রাজনীতির যেসব স্বাভাবিক নিয়ম-নীতি, সেগুলো বরিস জনসন এত দীর্ঘ সময় ধরে উপেক্ষা করে গেছেন যে, এটা বিশ্বাস করা কঠিন, তিনি আসলে শেষ পর্যন্ত বিদায় নিতে যাচ্ছেন।
যেসব কেলেঙ্কারি অন্য যে কোন রাজনীতিককে ডুবিয়ে দিতে পারতো, এই প্রধানমন্ত্রীর ওপর যেন সেগুলোর কোন প্রভাবই পড়তো না। তিনি বার বার ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছেন।
একঘেয়ে, যান্ত্রিক রাজনীতিকদের যুগে তিনি ছিলেন রীতিমত একটা চরিত্র- তার অবিন্যস্ত সোনালি চুল এবং ক্ষ্যাপাটে ব্যক্তিত্ব দেখে যে কেউ তাকে সহজেই চিনতে পারবেন।
এর ফলে তিনি ব্রিটিশ ভোটারদের এমন এক অংশের কাছে পৌঁছাতে পেরেছিলেন, যা অন্য কোন রাজনীতিকের পক্ষে সম্ভব হয়নি। লন্ডনের মতো বাম-ঝোঁকা রাজনীতির নগরীতে তিনি কনসারভেটিভ পার্টি থেকে দুই দুই বার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ২০১৬ সালে ব্রিটেনে যে গণভোট হয়েছিল, সেখানে তিনিই ছিলেন ব্রেক্সিটপন্থীদের প্রধান নেতা।
এরপর ২০১৯ সালের নির্বাচনে তিনি যে বিপুল ভূমিধস বিজয় পান, সেটি কনসারভেটিভ পার্টির সহকর্মীদের মধ্যে তার এমন এক স্থায়ী ভাবমূর্তি তৈরি করে, যে কোন নির্বাচনে যার স্পর্শে বুঝি সহজেই জয় পাওয়া যায়।
কিন্তু এরপরই এলো করোনাভাইরাস মহামারি।
এই স্বাস্থ্য সংকট ছিল যে কোন নেতার জন্যই একটি অগ্নিপরীক্ষা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং তার সরকারের যে পতন ঘটলো, সেটা কোন নীতিগত সিদ্ধান্তের কারণে নয়। মিস্টার জনসনের নিজের চরিত্র এবং আচরণ সম্পর্কে নানা প্রশ্নই আসলে তার পতনে মূল ভূমিকা রাখে।
তিনি এবং তার দফতরের কর্মীরা ডাউনিং স্ট্রিটে নিজের সরকারি বাসভবনে যেসব পার্টির আয়োজন করেন, তারপর অভিযোগ উঠেছিল, তিনি এরকম উচ্চপদের উপযুক্ত নন।
তবে দীর্ঘ ৩৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনে এধরনের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে এটাই প্রথম নয়।
‘বিশ্বের রাজা’
আলেক্সান্ডার বরিস ডে পিফেল জনসন ছিলেন এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী বালক। তিনি শৈশবেই ঘোষণা করেছিলেন, তিনি ‘বিশ্বের রাজা’ হতে চান।
নিউইয়র্কে এক বোহেমিয়ান ইংরেজ পরিবারে তার জন্ম, তারা ছিলেন মোট ছয় ভাইবোন, তাদের মধ্যে বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতো।
ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমের এক্সমুর ন্যাশনাল পার্কে তাদের একটি পারিবারিক খামার ছিল। সেখানে বেশ শান্ত এবং মনোরম পরিবেশে শৈশব কেটেছে তার।
তার পরিবার ১৯৭০ এর দশকের শুরুর দিকে ব্রাসেলসে চলে যায়। তার বাবা স্ট্যানলি জনসন সেখানে ইউরোপীয় কমিশনে কাজ করতেন।
বরিস জনসন বেলজিয়ামের রাজধানীতে ইউরোপীয় স্কুলে যেতেন। সেখানেই তার সঙ্গে ভবিষ্যৎ স্ত্রী মারিনা হুইলারের বন্ধুত্ব হয়।
১৯৭৩ সালে যখন তার বাবা-মার বিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছিল, তখন তাকে ইংল্যান্ডে এক বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপর বরিস জনসন ইংল্যান্ডের সবচেয়ে নামকরা বেসরকারি স্কুল ইটনে যাওয়ার জন্য স্কলারশিপ পান।
মিস্টার জনসনের জীবনী লেখক এন্ড্রু গিমসনের মতে, ততদিনে তার সবচেয়ে দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।
