অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থার ইতিহাস গুপ্ত হত্যার ইতিহাস। যারা মোসাদের ইতিহাস জানেন, ট্র্যাক রেকর্ড জানেন, তারাও বিষয়টা সম্বন্ধে অবগত। বিষয়টা কিছুটা আড়ালে থাকলেও সম্প্রতি আবারও সামনে চলে আসে যখন মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে একজন ফিলিস্তিনি অধ্যাপক ও স্থানীয় ইমামকে প্রকাশ্য দিবালোকে আততায়ীরা গুলি করে হত্যা করে।
অতি সম্প্রতি মোসাদের গুপ্ত হত্যা বিষয়ক আল জাজিরার একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৩৫ বছরের ফিলিস্তিনি প্রকৌশলী ফাতিহ আল বাতস তার জন্মভুমি গাজাতেই ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়াশোনা করেছেন এবং একই বিষয়ের উপর পিএইচডি করার জন্য তিনি মালয়েশিয়ায় গমন করেছিলেন। তিনি পাওয়ার সিস্টেম এবং বিদ্যুতের অপচয় রোধ করার বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ন আর্টিকেলও লিখেছেন যা প্রসিদ্ধ কিছু জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী আন্দোলন হামাস প্রকৌশলী ফাতিহকে নিজেদের সক্রিয় কর্মী হিসেবে দাবী করে এই হত্যাকান্ডের জন্য মোসাদকে দায়ী করেছে। মিডিয়ার সাথে কথা বলার সময় ফাতিহ’র পিতাও মোসাদের দিকে আঙুল তাক করেছেন এবং এই ঘটনার তদন্ত করে খুনীদেরকে সনাক্ত করার জন্য মালয়েশিয়ার সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
ইসরাইলের অপরাধ বিষয়ক সাংবাদিক রনেন বার্গম্যান বলেছেন, “ফাতিহকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার ধরনটা অতীতের মোসাদের বেশ কয়েকটি গুপ্ত হত্যার ধরনের সাথে অনেকটাই মিলে যায়। খুনীরা এই হত্যাকান্ডটি ঘটানোর জন্য মোটর সাইকেল ব্যবহার করেছে। মোসাদ আততায়ীরা এর আগেও নানা হত্যাকান্ডে এরকম মোটর সাইকেল ব্যবহার করেছে। আর ইসরাইলের ভুখন্ডের বাইরে এই ধরনের হত্যাকান্ড চালানো মোসাদের জন্য নতুন কিছু নয়।”
যেভাবে টার্গেট ব্যক্তিকে সনাক্ত করা হয়
যে কোন ব্যক্তিকে হত্যা করার আগে মোসাদ তার ব্যপারে অনেকগুলো প্রক্রিয়ায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে। মোসাদের সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যেই এই পর্যালোচনা করার মত সুযোগ ও জনশক্তি রয়েছে। অনেক সময়ে ইসরাইল তার সামরিক ব্যক্তিদেরকেও ঘটনাস্থলে পাঠায় যাতে তারা সঠিক ব্যক্তিকে চিনে নিতে পারে। তাছাড়া এই ধরনের কাজ করার জন্য গোটা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ইসরাইলের গুপ্তচরও নিয়োগ করা আছে। ফাতিহ আল বাতস যেহেতু হামাসের কর্মী তাই হামাসের সাথেও তার যোগাযোগ থাকা অস্বাভাবিক নয়। আর সেই যোগাযোগের সুত্র ধরেও তাকে সনাক্ত করতে পারে মোসাদ। উল্লেখ্য গাজা, তুরস্ক বা বৈরুতে থাকা হামাস নেতারা নিজেদের মধ্যে যে যোগাযোগ করে তা সহজেই মোসাদ সনাক্ত করতে পারে।
হত্যার প্রক্রিয়া
যখনই আল বাতসের মত ব্যক্তিদেরকে টার্গেট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে যায়, তখন মোসাদ পরের ধাপের কাজগুলো শুরু করে। তারা নিজেদের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে আলোচনা করে যে এই টার্গেট ব্যক্তিকে নিয়ে তারা কি করবে? তাকে কি হত্যা করা হবে? কিভাবে হত্যা করা হবে? হত্যা করে কতটা ফায়দা হবে ইত্যাদি।
যখন মোসাদের বিশেষজ্ঞ টিম এই কাজটি সম্পন্ন করে তারা তাদের সেই প্রতিবেদন মোসাদের সদর দফতরে পাঠিয়ে দেয়। মোসাদ প্রধান নিজেই সেই প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করেন এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত দেন যদিও এই সব সিদ্ধান্তের কোন বৈধ বা আইনগত অনুমোদন থাকেনা। শেষ পর্যন্ত ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নিজে অপারেশনটি পরিচালনার চুড়ান্ত ফায়সালা করেন।
