শর্মিলা ঠাকুর
সদ্য বিবাহিত আয়েশা ও জয়নালের নির্বিবাদ সংসারী জীবনের ছেদ কেটে তাতে রাজনৈতিক দুনিয়ার প্রবেশ ঘটার প্রথম আলামত জাপানি বিমান ছিনতাইয়ের উল্লেখ। এই উল্লেখের মাধ্যমেই আমরা প্রথম ‘আয়েশা’ নামক টেলিফিল্মের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্বন্ধে ধারণা পাই। ১৯৭৭ সালের ১ অক্টোবর ‘জাপানিজ রেড আর্মি’ নামক সশস্ত্র বামপন্থী সংগঠন ফ্রান্স থেকে জাপানগামী একটি বিমান ছিনতাই করে নিয়ে আসে ঢাকায়।
একই দিনে ঢাকায় সংগঠিত হয় বিমান বাহিনীর সৈনিকদের একটি বিদ্রোহ। এই সমস্ত সাল তারিখের উল্লেখ নাই আয়েশা সিনেমায়। বিমান বাহিনীর একজন কর্পোরাল জয়নাল। তার ভাষ্যমতে সে বিদ্রোহীদের হাত থেকে ‘চিফ’কে বাঁচিয়েছে। রাতের খাবার খেতে খেতে সামরিক বাহিনীতে জাসদের তৎপরতা, চিফের জীবন বাঁচানো ইত্যাদি নিয়ে জয়নালের বর্ণনা আর তার নিরাপত্তা নিয়ে স্ত্রী আয়েশার উদ্বেগ প্রকাশের মধ্য দিয়েই আবহমান বাঙলার সংসার ধরণের একটা কিছুর মধ্যে প্রবেশ ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সময়। আয়েশা টেলিফিল্মের মূল কাহিনির শুরু এইখানেই।
কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের ‘আয়েশামঙ্গল’ উপন্যাস অবলম্বনেই তৈরি হয়েছে এই ঈদের বিশেষ টেলিফিল্ম। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর পরিচালনায় ‘আয়েশা’ টেলিছবিতে নাম চরিত্রে অভিনয় করেছে নুসরাত ইমরোজ তিশা। আর নির্মান করেছেন মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী।
মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নিঃসন্দেহে বর্তমান সময়ের অন্যতম প্রতিভাবান নির্মাতা, যাকে নিয়ে আমাদের চলচ্চিত্র অঙ্গনে রয়েছে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা। দেশ-বিদেশের অনেক নামকরা সমালোচকও তার নাটক-চলচ্চিত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন বিভিন্ন সময়। সেই সাথে তার কাজের সমালোচনাও রয়েছে প্রচুর। তবে চড়ুইভাতি, ওয়েটিং রুম, স্পার্টাকাস ৭১ এর মতো টেলিফিল্ম কিংবা ৪২০, ৫১বর্তী বা সিক্সটি নাইন এর মতো সিরিয়াল নির্মাণের জন্য তিনি দর্শকনন্দিত হয়েছেন বরাবরই।
ফারুকীর আয়েশা নাটকটি নির্মিত হয়েছে আনিসুল হকের আয়েশামঙ্গল উপন্যাসের কাহিনী অবলম্বনে। নাটকটি আশির দশকের এক অস্থির সময়ের গল্প। এর শুরু হয় খুবই সাদামাটাভাবে। বিমানবাহিনীর কর্পোরাল জয়নাল (চঞ্চল চৌধুরী) এবং তার স্ত্রী আয়েশা (তিশা) নতুন সংসার শুরু করে। ছোট ছোট খুনসুঁটির মধ্য দিয়েই তাদের মধ্যকার সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। আয়েশার ভাষায়, তাদের শেকড়ের মধ্যে যোগাযোগ সৃষ্টি হতে থাকে, যার অন্য নাম ভালোবাসা।
কিন্তু এর মধ্যেই একদিন এক ঝড়ের মতো সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যায়। জাসদের অনুপ্রবেশকারীরা আক্রমণ করে বসে ক্যান্টনমেন্টে এবং এয়ারপোর্টে। চিফের সাথে অবস্থান করা জয়নাল চিফের জীবন রক্ষা করে, কিন্তু তারপরেও ভুল বোঝাবুঝির ফলে সে পড়ে যায় সন্দেভাজনদের তালিকায়। তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তার মুখ থেকে এমন তথ্য বের করার জন্য শুরু হয় তার উপর চরম নির্যাতন, যে তথ্য তার জানা নেই।
চঞ্চল চৌধুরী, বিমান বাহিনীর কর্পোরাল জয়নাল আবেদীনের চরিত্রে অভিনয় করে।
গ্রাম থেকে নতুন শহরে আসা আয়েশার সাজানো সংসার ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। প্রতিদিন সে ধর্না দিতে থাকে বিমান বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে। তার একটাই অনুরোধ, তার নির্দোষ সহজ-সরল স্বামীকে যেন তার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। সে তার স্বামীর চাকরি ফেরত চায় না, শুধু স্বামীর জীবন ফেরত চায়। স্বামীকে ফেরত পেলে সে তাকে নিয়ে সব ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাবে, তবুও যেন তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তা সম্ভব না হলেও যেন অন্তত তার উপর নির্যাতন না করা হয়, অন্তত একবার যেন তার সাথে তার স্বামীর সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।
কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র অত্যন্ত নিষ্ঠুর। আয়েশার চোখের পানি আর কাকুতি-মিনতির কোনো মূল্য তার কাছে নেই। নিজের স্বার্থে নিজের নাগরিকদের সাথেই নির্মম আচরণ করতে পিছপা হয় না সে। নাটকের আয়েশা চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করা নুসরাত ইমরোজ তিশার অভিনয় দেখে দর্শকের চোখের কোণে অশ্রু জমা হতে বাধ্য। এই নাটকে যেন ফারুকী বাস্তবতাকেই প্রকাশ করতে চেয়েছেন, আয়েশারা যখন গুম হয়ে যাওয়া কিংবা আইন বহির্ভূতভাবে গ্রেপ্তার হওয়া স্বজনদের মুক্তির দাবিতে চোখের পানি বিসর্জন দেয়, তখন সে আবেগ রাষ্ট্রকে যে বিন্দুমাত্র নাড়া দিতে পারে না।
নুশরাত ইমরোজ তিশা, যেকোন চরিত্রই যিনি ফুটিয়ে তুলতে পারেন একদম যথাযথভাবে
আনিসুল হকের আয়েশামঙ্গল উপন্যাসটি সত্তরের দশকের পটভূমিতে নির্মিত, ফারুকীর আয়েশা নাটকটির শুরুতেও ১৯৭৭ সালের কথাই বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের কাহিনীর নির্দিষ্ট কোনো কাল থাকে না। এগুলো সকল কালের, সকল যুগের জন্য সমান সত্য। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় না, তবে ইতিহাস কখনো কখনো একই সুরে বাজে পুনরায়। তেমনি এক সময়ের গল্পওতো অন্য সময়ের সুরে বাজতে পারে যদি সেই সময়ে একই অন্যায় বিরাজ করে। প্রিয়জন হারানোর আর্তনাদ সাতাত্তরেও যেমন, এখনও তেমনি। ফলে এই গল্প এখনকারও, এমনকি আগামীরও যদি একই আর্তনাদ সমাজে বিরাজমান থাকে।
ইতিহাসের সকল পর্যায়েই আয়েশাদের নির্দোষ স্বজনরা নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়, গুম হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। আর আয়েশাদের জীবন কেটে যায় তাদের মুক্তির আশায়, কখনো কখনো তাদের লাশের সন্ধানে। আর নাটকে শেষপর্যন্ত আয়েশাকে বিমানবাহিনীর কর্মকর্তার উদ্দেশ্যে কাঁদতে কাঁদতে আক্ষেপ করে বলতে হয়: জীবিত মানুষটারে দেখতে দিলেন না, মৃত মানুষটারেও দেখতে দিলেন না। এখন কবরটা কই আছে সেইটাও কইতেছেন না স্যার। আমরা কি কবর জেয়ারতও করতে পারমু না? এইটা কোন বিচার গো স্যার?
আয়েশা টেলিফিল্মের একটি দৃশ্যে তিশা
আজ গুম দিবস। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী ২০০৯ সাল থেকে এই পর্যন্ত গুম হয়েছেন ৪৩২ জন মানুষ। দেশে কিংবা বিদেশে, বর্তমানে কিংবা ‘৭৭ সালের ইতিহাসে, যখন আমরা কোনো গুম হওয়ার সংবাদ শুনি, গ্রেপ্তার অথবা মৃত্যুর সংবাদ শুনি, তখন তা শুধু কিছু নাম এবং সংখ্যা হিসেবেই আমাদের মনের পাশ দিয়ে সামান্য দাগ কেটে চলে যায়। কিন্তু ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর সদস্যদের আর্তনাদ, তাদের আবেগ-অনুভূতিগুলো আমরা অনুভব করতে পারি না। সেগুলো আমাদের সামনে উপস্থাপন করার দায়িত্ব শিল্পী এবং সৃজনশীল নির্মাতাদের। আয়েশা নাটকের মধ্য দিয়ে ফারুকী, চঞ্চল, তিশা এবং অন্যান্য কলাকুশলীরা সমাজের প্রতি তাদের এ দায়বদ্ধতা কিছুটা হলেও পরিশোধ করতে পেরেছেন। এদিক থেকে আয়েশা নাটকটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হিসেবে দীর্ঘদিন পর্যন্ত স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
নাটকটির সর্বশেষ দৃশ্য আমাকে বেশ আলোড়িত করেছে। ভাবছি আর অনুভব করার চেষ্টা করছি গুম হওয়া মানুষগুলোর প্রিয়জনদের অনুভূতি। শেষ দৃশ্যে দেখা যায় আয়েশা যখন তার স্বামীর কবর কোথায় তা জানতে পারলো না তখন সে একটি স্থানে নৌকা থেকে নেমে স্বামীর জন্য দোয়া করতে থাকে। পাশে থাকা তার দুলাভাই বলার চেষ্টা করলো এখানে মনে হয় জামাইয়ের কবর নেই। তখন আয়েশা বললো, আমি তো জানিনা আমার স্বামীর কবর কই। তাই আমার কাছে এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল পুরোটাই আমার স্বামীর কবর।