ইটন স্কুলের হেডমাস্টার স্যার এরিক এ্যান্ডারসন তরুণ বয়সের জনসনকে বর্ণনা করেছেন “প্রাণোচ্ছ্বল এবং মজার, কিন্তু একই সঙ্গে ক্ষ্যাপাটে” বলে।
স্কুলে তার ক্লাসিকসের শিক্ষক ছিলেন মার্টিন হ্যামন্ড। ১৯৮২ সালে তিনি বরিস জনসনের বাবার কাছে একটি চিঠি লেখেন, যেটি উদ্ধৃত করেছেন জীবনী লেখক গিমসন।
“বরিসকে যখন দায়িত্ব পালনে মারাত্মক ব্যর্থতার জন্য সমালোচনা করা হতো, তিনি বেশ অপমানিত বোধ করতেন,” মিস্টার হ্যামন্ড নাকি ১৭ বছর বয়সী জনসনের বিষয়ে এরকম কথা লিখেছেন এই চিঠিতে।
‘অক্সফোর্ড ড্রিংকিং ক্লাব’
ইটন স্কুল শেষ করে মিস্টার জনসন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে যান ক্লাসিকস পড়তে।
সেখানে তিনি বিখ্যাত ডিবেটিং সোসাইটি অক্সফোর্ড ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হন। এই ডিবেটিং সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮২৩ সালে। একই সঙ্গে তিনি কুখ্যাত বুলিংডন ড্রিংকিং ক্লাবেরও সদস্য ছিলেন।
বরিস জনসন তার সহপাঠী এবং খণ্ডকালীন মডেল অ্যালেগ্রা মোস্টিন-ওয়েনকে এক রাজকীয় বাড়িতে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে বিয়ে করেন।
এ্যান্ড্রু গিমসনের মতে, মিস্টার জনসন এই অনুষ্ঠানে হাজির হন ভুল পোশাকে এবং তার বিয়ের আংটি পাওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যেই সেটি হারিয়ে ফেলেন। তাদের এই বিয়ে টিকেছিল তিন বছরেরও কম।
অক্সফোর্ড থেকে পাশ করে বেরিয়ে বরিস জনসন সাংবাদিকতা শুরু করেন। তিনি ছিলেন লন্ডনের দ্য টাইমসের রিপোর্টার। কিন্তু একটি রিপোর্টে কাল্পনিক বানানো উদ্ধৃতি ব্যবহার করে তিনি তার চাকুরি হারান। পরবর্তী জীবনে তিনি এটিকে তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল বলে বর্ণনা করেছিলেন।
তবে এটি তার জীবনে সেরকম বড় কোন ছন্দপতন ঘটাতে পারেনি। এরপর তাকে দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফে নিয়ে আসেন এই পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক স্যার ম্যাক্স হেস্টিংস।
বরিস জনসন ছিলেন টেলিগ্রাফের ব্রাসেলস সংবাদদাতা। মিস্টার জনসন ইউরোপীয় কমিশনের নানা নিয়ম কানুনকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে অনেক রিপোর্ট পাঠাতেন। তবে তার সহযোগী অনেক রিপোর্টারের মতে, তার রিপোর্টে অনেক অতিরঞ্জন থাকতো, কিছু কিছু রিপোর্ট ছিল একেবারেই অসত্য।
১৯৯৯ সালে বরিস জনসন দক্ষিণ-পন্থী সাময়িকী স্পেকটেটরের সম্পাদক হন। এর দুবছর পর তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। অক্সফোর্ডশায়ারের একটি আসন হেনলি থেকে তিনি এমপি নির্বাচিত হন, যেটি কনসারভেটিভ পার্টির বেশ নিরাপদ একটি সংসদীয় আসন।
ততদিনে তিনি ব্রাসেলসে তার শৈশবের বান্ধবী মারিনা হুইলারকে বিয়ে করেছেন, যেটি তার দ্বিতীয় বিবাহ। মারিনা হুইলার পেশায় এক সফল ব্যারিস্টার।
তাদের প্রথম সন্তান লারা লেটিসের জন্ম হয় ১৯৯৩ সালে। এরপর পরপর তারা আরও তিনটি সন্তান নেন: মাইলো আর্থার, কাসিয়া পিচেস এবং থিওডোর অ্যাপোলো।
বরিস জনসন কনসারভেটিভ পার্টির তৎকালীন নেতা মাইকেল হাওয়ার্ডের ছায়া মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি যে একটি গোপন প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছেন, সে বিষয়ে সত্য কথা না বলায় তাকে বরখাস্ত করা হয়।
