মুসাফির রাফি
মানুষকে বোকা বানানো কত সহজ। অন্তত আমাদের দেশের সরকার তো তাই মনে করে। গত ১২ মে থেকে মাদক বিরোধী অভিযান শুরু করেছে সরকার। আর আসামী ধরলেই তাদেরকে নিয়ে গল্প বানায় সরকার। যেমন আসামীকে নিয়ে মাদক উদ্ধার অভিযানে গিয়েছিল, সেখানে আসামীর অন্যন্য সহকর্মীরা আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর হামলা চালায় তারপর বন্দুকযুদ্ধে সেই আসামী মারা যায়। একই গল্প শুনেই যাচ্ছি আমরা দিনের পর দিন। মাদক ব্যবসায়ী তো হঠাৎ করে জন্ম নেয়নি। হঠাৎ তাদেরকে নিয়ে এত উদ্ধার অভিযান একই সাথে কেনইবা শুরু হলো আর গোটা দেশে একই সাথে বন্দুকযুদ্ধের সিলসিলা চালু হলো- এটা না বোঝার মত বোকা মনে হয় জনগন নয়। ১২ মে থেকে শুরু হয়ে ২৯ মে পর্যন্ত কথিত বন্দুকযুদ্ধে এই পর্যন্ত ১৩০ জন নিহত হলো। অবিশ্বাস্য। এত বড় জুলুম মেনে নেয়া সত্যিই কঠিন।
প্রকারান্তরে গতকাল বুধবার গনভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নগ্নভাবে বিচারবহির্ভুত এইসব হত্যাকান্ডকে সমর্থন করায় পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে বলে বিশ্লেষকরা আশংকা করছেন। যদিও তিনি বলছেন নিরীহ কাউকে হত্যা করা হয়নি কিন্তু অভিযানের শুরু থেকেই নিহত বেশ কয়েকজনের পরিবার জানিয়েছে তাদের পরিবারের যে সদস্যকে মাদক ব্যবসায়ী চিত্রিত করে হত্যা করা হয়েছে সে মুলত ছাত্রদল বা যুবদলের সক্রিয় কর্মী। কিন্তু গতকালের সংবাদ সম্মেলনে কোন সাংবাদিকই প্রধানমন্ত্রীকে এই বিষয়ে কোন প্রশ্ন করেননি। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সরাসরি দাবী করেছেন মাদক বিরোধী অভিযানে ক্রস ফায়ারের কোন ঘটনাই নাকি ঘটেনি। যা ঘটেছে সবই বন্দুকযুদ্ধ। মানুষ হত্যা নিয়ে এই ধরনের পরিহাস কবে বন্ধ হবে কে জানে।
এই হত্যাকাণ্ডগুলোর ব্যপারে আইনশৃংখলা বাহিনী যতই গতানুগতিক বক্তব্য দিক না কেন তা যাচাই করার কোন সুযোগ আসলে নেই। তারা আইনের রক্ষক হলেও এক্ষেত্রে আইন ভংগ করার অভিযোগও তাদেরই বিরুদ্ধে। আর অভিযোগ নিষ্পত্তিরও কেউ নেই। পুলিশই অভিযুক্ত আবার তারাই বিচারক, তারাই সাক্ষী। আইনের চিরায়ত দাবী হলো কারও বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকলে তাকে আদালতে হাজির করা হবে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিও নিজের স্বপক্ষে বক্তব্য তুলে ধরার সুযোগ পাবেন। কিন্তু ভিকটিম পরিবারগুলো অধিকাংশই দাবী করছে তাদের নিহত স্বজনদেরকে এই ধরনের কোন সুযোগ দেয়া হয়নি। বরং পরিবারগুলো দাবী করছে পোশাকধারী এবং সাদা পোশাকধারী আইনশৃংখলা বাহিনীর লোকেরা এসে হত্যার দিন দুয়েক আগে তাদের আপনজনদেরকে তুলে নিয়ে গেলেও আদালতে হাজির করেনি। আর হঠাৎ করেই পরিবারগুলো জানতে পারে যে, সেই আপনজন ব্যক্তিটিকে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হয়েছে।
অভিযোগ এসেছে বিরোধী দলের নেতাকর্মীকে মাদক ব্যবসায়ী বানিয়ে হত্যা করার। আবার কক্সবাজারের পৌর কাউন্সিলর একরামের মত কয়েকজনকে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে হত্যারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। কক্সবাজার দিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় মাদকের চালান প্রবেশ করে। এটা মোটামুটি ওপেন সিক্রেট যে, কক্সবাজারের সরকারী দলীয় সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদিই এই মাদক চালানের মুল হোতা। অথচ বদিকে রাখা হয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর জানা গেছে, নিহত পৌর কাউন্সিলর একরাম বদির অপকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ায় এমপি সাহেব নিজে তাকে কৌশলে আইন শৃংখলা বাহিনীকে দিয়ে তাকে হত্যা করেছেন, পথের কাঁটা সরিয়ে দিয়েছেন। এই ঘটনাটা চলমান মাদক বিরোধী অভিযানকে পরিহাসের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। বিরোধী দলগুলো দাবী করছে সরকারকে রক্ত নেশায় পেয়েছে। আর তারা বিরোধী নেতাকর্মীদেরকে এই অভিযানের আড়ালে বিনা বিচারে হত্যা করছে।
