হাসান রূহী
আজ থেকে ৪ দিন আগের কথা। দ্বিতীয় শেণিতে পড়ুয়া সেঁজুতিকে নিয়ে দেশের প্রায় সকল পত্রিকা খবর ছেপেছে। বাহারি সব চিত্তাকর্ষক শিরোনাম করেছে। মনের মাধুরি মিশিয়ে লিখেছে প্রতিবেদন। সেঁজুতি একটি চিঠি পেয়েছিল। যেমন তেমন কারো কাছ থেকে আসনি সেই চিঠি। চিঠি এসেছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নিকট থেকে। গ্রামের এক ছোট্ট বালিকার চিঠির উত্তরে প্রধানমন্ত্রী চিঠি লিখে পাঠিয়েছেন, এটা ছোট কোন ব্যাপার নয়। এর আগেও জাতিসংঘে সফরের সময় শীর্ষেন্দু নামক এক বালকের চিঠির জবাব দিয়ে মিডিয়াপাড়া ব্যস্ত করে তুলেছিলেন। নিন্দুকেরা বলেছিল জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের সময় হল রুম ফাঁকা হয়ে যাওয়ার খবর আড়াল করতেই মিডিয়াকে এ খবর দিয়ে ব্যস্ত রাখা হয়েছিল।
সে যাই হোক। প্রধানমন্ত্রীকে লেখা সেঁজুতির চিঠি থেকে জানা যায়, কিছুদিন আগে তার দাদু মারা যায়। দাদুকে হারিয়ে ভীষণ মন খারাপ তার। কিন্তু সেঁজুতি হারানো দাদুকে খুঁজে পায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাঝে। কারণ তার দাদুর নাক নাকি শেখ হাসিনার নাকের মতই ছিল। তাকে টিভিতে দেখলেই নাকি সেঁজুতির তার দাদুর কথা মনে পড়ে।
সেঁজুতির এই চিঠির জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উত্তরে লিখেছেন- ‘তোমার লেখা চিঠি পেয়েছি। আমার স্নেহ ও শুভেচ্ছা গ্রহণ কর। আশা করি তুমি বাবা, মা এবং বন্ধুদের নিয়ে খুব ভাল আছো। তোমার চিঠিটি আমি কয়েকবার পড়েছি। তোমার দাদুর জন্য দোয়া করেছি। তোমার দাদুকে মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন বেহেশত নসিব করুন। তুমি মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করবে এবং স্কুলে যাবে। বাবা-মার কথা শুনবে এবং বড় হয়ে দেশের সেবা করবে। তোমার জন্য আমার একটা ছবি পাঠালাম। অনেক অনেক দোয়া আর আদর রইল।’
সেঁজুতি এই চিঠি লিখেছিল ২৫ মার্চ ২০১৮ তারিখে। আর প্রধানমন্ত্রী তার চিঠিটি লিখেছিলেন ১২ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে। যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর চিঠি, সেহেতু এটি সেঁজুতির কাছে ১-২ দিনের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু হঠাৎ করেই প্রধানমন্ত্রী লন্ডেনে থাকাকালে ২৩ এপ্রিল কেন সব মিডিয়ায় সিন্ডিকেট নিউজ হলো? নিন্দুকেরা বলবে লন্ডনে প্রবাসী বাঙালীদের প্রতিবাদের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে নাজেহাল হয়েছেন তা থেকে মিডিয়াকে ব্যবহার করে জনগণের দৃষ্টি ভিন্নদিকে নিতেই এই নাটকের অবতারণা করা হয়েছে। যেভাবে হঠাৎ করেই তোলা হয়েছে তারেক রহমানের পাসপোর্ট ও নাগরিকত্ব বিতর্ক।