তবে এক বছর পরেই তাকে আবার কনসারভেটিভ পার্টির নতুন নেতা ডেভিড ক্যামেরনের ছায়া মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে আনা হয়। তারা ইটন স্কুল এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সময় থেকে বন্ধু ছিলেন।
বরিস জনসন স্পেকটেটর পত্রিকার সম্পাদক পদ থেকে সরে দাঁড়ান। টেলিভিশনে তিনি বেশ পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। বিবিসির কমেডি শো ‘হ্যাভ আই গট নিউজ ফর ইউ’র প্যানেলে তাকে নিয়মিতই দেখা যেত।
তার অভিজাত, এলেবেলে ব্যক্তিত্ব দর্শকরা বেশ পছন্দ করতো। তবে নিজেকে নিয়ে তিনি যতই ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করুন, তিনি বরাবরই বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন।
সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতিতে
রাজনীতিতে তার উপরে ওঠার সুযোগ তৈরি হয় ২০০৭ সালে। মিস্টার জনসন লন্ডনের মেয়র পদে নির্বাচনের জন্য কনসারভেটিভ পার্টির প্রার্থী হওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন।
বহু মানুষকে অবাক করে দিয়ে তিনি লন্ডনের মেয়র নির্বাচিত হন। তার ভোটের ব্যবধান ছিল দশ লাখের বেশি। চার বছর পর তিনি দ্বিতীয় মেয়াদের জন্যও লন্ডনের মেয়র হন।
মেয়র হিসেবে তিনি লন্ডনে তিনি ভাড়ায় সাইকেল চালানোর ব্যবস্থা চালু করেন, যা লন্ডনে ‘বরিস বাইক’ বল পরিচিতি পায়। ২০১২ সালে লন্ডনে যে অলিম্পিক গেমস হয়েছিল, মেয়র হিসেবে সেটির তদারকির দায়িত্বও পান তিনি।
লন্ডনের মেয়রের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বরিস জনসন লন্ডনের একটি আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। পার্লামেন্টের পেছনের সারিতে বছর-খানেক চুপচাপ সময় কাটানোর পর বরিস জনসন ঘোষণা করেন যে, তিনি ব্রেক্সিট গণভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে প্রচারণা চালাবেন।
এটি ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের জন্য বেশ বড় ধাক্কা। তিনি আশা করেছিলেন, বরিস জনসনের তারকা খ্যাতিকে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নে থেকে যাওয়ার পক্ষে কাজে লাগাবেন, কারণ সব ধরনের ভোটারের কাছে পৌঁছানোর একটা ক্ষমতা আছে তার।
ব্রেক্সিট গণভোটের সময় মিস্টার জনসন তার প্রচারণার সমস্ত দক্ষতাকেই ব্যবহার করেন। যদিও তিনি এই প্রচারণায় এরকম একটি মিথ্যে এবং বিভ্রান্তিকর দাবি করেছিলেন যে, যুক্তরাজ্য সরকার প্রতি সপ্তাহে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ৪৪ কোটি ডলার দেয়। এর জন্য তিনি তীব্রভাবে সমালোচিত হন।
ডেভিড ক্যামেরন যখন ব্রেক্সিট গণভোটের পর পদত্যাগ করেন, তখন বরিস জনসন কনসারভেটিভ পার্টির নেতা হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালান। এরপর তিনি রাজনৈতিক জীবনের ইতি টানবেন বলে ভাবছিলেন।
কিন্তু এরপর অনেক পর্যবেক্ষককে বিস্মিত করে নতুন প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে বরিস জনসনকে তার মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে তার সময়ে মিস্টার জনসন রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটি কঠোর অবস্থান গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। সাবেক এক রুশ গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপলের ওপর বিষ প্রয়োগের ঘটনার পর তিনি ২৩ জন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেন।
