয়ামী লীগের সম্পৃক্তটা এমন-
ক. বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে এশিয়া এনার্জি বিজিআরকে দিয়ে (জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় বিডিআর বর্তমান নাম বিজিবি ) গুলি করিয়ে মানুষ হত্যা করে।
খ. ফুলবাড়ীর উত্তাল আন্দোলনের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন প্রকাশ্য জনসভায়।
গ. ২০১৪ সালে এশিয়া এনার্জির প্রধান গারি লাই ফুলবাড়ীতে যায়। তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়, এশিয়া এনার্জির অফিস ভাঙচুর হয়। এশিয়া এনার্জি মামলা করে মুরতজা সরকার মানিকসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে। এই মামলার প্রেক্ষিতেই বরখাস্ত করা হলো মানিককে।
ঘ. এশিয়া এনার্জি বাংলাদেশে যে কর্মকাণ্ড করে তা পুরোপুরি অবৈধ। বাংলাদেশের সঙ্গে এশিয়া এনার্জির আদৌ কোনও চুক্তি আছে কিনা, তা অজানা। বাংলাদেশের কয়লা সম্পদ দেখিয়ে তারা লন্ডনে শেয়ার ব্যবসা করছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে এশিয়া এনার্জির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া আওয়ামী লীগ, এখন এশিয়া এনার্জির মামলায় জনপ্রতিনিধি বরখাস্ত করছে।
৪.
মামলা, চার্জশিট আদালতে গৃহীত- কোনোটাই প্রমাণিত অপরাধ নয়। মামলা রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার উদ্দেশ্যে, পুলিশি তদন্তের চার্জশিট, গ্রহণযোগ্যতা মাত্রার চেয়ে অনেক অনেক পিছিয়ে। তার ওপর ভিত্তি করে জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা মানে, জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা। এমন নয় যে, আইনের কঠোর প্রয়োগের ধারায় চলছে দেশ। মন্ত্রীদের শাস্তির রায়ের পরও তারা মন্ত্রী থাকছেন। হত্যা মামলার আসামি পুলিশ চাকরিতে বহাল থাকছেন, পদোন্নতি পাচ্ছেন। হত্যা-ধর্ষণ মামলার আসামির মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে। ফাঁসির আসামির দণ্ড মওকুফ করে দেওয়ার ধারা অব্যাহত আছে। আর আইনের শাসনের সকল দৃষ্টান্ত এসে ভর করছে বিরোধী পক্ষের জনপ্রতিনিধিদের ওপর!
আপনাদের ধারণা ‘উন্নয়ন’র বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু জনগণ আপনাদের ভোট দিচ্ছেন না। জনগণ যেখানে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন, সেখানেই আপনাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন (নারায়ণগঞ্জের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা, উপ নির্বাচনগুলো আলোচনায় আনছি না)।
কেন জনগণ আপনাদের ‘উন্নয়ন’ এ আস্থা রাখছেন না, কেন আপনাদের বিশ্বাস করছেন না, কেন আপনাদের ভোট দিচ্ছেন না- কারণ অনুসন্ধান বা জানার চেষ্টা করছেন না। সকল রাগ বর্ষণ করছেন জনগণের ওপর। কেন জনগণ বিএনপিকে, কিছু জায়গায় জামায়াতকে ভোট দেবেন, ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন। জনগণের মনোভাব বুঝে, নিজেদের সংশোধনের চেষ্টা করছেন না। জনগণকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে, তাদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বরখাস্ত করছেন। ধারণা করছেন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিকে কাজের সুযোগ না দিলে, পরবর্তী নির্বাচনে হয়ত জনগণ আর বিরোধীদেরকে ভোট দেবেন না। এটা যে কত বড় ভুল ভাবনা, কুমিল্লার নির্বাচন থেকেও সেই শিক্ষা নিচ্ছেন না। মনিরুল হক সাক্কুকে আগের ৪ বছর কাজ করতে দেননি। তারপরও জনগণ ভোট এবারও সাক্কুকেই ভেট দিয়েছেন, আপনাদেরকে নয়।
জনগণ কেন আমাদের ভোট দেয় না, এই রাগ-ক্ষোভ থেকে, জনগণকে ভোটের অধিকার বঞ্চিত করার নীতিতে- দীর্ঘ মেয়াদে কোনও শুভ ফল আসবে না। কূ-ফল ভোগ করতে হবে।
৫.
একটি রাজনৈতিক দল যখন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তখন তাদের যে অবস্থা হয়, তাদের দ্বারা পরিচালিত সরকারের যে অবস্থা হয়- আওয়ামী লীগ সরকার তার নজীর তৈরি করছে। যার হাতে আওয়ামী লীগের মতো একটি রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছে, বিকশিত হয়েছে- সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘কারাগারের রোজনামচা’ থেকে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করে লেখা শেষ করছি।
১১ই জুন ১৯৬৬ ॥ শনিবার
এ তো ‘মৌলিক গণতন্ত্র’, এর সৃষ্টিকর্তা জনাব আইয়ুব খান। নিজকে পাকাপাকিভাবে ক্ষমতায় রাখার ব্যবস্থা। জনগণের কি প্রয়োজন এতে? মৌলিক গণতন্ত্র আছে, টাকা আছে, সরকারি কর্মচারী আছে।
৮ই জুন ১৯৬৬ ॥ বুধবার
সরকার যদি মিথ্যা কথা বলে প্রেসনোট দেয়, তবে সে সরকারের উপর মানুষের বিশ্বাস থাকতে পারে না।
৪ঠা জুন ১৯৬৬ ॥ শনিবার
খবরের কাগজ এসে গেল- দেখে আমি শিহরিয়া উঠলাম, এদেশ থেকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথ চিরদিনের জন্য এরা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছে! জাতীয় পরিষদে, ‘সরকারী গোপন তথ্য আইন সংশোধনী বিল’ আনা হয়েছে। কেউ সমালোচনামূলক যে কোনো কথা বলুন না- কেন মামলা দায়ের হবে।
৬.
বঙ্গবন্ধুর সেই সময়ের কথাগুলো এখনও অবিশ্বাস্য রকমের প্রাসঙ্গিক!
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক
Discussion about this post