তবে ভবিষ্যত রাজনৈতিক বা আইনী জটিলতা থেকে বাঁচবার জন্য ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নিজে এককভাবে সিদ্ধান্ত না দিয়ে তার আরও দু একজন সহকর্মীর সাথে আলাপ আলোচনা করেই সিদ্ধান্তটি চুড়ান্ত করেন। সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হওয়া মাত্রই মোসাদ তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা শুরু করে। অনেক সময় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সপ্তাহ, মাস এমনকি বছরও লেগে যায়।
কায়েসারা ইউনিট
কায়েসারা হলো মোসাদের একটি গুপ্ত শাখা যারা আরব বিশ্বসহ গোটা পৃথিবীতে গুপ্তচর নিয়োগ দেয়। এই শাখাটি ১৯৭০ সালের গোড়ার দিকে শুরু হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ইসরাইলের নামকরা গুপ্তচর মাইক হারারি।
আরব বিশ্বের প্রতিটি কোনায় কায়েসারা ইউনিটের কার্যক্রম রয়েছে যারা তাদের টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের ব্যপারে তথ্য সংগ্রহ করে।
হারারি কায়েসারা ইউনিটের অধীনে একটি আততায়ী শাখাও চালু করেন যার নাম কিডন। কিডন হলো হিব্রু শব্দ যার অর্থ হলো বেয়োনেট। এই কিডনের আওতায় বেশ কিছু পেশাদার খুনী আছে যারা গুপ্ত হত্যা এবং স্যাবোটেজ অপারেশন পরিচালনা করতে সক্ষম। ইসরাইলের সামরিক বাহিনী এবং স্পেশাল ফোর্স থেকেই কিডন ইউনিটে লোক নেয়া হয়।
মোসাদ যে শুধু ফিলিস্তিনি নেতাকর্মীকেই হত্যা করে তাই নয়। সংস্থার প্রয়োজনে তারা সিরিয়া, লেবানিজ, ইরানী এমনকি ইউরোপীয় নাগরিককেও হত্যা করতে দ্বিধা করেনা।
কিলিং অপারেশন
কায়েসারা ইউনিটকে আমেরিকার সিআইএ’র সাথে তুলনা করা যায়। ২০০০ সালে ফিলিস্তিনে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা সংগঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই কায়েসারা ইউনিটের মাধ্যমে ইসরাইল ৫০০টি গুপ্ত হত্যার অপারেশন পরিচালনা করে যাতে ১ হাজারেরও বেশী লোক নিহত হয়। এর মধ্যে টার্গেট করা ব্যক্তি যেমন আছে আবার তেমনি সাধারন পথচারীর সংখ্যাও একেবারে কম নয়।
দ্বিতীয় ইন্তিফাদা চলার সময় ইসরাইল আরো ১ হাজারটি অপারেশন পরিচালনা করে যার মধ্যে ১৬৮টি সফল হয়। আর এরপর থেকে আজ অবধি গাজা উপত্যকা এবং পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় হামাস নেতাকর্মীদেরকে হত্যা করার জন্য ইসরাইল আরো ৮শটি অপারেশন পরিচালনা করেছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়।
আরব আর মোসাদের যোগসূত্র
মোসাদের সাথে ঐতিহাসিকভাবেই বেশ কিছু আরব গোয়েন্দা সংস্থার যোগাযোগ রয়েছে। বিশেষ করে জর্ডান এবং মরক্কোর গোয়েন্দা সংস্থার সাথে তাদের কাজের অংশীদারিত্বও রয়েছে। বর্তমানে গালফ অঞ্চলের দেশ এবং মিশরের সাথেও মোসাদ তাদের সম্পর্ক জোরদার করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে মোসাদ যে কাজগুলো পরিচালনা করে তা নিয়ন্ত্রন করার জন্য জর্ডানের রাজধানী আম্মানে মোসাদ দীর্ঘদিন ধরে পৃথক একটি কার্যালয়ও পরিচালনা করছে।
১৯৯৭ সালে যখন হামাস নেতা খালিদ মিশালকে হত্যার জন্য মোসাদ উদ্যেগ নিয়েছিল, তারপর কিছু দিনের জন্য তৎকালীন জর্ডান বাদশাহ হোসেন মোসাদের আম্মানস্থ শাখাটিকে বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং মোসাদের সাথে জর্ডানের গোয়েন্দা সংস্থার সংযোগটুকুও বিচ্ছিন্ন করেছিলেন। তবে বাদশাহ হোসেনের ইন্তেকালের কিছুদিন পর তা আবার চালু হয়।
আর মরক্কোর সাথে মোসাদের সম্পর্ক শুরু হয় ১৯৬০ সাল থেকে। সেই সম্পর্কের জেরেই মরক্কো এরই মধ্যে ইসরাইল থেকে বিপুল পরিমান সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তাও পেয়েছে। মরক্কোর সাবেক বাদশাহ হাসান মরক্কোতে থাকা ইহুদীদেরকে ইসরাইলে অভিবাসন করারও সুযোগ দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে মরক্কোর রাজধানী রাবাতে মোসাদের কার্যালয় চালু করারও অনুমতি দিয়েছিলেন তিনি। এরই অংশ হিসেবে রাবাতে ১৯৬৫ সালে আরব লীগের যে সম্মেলন হয়েছিল তার সম্মেলন কক্ষে এবং ব্যক্তিগত রুমগুলোতে মোসাদ আড়ি পাতার এবং গুপ্তচর নিয়োগ করারও সুযোগ পেয়েছিলো।