ইরানে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে প্রায় ছয় বছর বন্দী এক ব্রিটিশ নাগরিক নাজানিন যাগাহারি র্যাটক্লিফ সম্পর্কে করা এক মন্তব্যের কারণে তিনি সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। মিস্টার জনসন ভুল করে তার সম্পর্কে বলেছিলেন, তিনি সেখানে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছিলেন।
২০১৮ সালে বরিস জনসন টেরিজা মে’র মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন ব্রেক্সিট ইস্যুতে। তিনি বলেছিলেন, ব্রেক্সিট নিয়ে যে চুক্তি টেরিজা মে করতে চাইছিলেন, সেটাতে খুব বেশি ছাড় দেয়া হচ্ছিল।
মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের পর বরিস জনসন টেলিগ্রাফ পত্রিকায় তার আগের উচ্চ বেতনের চাকুরিতে ফেরত আসেন। তবে সেখানে ফিরেই তিনি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। তিনি বোরকাধারী মুসলিম নারীদের দেখতে ‘ডাকবাক্সের’ মতো মন্তব্য করার পর এটিকে ‘ইসলাম বিদ্বেষী’ কথা বলে তীব্র সমালোচনা হয়।
বরিস জনসন পার্লামেন্টের পেছনের সারিতে থাকলেও প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে’র সবচেয়ে কঠোর সমালোচনায় সরব থাকেন। টেরিজা মে পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার পর বরিস জনসন আবার দলের নেতা হওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এবার তিনি সফল হন।
তবে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর শুরুর কয়েক মাস তাকে বেশ প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। কারণ পার্লামেন্টে ক্ষমতাসীন দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল একেবারের সামান্য।
তার ব্রেক্সিট কৌশল আটকে দেয়ার জন্য যেসব এমপি কাজ করছিল, তাদের সঙ্গে তাকে রীতিমত গেরিলা লড়াই চালাতে হয়। এরকম এমপিদের মধ্যে দলের বেশ উচ্চপর্যায়ের সুপরিচিত কিছু নেতাও ছিলেন।
এরপর বরিস জনসন বেশ দুঃসাহসিক এবং বিতর্কিত এক পদক্ষেপের মাধ্যমে পার্লামেন্ট স্থগিত রাখার চেষ্টা করেন। তিনি এটি করতে চেয়েছিলেন ২০১৯ সালের ৩১শে অক্টোবরের মধ্যে যুক্তরাজ্য যেন কোন চুক্তির অধীনে বা চুক্তি ছাড়াই ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যেতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতে। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট তার এই কাজকে বেআইনি বলে রায় দেয়।
এরপর ২০১৯ সালে বরিস জনসন একটি সাধারণ নির্বাচন ডাকেন। তিনি এই নির্বাচনে ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে প্রচারণা চালান। এটিতে বেশ ভালো ফল হয়, তার দল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসে। ১৯৮০র দশকে মার্গারেট থ্যাচার যখন তার সাফল্যের চূড়ায়, তারপর কনসারভেটিভ পার্টি পার্লামেন্টে আর এত বড় ব্যবধানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি।
বরিস জনসনের সরকারের ব্রেক্সিট চুক্তি ২০২০ সালের ৩১শে জানুয়ারি পাশ হয় এবং যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ইইউ থেকে বেরিয়ে যায়।