এমনও তথ্য পাওয়া গেছে যে, কোন আসামীকে আটক করার পর তার পরিবারের কাছে স্থানীয় থানা পুলিশ বড় অংকের টাকা দাবী করেছে। টাকা না দিলে মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে আটক ব্যক্তিকে হত্যা করার হুমকি দিয়েছে। পরিবারগুলো যারা পারছে যে কোনভাবে টাকা জোগাড় করছে আর যারা পারছেনা তাদেরকে বন্দুকযুদ্ধের মত অশুভ পরিনতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে।
প্রথমদিকে সমাজের কিছু কিছু মানুষ এই অভিযানকে স্বাগত জানালেও দিন যত যাচ্ছে তত বেশী এই অভিযানের কুৎসিত রূপটি মানুষের সামনে ধরা পড়ছে। কেননা এখন এটা সবাই বুঝতে পারছে যে সরকার মাদক নিধনে আন্তরিক নয়। দু-চারটা তথাকথিত মাদক ব্যবসায়ীকে হত্যা করলেও মাদকের গুদাম, মাদকের ব্যবসা এবং মাদকের সোর্স বন্ধে সরকার তেমন কিছুই করেনি। আর মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিনা বিচারে এই সব হত্যার তীব্র বিরোধীতা করছে। তারা বলছে দেশের আইন শৃংখলা ও বিচার পদ্ধতি ভেংগে পড়েছে পুরোটাই। তাই আইন শৃংখলা বাহিনী কোন ধরনের জবাবদিহিতার তোয়াক্কা না কনে বিচারবহির্ভুত হত্যাকান্ডের মত দু:সাহস প্রতিদিন করে যাচ্ছে। আর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যে এই ধরনের আইন বহির্ভুত হত্যাকান্ডে তাদেরকে সমর্থন দেয়ার জন্য অন্যায়কারীরা বার বার এই অপকর্মটি করতে পারছে। সরকারের মন্ত্রীদের নগ্ন সমর্থন থাকায় মানবাধিকার কমিশনও বিষয়টা নিয়ে প্রত্যাশা অনুযায়ী উচ্চবাচ্য করছেনা। এমনকি বিচার বিভাগের মুল অভিভাবক অর্থাৎ বিচারপতিরাও স্বপ্রনোদিত হয়ে সরকারকে এই বিচারবহির্ভুত হত্যা বন্ধ করার জন্য কোন আদেশ দিতে পারছেননা।
মানবাধিকার কর্মীরা পরিস্কারভাবেই বলছেন, সরকার ভুল ও অন্যায় কৌশল গ্রহন করেছে। এভাবে কখনোই মাদক দমন সম্ভব নয়। যদি মাদক ব্যবসায়ীদেরকে হত্যা করে সরকার সমস্যার সমাধান করতে চায় তাহলে একটা সময় তারা হয়তো মাদক নিচ্ছে এই অভিযোগ তুলে হাজার হাজার সাধারন নাগরিককেও হত্যা করতে দ্বিধা করবেনা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলছেন, এই অভিযানে সরকার আন্তরিক তা জনগন বিশ্বাস করতে পারছেনা কেননা সরকার মাদকের গডফাদারদেরকে কিছুই বলছেনা।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রেজাউল হক কথিত মাদক ব্যবসায়ীদেরকে ক্রসফায়ারে হত্যা করার তীব্র নিন্দা জানান। তিনি বলেন, যদি নিহত ব্যক্তিরা আসলেই দোষী হয় তাহলে আইনী সকল সুযোগ পাওয়ার অধিকার তার রয়েছে। তিনি বলেন বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড বন্ধে সরকারকে আমরা বেশ কয়েক দফা চিঠিও দিয়েছি। তাছাড়া মানুষ হত্যা করে কখনো মাদকের প্রয়োগ ও ব্যবহার বন্ধ করা যায়না। তিনি বিচারবহির্ভুত হত্যাকান্ডে জড়িত পুলিশদেরকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসারও দাবী জানান।
সাবেক পুলিশ আইজি নুরুল হুদাও বর্তমান বন্দুকযুদ্ধ কৌশলকে পুলিশের ভুল বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, পুলিশের উচিত মাদক ব্যবসায়ী, তাদের আশ্রয়দাতা এবং অর্থলগ্নিকারীদের তালিকা করা এবং তাদেরকে সামগ্রিকভাবে দমন করার চেষ্টা করা। এক্ষেত্রে মাদক নেটওয়ার্কটিকে ভুন্ডুল করে দেয়ার উপর তিনি বেশী গুরুত্ব দেন।
সার্বিকভাবে একটা বিষয় বেশ পরিস্কারভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে সচেতন মহলও বুঝতে পারছেন যে সরকার আসলে মাদক বন্ধের জন্য নয়। বরং রক্তের নেশায় বিভোর হয়ে তারা সাধারন মানুষ বিশেষ করে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদেরকে শায়েস্তা করার জন্য এবং নির্বাচনের আগে দেশজুড়ে একটি ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করতেই এই তথাকথিত মাদক বিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে।