গত কয়েকবছরে বৈশ্বিক লেনদেনে চীনা মুদ্রা ইউয়ান প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। ইউয়ানের ব্যবহার বাড়াতে নানানভাবে চুক্তি করছে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সরকার। নতুন স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোর আওতায়, ইউয়ান লেনদেন ছড়িয়ে পড়ছে রাশিয়া ও সৌদি আরব থেকে শুরু করে ব্রাজিল, এমনকি ফ্রান্স পর্যন্ত। বিশ্লেষণ ব্লুমবার্গের বিশ্বের আর্থিক সাম্রাজ্যের সুস্পষ্ট আধিপত্য যুক্তরাষ্ট্রের। কিন্তু আলোচিত পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থায় নিজের অংশীদারত্ব আরও বড় করার সুযোগও চীন পাচ্ছে। এমন সময়ে এ ঘটনা ঘটছে, যখন ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে, আর বিশ্ববাণিজ্য ক্রমে শক্তিধর দেশগুলোর সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নিচ্ছে।
প্রযুক্তিগত জ্ঞান, তাইওয়ান থেকে শুরু করে টিকটক-বাণিজ্য ও ভূরাজনীতির বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয়ে অর্থনৈতিক জায়ান্ট চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব বেড়েই চলেছে। এর মধ্যেই আসে ইউক্রেন যুদ্ধ। প্রতিবেশী দেশে আগ্রাসনের জন্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে দেওয়া মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আবারও প্রমাণ করেছে, ওয়াশিংটন ডলারকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারে পিছপা হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত অনেক দেশকে ইউয়ানের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। বলতে গেলে, মার্কিন কর্তৃপক্ষের কারণেই গত এক বছরে ইউয়ান যে ইতিবাচক প্রচার লাভ করেছে, তা বিগত এক দশকেও করতে পারেনি চীন।
চীনে করোনাভাইরাস সংক্রমণ দীর্ঘদিন ধরে থাকায়, সরকার কভিডের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার নীতি নিয়েছিল। এরই আওতায় লকডাউনও চলেছে। লকডাউনের সেই পর্ব থেকে বেরিয়ে এসে উন্মুক্ত হয়েছে চীনা অর্থনীতি, এতে বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অবস্থানেরও পরিবর্তন এসেছে। আগের তুলনায় দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে বেশ ধীরলয়ে, অন্যদিকে মুক্ত বাণিজ্যের বৈশ্বিক প্রচেষ্টাও পড়তির মুখে। দেশে দেশে মাথা চাড়া দিচ্ছে বাণিজ্যে সংরক্ষণবাদ। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেও চীন ইউয়ানকে ঘিরে প্রচেষ্টা জোরদার করেছে। বেইজিং আন্তর্জাতিক অর্থায়ন, বাণিজ্য ও ঋণ প্রদানে নিজ মুদ্রাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চায়।
ইউবিএস ওয়েলথ ম্যানেজমেন্টের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বৈশ্বিক বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা শাখার সহ-প্রধান অ্যাড্রিয়ান জুরেখার বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়ার বাইরে আরেকটি দুনিয়া আছে’ সেটাই প্রমাণ করতে চাইছে চীন। ‘তোমার ডলার চাই না, মূলত এই ইঙ্গিত দেয়ার মাধ্যমে তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি শক্তিশালী বার্তা দিচ্ছে’।
এ বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। ডলারের আধিপত্য নিয়ে অস্বস্তিতে থাকা কিছু দেশ ও প্রতিষ্ঠান-লেনদেনের জন্য আমেরিকা ও ইউরোপের মুদ্রার বাইরে যেতে উৎসাহী হচ্ছে।
ফলে তেল থেকে দস্তা বিবিধ পণ্য ক্রয়ে ইউয়ানে লেনদেনের চুক্তি সই নতুন মাত্রা লাভ করেছে। এতে ২০১৯ সালের পর বিশ্ব বাণিজ্য অর্থায়নে ইউয়ানের অংশীদারত্ব তিনগুণ বেড়েছে, যদিও সেটা সামগ্রিক বৈশ্বিক লেনদেনের সামান্য অংশ। তাছাড়া, ইউয়ানকে এখনও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে চীনের কর্তৃপক্ষ। কিন্তু, ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোয় পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার নাগপাশে আটকা পড়ে মস্কো; এ প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার রপ্তানি পণ্যের দাম ইউয়ানে পরিশোধের পরিমাণ শুধুমাত্র গত বছরেই ৩২ গুণ বেড়েছে।
চীনের প্রধান কর্তা হিসেবে শি জিনপিং বিদেশে তার দেশের সুনাম ও ভাবমুর্তি উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। একই সঙ্গে, সংস্কার বাস্তবায়ন ও দেশজ অর্থনৈতিক বিকাশে নজর দিয়ে ঘরও সামলাচ্ছেন। লকডাউন তুলে নেয়ার পর প্রথম বৈদেশিক সফরেই শি গেছেন চীনের প্রধান জ্বালানি সরবরাহক সৌদি আরব ও রাশিয়ায়।
এর মধ্যে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ বেইজিং এসে একাধিক নতুন বাণিজ্য চুক্তি করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি ও ইরানের বৈরিতা অবসানেও মধ্যস্ততা করেছে চীন।
অন্যদিকে, স্পাই বেলুন থেকে শুরু করে সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রেষারেষির উপলক্ষগুলো বেড়েই চলেছে।
রাশিয়াকে নাকাল করতে পশ্চিমাদের প্রচেষ্টার ফলে চীন এক মহার্ঘ সুযোগ পেয়ে যায়। ইউয়ান কীভাবে ব্যবহার করা যাবে তার উদাহরণ দেখানোর ক্ষেত্রে। একই সঙ্গে, বিশ্ববাণিজ্য ও রিজার্ভে সর্বাধিক প্রচলিত দুই মুদ্রা ডলার ও ইউরোর কব্জায় থাকার ঝুঁকিও অনেক দেশকে ইউয়ানের প্রতি আগ্রহী করেছে।
Discussion about this post