কোভিড মহামারি
২০২০ সালের শুরুতে মনে হচ্ছিল, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একটি নতুন বাণিজ্য চুক্তি করাই হবে বরিস জনসনের সরকারের প্রধান কাজ। ব্রেক্সিটের কারণেই তার সরকারকে মনে রাখবে মানুষ। কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বাকি বিশ্বের আর সব নেতার মতো কোভিড মহামারিতে আচ্ছন্ন হয়ে গেলেন তিনি।
এই মহামারি মোকাবেলায় ব্রিটিশ সরকার একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। স্বাস্থ্যকর্মীদের কোন ধরণে সুরক্ষা সরঞ্জাম ছিল না, এবং যুক্তরাজ্যের বয়স্কদের নিবাসগুলোতে ব্যাপকভাবে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।
২০২০ সালের এপ্রিল মাসেই বরিস জনসনের করোনাভাইরাস ধরা পড়ে এবং তিন রাত তাকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে কাটাতে হয়।
শুরুতে ডাউনিং স্ট্রিট থেকে বলা হচ্ছিল তার অসুস্থতা অতটা গুরুতর নয়। কিন্তু যখন হাসপাতাল থেকে তাকে ছাড়া হলো, তখন মিস্টার জনসন স্বীকার করেন, “তার অবস্থা যে কোন দিকেই যেতে পারতো।”
তিন সপ্তাহেরও মত সময় পরে তার বান্ধবী কেরি সিমন্ডস তাদের প্রথম সন্তানের জন্ম দেন, যার নাম রাখা হয় উইলফ্রেড। তারা দুজন ২০২০ সালের মে মাসে ওয়েস্টমিনিস্টার ক্যাথেড্রালে গোপনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিয়ে করেন।
মিস্টার জনসন তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলতে সবসময় অনিচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু তার সন্তান সংখ্যা সাত বলে মনে করা হয়। এর মধ্যে দুজন বর্তমান স্ত্রী কেরি সিমন্ডসের সঙ্গে। সাবেক স্ত্রী মারিনা হুইলারের সঙ্গে আছে চার সন্তান এবং আর্ট কনসালট্যান্ট হেলেন ম্যাকিনটায়ারের সঙ্গে এক সন্তান।
একের পর এক কেলেংকারি
কোভিড মহামারির বিশ মাসের মধ্যে যুক্তরাজ্যের চেহারা একেবারেই বদলে গিয়েছিল। অন্য অনেক পশ্চিমা দেশের তুলনায় যুক্তরাজ্যে কোভিডে মৃত্যুর হার ছিল অনেক বেশি। তবে টিকা তৈরি এবং টিকাদানের ক্ষেত্রে ছিল এগিয়ে। বরিস জনসন গর্ব করতে পারেন যে অমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট যখন বেশ ছড়িয়ে পড়ছে, তার মধ্যেও তিনি ব্রিটিশ অর্থনীতি সচল রাখতে পেরেছেন। কিন্তু নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছিল।
তার সাবেক ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা ডোমিনিক কামিংস যখন ডাউনিং স্ট্রিট ত্যাগ করতে বাধ্য হন, তারপর ২০২১ সালের মে মাসে তিনি একটি পার্লামেন্টারি সিলেক্ট কমিটির সামনে এক সাংঘাতিক তথ্য ফাঁস করেন। তিনি দাবি করেন যে, মিস্টার জনসন বৈজ্ঞানিকদের পরামর্শ উপেক্ষা করে লকডাউন জারি করতে দেরি করেন, এর ফলে ব্রিটেনে হাজার হাজার মানুষ অহেতুক মৃত্যুর শিকার হয়েছেন কোভিড মহামারিতে। মিস্টার কামিংস দাবি করেন, তার সাবেক বস প্রধানমন্ত্রী পদের উপযুক্ত নন।
নামী ডিজাইনারকে দিয়ে ডাউনিং স্ট্রিটের ফ্ল্যাটের এক বিলাসবহুল সজ্জার জন্যও বরিস জনসন সমালোচিত হন, এজন্যে তার বিরুদ্ধে তদন্ত হয়। কনসারভেটিভ পার্টির সমর্থক একজনের দানের অর্থে এর খরচ শোধ করা হয়।
