ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে সোমবার গাজায় অন্তত ৫২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। পবিত্র জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস খোলাকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ দমনে ইসরায়েলি সেনারা গুলি চালায়।
২০১৪ সালে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর ভয়াবহ হামলার পর সেখানে এত বেশি হতাহতের ঘটনা আর ঘটেনি।
বিবিসি গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে বলছে, নিহত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শিশুও রয়েছে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ২০০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি আহত হন।
সোমবার ওই দূতাবাস উদ্বোধন করা হয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়ে ইভানকা ট্রাম্প ও তাঁর স্বামী জেরার্ড কুশনার উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে ভিডিও বার্তা পাঠান ট্রাম্প।
এ পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের ঠেকাতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীরা ওই সেনাসদস্যদের লক্ষ্য করে পাথর ও আগুনবোমা ছোড়েন। ইসরায়েলি বাহিনী গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে পাল্টা জবাব দেয়। এতে ওই হতাহতের ঘটনা ঘটে।
ট্রাম্প প্রশাসন তেল আবিব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস জেরুজালেমে সরিয়ে আনল। ফিলিস্তিনিরা মনে করে, এই দূতাবাস খোলার অর্থ পুরো জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ নিতে ইসরায়েলকে ওয়াশিংটনের স্বীকৃতি দেওয়া। এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে ফিলিস্তিনিরা।
গাজার ক্ষমতায় থাকা কট্টরপন্থী সংগঠন হামাস ছয় সপ্তাহ ধরে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ চালিয়ে আসছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রায় ৪০ হাজার ফিলিস্তিনি বিক্ষোভ করছেন। তাঁরা ‘সহিংস দাঙ্গা’ শুরু করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে সেনাবাহিনী। ফিলিস্তিনিরা গাজা-ইসরায়েল সীমান্তে ১৩টি স্থানে নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে ফেলে কাছের ইহুদি পরিবারগুলোর ওপর আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করে।
এদিকে দূতাবাস উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পাঠানো ভিডিও বার্তা ট্রাম্প বলেন, ‘ইসরায়েল একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। নিজের রাজধানী নির্ধারণ করার অধিকার তার আছে। কিন্তু বহুদিন আমরা এই সুস্পষ্ট বিষয়টির স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়েছি।’
মার্কিন নতুন দূতাবাসের সামনেও ফিলিস্তিনি পতাকা হাতে বিক্ষোভ করেছে ফিলিস্তিনিরা। এই সময় ইসরায়েলি পুলিশ বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে আটক করে নিয়ে যায়।
ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলি দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তর করবেন। গত ৬ ডিসেম্বরে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন ট্রাম্প। এই ঘোষণার পর ফিলিস্তিনিরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বিশ্বজুড়ে ট্রাম্পের ঘোষণার সমালোচনা শুরু হয়। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে ট্রাম্পের স্বীকৃতি প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভোটাভুটি হয়। তাতে ট্রাম্পের ঘোষণা প্রত্যাখ্যাত হয়। ভোটাভুটিতে ১২৮ সদস্য ট্রাম্পের ঘোষণা প্রত্যাহারের পক্ষে ভোট দেয়। বিপক্ষে ভোট দেয় মাত্র নয়টি দেশ। ৩৫টি দেশ ভোট দানে বিরত থাকে। তারপরও নিজের নীতিতে অনড় থেকে জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তর করলেন ট্রাম্প।
এই জেরুজালেম মুসলিম, খ্রিষ্টান ও ইহুদি—সবার কাছেই পবিত্র বলে বিবেচিত। শত শত বছর ধরে জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ নিতে স্থানীয় বাসিন্দা, আঞ্চলিক শক্তি ও আক্রমণকারীরা লড়াই করেছে। এর মধ্যে ছিল মিসরীয়, ব্যাবিলনীয়, রোমান, মুসলিম, ক্রুসেডার, অটোমান, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো। সর্বশেষ এই পবিত্র ভূমি দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছে দখলদার ইসরায়েল।
১৯১৭ সালে ‘বেলফোর ঘোষণার’ পর যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ইসরায়েল। ওই বছরই আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডসহ বেশ কিছু আরবভূমি দখল করে নেয় ইসরায়েল। এরপর ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ফিলিস্তিনের প্রায় পুরোটাই ও মিসরে সিনাইয়ের কিছু ভূমিও দখল করে ইসরায়েল। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য যে সীমানা বরাদ্দ রেখেছিল, বর্তমানে তার অর্ধেকও ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণে নেই। পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিদের হটিয়ে তাদের জমির ওপর প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ইহুদিবসতি গড়ে তুলেছে দখলদার ইসরায়েল।
সূত্র: প্রথম আলো