রাজধানীতে গত এক মাসে দুটি একে ২২ রাইফেল উদ্ধার করা হয়েছে। অত্যাধুনিক এই আগ্নেয়াস্ত্র এতদিন জঙ্গিরা ব্যবহার করে বলেই জানা যেত। এমনকি হলি আর্টিজানে হামলায় অংশ নেওয়া জঙ্গিদের হাতে ছিল এই রাইফেল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের মুখে চাপের মধ্যে থাকা জঙ্গিদের এই মুহূর্তে এই ধরনের দামি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের সম্ভাবনা কম বলেই মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।
তাহলে সন্ত্রাসীরা কেন এই ভারী অস্ত্র সংগ্রহ করছে? সন্ত্রাসীরা তো এতদিন ক্ষুদ্রাস্ত্র ব্যবহার করেছে। কেনই-বা তাদের ভারী অস্ত্রের দরকার পড়ল? কী কাজে তারা ব্যবহার করবে এই অত্যাধুনিক অস্ত্র। কোথা থেকেই-বা আসছে এই অস্ত্র? এসব প্রশ্নের কূল-কিনারা করতে পারছেন দায়িত্বশীলরা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মাহবুব আলম বলেন, ‘খিলগাঁও থেকে আমরা যে একে ২২ রাইফেল, রিভলবার ও পিস্তল উদ্ধার করেছি, সেটা একেবারেই সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার করার জন্যই আনা হয়েছিল। আমরা যে তিনজনকে গ্রেফতার করেছি তারা পেশাদার সন্ত্রাসী। এদের সঙ্গে জঙ্গিদের কোনো সম্পর্ক নেই। এরা একটা কিলিং মিশনে ব্যবহার করা জন্য এই অস্ত্র সংগ্রহ করেছিল। অস্ত্রগুলো এরা যার কাছ থেকে কিনেছে সেই ব্যক্তিকে গ্রেফতারের চেষ্টা করা হচ্ছে। তাকে পাওয়া গেলে অস্ত্রের উত্স জানা যাবে।’
জঙ্গিদের কাছে পাওয়া একে ২২ রাইফেল ও এই একে ২২ রাইফেল কি একই ধরনের—জানতে চাইলে মাহবুব আলম বলেন, ‘আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, এগুলো একই ধরনের অস্ত্র।’
গত ৩০ জুন রাজধানীর ওয়ারীর ওয়ান্ডারল্যান্ডের সামনে থেকে একটি অত্যাধুনিক একে ২২ রাইফেল উদ্ধার করে সিটিটিসির স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ। ঐ ঘটনায় পুলিশ দুজনকে গ্রেফতার করে। তারা অস্ত্রের বাহক মাত্র। সম্প্রতি শ্যামপুর এলাকা থেকে একসঙ্গে ছয়টি অত্যাধুনিক ও বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ১২৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় তিন জনকে গ্রেফতার করে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা কেউ অস্ত্রের মালিক নয়। তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় অস্ত্র পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেছে। মিরপুর থেকে তারা অস্ত্রগুলো যার নির্দেশে শ্যামপুর নিয়েছিল এবং যার কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিল, পুলিশ তাদের শনাক্তের পর গ্রেফতারের চেষ্টা করছে।
অস্ত্র উদ্ধারের সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন কর্মকর্তা জানান, ওয়ারীতে একে ২২ রাইফেল উদ্ধারের ঘটনায় বাবুল ও সাদেক নামে দুই জনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, গত ছয় মাসে আরো তিনটি একে ২২ অটোম্যাটিক রাইফেল হাত বদল হয়েছে। কাদের মাধ্যমে কীভাবে সেটা হয়েছে তারা বলতে পারেনি।
এর আগে গত মার্চ মাসে একটি ডাকাত চক্রের ১২ সদস্যকে গ্রেফতারের পর তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য দিয়ে রামপুরায় অভিযান চালানো হয়। ঐ অভিযানে হাফিজ ও মামুনুর রশিদ নামে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী—বাংলাদেশ (হুজিবি) এর দুই সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে গোয়েন্দা পুলিশ একটি অত্যাধুনিক একে ২২ রাইফেল, পাইপগান ও গুলি উদ্ধার করে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান বেকারিতে যে একে ২২ রাইফেল ব্যবহার করেছিল জঙ্গিরা, পুরান ঢাকা ও খিলগাঁও থেকে উদ্ধার হওয়া অস্ত্র একই। এছাড়া ওই বছরের ২৬ জুলাই কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানাতেও অভিযানের পর পুলিশ কর্মকর্তারা জানতে পারেন, একটি একে ২২ অটোম্যাটিক রাইফেল নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল এক জঙ্গি। যদিও সেই অস্ত্রটি পরে আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
একে ২২ অটোম্যাটিক রাইফেলগুলো প্রায় একই ধরনের। এই রাইফেল থেকে ব্যবহারকারী চাইলে একটি গুলি করতে পারেন। আবার তিনি চাইলে একসঙ্গে ৩০ রাউন্ড গুলিও বের হয়। ডাকাতি বা চাঁদাবাজির কাজে সাধারণ অপরাধীদের এসব অস্ত্র ব্যবহার করার কথা নয়। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একে ২২ রাইফেলগুলো সাধারণত পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। পাহাড়ের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর হাতেও এসব অস্ত্র হরহামেশাই দেখা যায়। সম্প্রতি উদ্ধার হওয়া অস্ত্রে উত্স খুঁজতে গিয়ে এমন তথ্যই মিলছে।
খিলগাঁও থেকে একে ২২ রাইফেল উদ্ধারের সঙ্গে গ্রেফতার হওয়া তিন সন্ত্রাসী পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার করেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, টেন্ডার নিয়ে বিরোধের কারণে দক্ষিণ যুবলীগের এক শীর্ষ নেতাকে হত্যার মিশনে এই অস্ত্র সংগ্রহ করেছিল তারা। এই ধরনের মিশনে সাধারণত ক্ষুদ্রাস্ত্র ব্যবহার হয়, তাহলে এত ভারী অস্ত্র কেন? গ্রেফতার সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা মনে করছেন, মূলত হাতবদলের সময় সাম্প্রতিক সময়ে অস্ত্রগুলো ধরা পড়েছে। ভাড়াটে খুনে ব্যবহার কিংবা আসন্ন কোরবানির ঈদে পশুরহাটের দখল ও চাঁদাবাজির কাজে ব্যবহারের জন্য অস্ত্রগুলোর আনা হতে পারে। তবে এর পেছনে কারা জড়িত সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। উদ্ধার করা অস্ত্রগুলোর উত্স ও গন্তব্য নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
সূত্র: ইত্তেফাক