তবে এই অভিযোগ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে শেষ পর্যন্ত রেহাই দেন তারই নিয়োগ করা নৈতিকতা বিষয়ক এক উপদেষ্টা। তবে এই উপদেষ্টা বলেছিলেন, মিস্টার জনসন তার ভূমিকার প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা দেখাননি।
এরপর বরিস জনসনের বিরুদ্ধে একের পর এক কেলেঙ্কারি এবং স্বজন তোষণের অভিযোগ উঠতে থাকে। একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যেরকম উচ্চ নৈতিক আচরণ আশা করা হয়, সেটির কোন তোয়াক্কা তিনি করছেন না বলে অভিযোগ উঠতে থাকে।
মিস্টার জনসনের এক মিত্র ওয়েন প্যাটারসনের বিরুদ্ধে উঠেছিল, তিনি তদবিরের যেসব নিয়মকানুন, সেগুলো ভঙ্গ করেছেন। বরিস জনসন যখন তাকে রক্ষার জন্য এমপিদের নৈতিক কোড কী হওয়া উচিৎ, সেটিই বদলে ফেলতে চাইলেন, তখন তার ভাবমূর্তি আরও ক্ষুণ্ণ হলো। মিস্টার জনসন পরে স্বীকার করেছিলেন, তার এই কাজটা একদম ভুল ছিল।
কিন্তু ২০২১ সালের নভেম্বরে আরও খারাপ অবস্থা তৈরি হলো যখন ডাউনিং স্ট্রিটে নিয়ম ভেঙ্গে আয়োজন করা পার্টিগুলোর কথা প্রথম ফাঁস হতে শুরু করলো। লন্ডনে যখন লকডাউনের কারণে এধরণের সমাগম একদম নিষিদ্ধ ছিল, তখন এসব পার্টি আয়োজন করা হয়েছিল। ডেইলি মেইল পত্রিকা এসব পার্টির খবর ফাঁস করতে থাকে।
এ সপ্তাহ পর আরও মারাত্মক ঘটনা ফাঁস হলো যখন একটি ভিডিওতে দেখা গেল ডাউনিং স্ট্রীটের স্টাফরা ক্রিসমাস পার্টির আয়োজন করা নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করছে।
সরকারের একজন উপদেষ্টা অ্যালেগ্রা স্ট্যাটন এই ভিডিওতে রসিকতা করে বলছিলেন, “এটি কোন পার্টি ছিল না, এখানে কেবল চিজ আর ওয়াইন ছিল।” কিন্তু এই উপদেষ্টাকে পরে একথা বলার জন্য অশ্রুসিক্ত চোখে ডাউনিং স্ট্রিট থেকে বিদায় নিতে হয়।
মিস্টার জনসন পরে এমপিদের বলেছিলেন, এই ভিডিও ক্লিপের ব্যাপারে তিনি বেশ ক্ষিপ্ত এবং এ নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এই তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল যার ওপর, সেই সাইমন কেইস নিজেও পদত্যাগে বাধ্য হন, কারণ তিনিও নিজের অফিসে একই ধরণের পার্টির আয়োজন করেন বলে খবর ফাঁস হয়।
মিস্টার জনসনও পরে স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, তিনি ডাউনিং স্ট্রিটে এমন এক পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন, যেখানে সবাইকে মদ নিয়ে আসতে বলা হয়েছিল। এটি ঘটেছিল প্রথম কোভিড লকডাউনের বিধিনিষেধের মধ্যে। মিস্টার জনসন দাবি করেন যে, তিনি ভেবেছিলেন এই পার্টিটি ছিল অফিসেরই একটি অনুষ্ঠান।
পদত্যাগের জন্য চাপ
এরপর ফাঁস হওয়া আরও কিছু মারাত্মক ঘটনা তার সরকারকে কাঁপিয়ে দেয়। দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ফাঁস হওয়া খবরে বলা হয়, যেদিন রানির প্রয়াত স্বামী ডিউক অব এডিনবারার শেষকৃত্যানুষ্ঠান ছিল, তার আগের রাতেও ডাউনিং স্ট্রীটে মদের পার্টি চলেছে। এই শেষকৃত্যানুষ্ঠানের সময় রানিকে কোভিড বিধিনিষেধ মেনে একা বসে থাকতে হয়েছিল।
বরিস জনসন তার ডাউনিং স্ট্রিটের স্টাফদের এই আচরণের জন্য পরে রানির কাছে ক্ষমা চান।
ডাউনিং স্ট্রিটে ২০২০ সাল হতে যে ১৬টি এরকম পার্টি হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে একজন আমলা সু গ্রে যে রিপোর্ট দেন, তাতে তিনি বলেছিলেন, এগুলোর কোন কোনটি মোটেই আয়োজন করা উচিৎ ছিল না।