নিন্দুকেরা যাই বলুক, তাতে কিছু যায় আসে না। আসুন দেখে নেয়া যাক মুদ্রার অপর দিকের চিত্র। কথিত যুদ্ধাপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডের শিকার জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর স্ত্রী আয়েশা খন্দকার গত ২৬ এপ্রিল ফেসবুকে তিনটি ছবি পোস্ট করেছেন। ছবিগুলো তার পুত্র ব্যারিস্টার আরমানের কন্যা বুশরার। ব্যারিস্টার আরমান তার পিতার মামলার আইনজীবি ছিলেন। তাকে তার পিতার মামলার রায় কার্যকর হওয়ার আগেই নিজ বাসা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেই থেকে আজও পর্যন্ত তার সন্ধান মেলেনি। ব্যারিস্টার আরমানের মা আয়েশা খন্দকার লিখেছেন – ‘ওদের আব্বুকে এ দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জোর করে নিয়ে গেছে আজ ২০ মাস। ১বছর ৮ মাস। ওদের স্মৃতির অনেকটা জুড়েই বাবাকে ধাক্কা মেরে মেরে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটাও ছোট্ট চোখের মনি জুড়ে রয়েছে।
প্রথম শুধু এটুকুই বলতোঃ আব্বুকে দুষ্ট লোকেরা নিয়ে গেছে। কি বুঝতো কে জানে? আর কোন কান্নাকাটি বা তেমন কিছু করতো না। দিন যাচ্ছে ওদের অন্তরে বাবার তৃষ্ণা আস্তে আস্তে বাড়ছে। ছোট্টা প্রায়ই অসুস্থ থাকে। আর অসুস্থ হলেই বলবেঃ আব্বুকে ফোন কর আব্বুকে ফোন কর। বড়টা আগে বলতো আব্বু আমাদের পার্কে নিয়ে যেত দাদু। সেই বাসার দিক দিয়ে কোথাও যেতে থাকলে বলবেঃ এখানে না আব্বুর বাসা?
এখন দু’বোন মিলে অপেক্ষা করে কখন আম্মু ফোন টা রেখে কোন দিকে যায়। ব্যাস ফোন নিয়ে পালিয়ে দু’বোন আব্বুর নাম্বারে কল দিতে থাকে। কিন্তু ছোট্ট মনের হৃদয় নিংড়ানো এ কল তো আর বাবা শুনতে পায়না। মা তা দেখে উদাস মনে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে। আর না হয় বিছানা আকড়ে লেপ্টে থাকে যেন এটাই সমাধান।’
পরের দিন আয়েশা খন্দকার ফেসবুকে একটি খুশির খবরও পোস্ট করেন। তাতে দেখা যায় ব্যারিস্টার আরমানের কন্যা বুশরা তার স্কুলে ‘স্টুডেন্ট অব দ্যা ইয়ার’ হিসেবে মনোনীত হয়েছে। কিন্তু বুশরার এই আনন্দের দিনে যিনি সবচেয়ে খুশি হতেন সেই ব্যারিস্টার আরমান কোথায় আছে তা কেউ জানে না। ছোট্ট বুশরার হৃদয়ের এ অপূর্ণতাগুলো কেউ জানে, কেউ জানতেও পারে না। ওর অব্যক্ত বেদনাগুলো নিয়ে মিডিয়ায় প্রতিবেদন তৈরি হয় না। ওর কান্নাগুলো চার দেয়ালেই বন্দী।
সেঁজুতি কিংবা বুশরা, ওরা দু’জনেই শিশু। ওদের অনুভূতিগুলো পবিত্র। ওদের আবেগ ও ভালোবাসার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু ওদের দু’জনের সাথে দেশের গণমাধ্যমগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি সমান নয়। সেঁজুতির চিঠি তাই পত্রিকা কিংবা টেলিভিশনের খবরে স্থান পায়। কিন্তু বিনা অপরাধে ব্যারিস্টার আরমানদের প্রায় দুই বছর যাবত গুম করে রাখা হলেও তা নিয়ে কারো কোনই মাথাব্যাথা নেই। সেঁজুতির বাবা যখন প্রধানমন্ত্রীর চিঠি পেয়ে ফেসবুকে উচ্ছাস প্রকাশ করে, বুশরা সে সময়ে নিজের পিতার শূণ্যতা বুকে নিয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খায়।