তিনি আরও বলেছিলেন, এসব ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে, এখানে সরকারের দিক থেকে নেতৃত্বের ব্যর্থতা ছিল।
তবে এসময় মন্ত্রিসভার সদস্যরা মিস্টার জনসনকে একযোগে সমর্থন জানায়। তবে তাদের সবাই যে সমান উৎসাহে কাজটি করেছেন তা নয়।
এদিকে এসব ঘটনার মধ্যে জনমত জরিপে বরিস জনসন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এই প্রথম লেবার পার্টি এগিয়ে যায়। এরপর শুরু হয়ে ডাউনিং স্ট্রীটে লকডাউন বিধি ভেঙ্গে আয়োজিত পার্টিগুলোর ব্যাপারে মেট্রোপলিটন পুলিশের তদন্ত।
মোট ১২টি ঘটনার তদন্ত শেষে পুলিশ ৮৩ জনের বিরুদ্ধে মোট ১২৬টি জরিমানার নোটিশ জারি করে। এদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং তার স্ত্রীও ছিলেন।
এরপর এসব ঘটনার ব্যাপারে সরকারি আমলা সু গ্রের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত রিপোর্টও প্রকাশ করা হয়। ডাউনিং স্ট্রিটে কিরকম মদ্যপ পার্টির সংস্কৃতি চালু ছিল, এই রিপোর্টে তা প্রকাশ পায়। এসব পার্টির আয়োজন করা হচ্ছিল, এমন এক সময়, যখন বাকী দেশে সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হচ্ছিল।
এই তদন্ত রিপোর্ট এবং এরপর গণমাধ্যমে ফাঁস হওয়া আরও খবরে প্রধানমন্ত্রীর অনেক বিব্রতকর ছবি দেখা যায়, যেগুলোতে প্রধানমন্ত্রী ডাউনিং স্ট্রীটে তার স্টাফদের সঙ্গে মদ পান করছেন।
নিজেদের ভোটারদের দিক থেকে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হয়ে বিদ্রোহী কনসারভেটিভ এমপিরা এরপর ঘটনাপ্রবাহ তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারা নিজ দলের ভেতরে বরিস জনসনের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন।
মিস্টার জনসন এই অনাস্থা ভোটে উৎরে যান, কিন্তু এরপরই তিনি এক নতুন বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন এমপি ক্রিস পিনচারকে ডেপুটি চীফ হুইপ নিয়োগ করা নিয়ে। একাধিক যৌন হামলার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।
ক্রিস পিনচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে অবহিত থাকার পরও বরিস জনসন যে তাকে ডেপুটি চীফ হুইপ নিয়োগ করেছিলেন, সেজন্যে তাকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়। প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করেন যে, এই অভিযোগ সম্পর্কে তাকে ২০১৯ সালেই জানানো হয়েছিল- এবং কোন পদক্ষেপ না নিয়ে তিনি একটা বাজে ভুল করেছেন।
এ ঘটনার পর কনসারভেটিভ পার্টিতে পদত্যাগের হিড়িক পড়ে, চ্যান্সেলর ঋষি সুনাক এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভিদের পদত্যাগ দিয়ে যার শুরু।
এই দুজনের পদত্যাগের একদিন পর আরও ডজন ডজন মন্ত্রী পদত্যাগ করেন, এবং মিস্টার জনসন শেষ পর্যন্ত হার স্বীকার করতে রাজি হন, এবং সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।
রাজনীতির সব প্রচলিত নিয়ম-কানুন বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বরিস জনসনের চার দশকের যে উত্তাল রাজনৈতিক জীবন, শেষ পর্যন্ত তা মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়লো।
কিন্তু তিনি যে আবারও ফিরে আসবেন না, সেই সম্ভাবনা কি এখনই উড়িয়ে দেয়া যাবে?
সূত্র: সাউথ এশিয়া মনিটর
Discussion about this post