অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
ইস্ট এশিয়া ফোরাম তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে, চীন এবং ভারত বর্তমানে বাংলাদেশের উপর নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে ভৌগলিক এক লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। গত সপ্তাহে ‘China and India’s geopolitical tug of war for Bangladesh’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে আরো জানা যায়, এই দুই পরাশক্তির মধ্যে প্রতিযোগিতার মুল বিষয় হলো বাণিজ্য। বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে এই দুই দেশই বাংলাদেশ থেকে বেশ বিরাট অংকের অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিল করে নিচ্ছে বলে জানায় অস্টোলিয়া ভিত্তিক এই নীতি নির্ধারনী মহলটি। রিপোর্টটি যৌথভাবে তৈরী করেছেন ঢাকা থেকে ফরেস্ট কুকসন এবং ব্যাংকক থেকে টম ফেলিক্স জোংক।
রিপোর্টে বলা হয় যে ভারত বরাবরই বাংলাদেশকে রাজনৈতিক, জাতীয় নিরাপত্তা এবং ধর্মীয় কারনে খুবই গুরুত্বপূর্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করে। তবে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে চীনের আধিপত্য এখনো ততটা প্রকট নয়। তবে বঙ্গপসাগরের এই প্রনালীতে নিজেদের প্রভাব স্থায়ী করার লক্ষ্যে দুই দেশই সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে প্রতিবেদনে দাবী করা হয়। তারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এই দেশটিকে নিয়ন্ত্রন ও শোষন করার জন্য আগামীতে আরো উদ্যেগী হবে বলেও ধারনা করা হয়।
তবে এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশ তার মত করে এই দুই পরাশক্তির সাথে খেলে যাচ্ছে। তাই চীন বা ভারতের কেউই তাদের লক্ষ্যপূরনে পুরোপুরি সফল হতে পারেনি বলেও প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে যাতায়াত করার জন্য বাংলাদেশ খুবই সহজ এবং উত্তম একটি গতিপথ। বিশেষ করে চীনের সামরিক বাহিনী শিলিগুড়ি করিডোরকে ঘিরে ইতোপূর্বে হুমকি দেয়ার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ভুমিটিকে ভারত খুবই নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য করিডোর হিসেবেই বিবেচনা করে। ইতোপূর্বে চীনা আর্মি ভারতকে হুমকি দিয়েছিলো যে শিলিগুড়ি করিডোরটিকে অবরোধ করার মাধ্যমে তারা ভারতের মূল ভুখন্ডকে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে।
ভারত এই চীনা হুমকি মোকাবেলার একমাত্র কৌশল হিসেবে আপাতত আওয়ামী লীগকেই ক্ষমতায় রাখতে চাইছে। তবে চীনও বেশ অনেকদিন ধরে বাংলাদেশকে নিয়ে পরিকল্পনা করছে এবং তারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- উভয় বলয়ের সাথেই যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে।
প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায় বিগত ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে চীন বাংলাদেশে ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পন্য রফতানি করেছে এবং এর বিপরীতে মাত্র ৭৫০ মিলিয়ন ডলারের পন্য আমদানি করেছে। চীন প্রতি বছর বাংলাদেশকে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সাহায্য প্রদান করে। আর সর্বশেষ ২০১৬ সালের অক্টোবরে যখন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পেং বাংলাদেশ সফরে আসেন, তখন তিনি বাংলাদেশকে আরো ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঋন দেয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। এই ঋন গ্রহনের প্রক্রিয়াটি এখনো চলমান।
অন্যদিকে ভারতের সাথে এই মুহুর্তে বানিজ্য ঘাটতির পরিমানও বিশাল- যা কোন হিসেবেই ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কম নয়। ভারত এখন প্রতি বছর বাংলাদেশে ৮ বিলিয়ন ডলারের পন্য রফতানি করে আর বিপরীতে আমদানি করে মাত্র ২৬০ মিলিয়ন ডলারের পন্য। আর অনানুষ্ঠানিক বানিজ্যের পুরোটাই ভারতের অনুকুলে যার পরিমান প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে বাংলাদেশে কর্মরত ভারতীয় নাগরিকদের কাছ থেকে ভারত প্রতিবছর ২-৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিটেন্স আয় করে। অন্যদিকে ভারত বাংলাদেশকে প্রতি বছর মাত্র ১৫০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করে।
এই প্রেক্ষিতে ভারত ও চীন উভয়দেশই বাংলাদেশকে সম্প্রতি বেশ কিছু বড় আকারের প্রকল্প নির্মানে সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে। দুটো দেশই রেলওয়ে খাতে বেশকিছু দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পের প্রস্তাব দিয়েছে যা বাংলাদেশের প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। ভারত ও চীন উভয়দেশই বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে বন্দর করার ব্যপারেও আগ্রহী।
বেশ কয়েক বছর ধরেই চীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে বেশ বড় আকারের লজিস্টিক এবং সামরিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে আসছে তবে ইদানিং ভারত সেই বাজারটিকেও ধরতে চাইছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে ভারতের প্রভাব খুবই প্রকট এবং দৃশ্যমান। বাংলাদেশ ও ভারতের একটি বিরাট অংশের মানুষের ভাষা একই। অন্তত এক লাখ বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রী বর্তমানে ভারতের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছে। দুই দেশের সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে সমঝোতা ও আদান প্রদানের মানসিকতাও বিদ্যমান। অন্যদিকে চীনও সম্প্রতি চীনা ভাষা শেখানোর উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে কনফুসিয়াস ইন্সটিটিউট চালু করেছে। তাছাড়া বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীদেরকে কম খরচে ও স্কলারশিপ চীনে নিয়ে যাওয়ার প্রবনতাও সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে।
তবে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ বড় এই দুই দেশের স্ট্র্যাটেজিক গেম সমন্ধে বেশ সচেতন। তারা এই দুই দেশ থেকেই আরো বেশী ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করছে। এই দুই দেশই যে বাংলাদেশ থেকে অনেক বেশী সুবিধা নিয়ে নিচ্ছে তাও বাংলাদেশ সরকারের গোচরে রয়েছে। সেই সংগে অবকাঠামোখাতে ভারত বা চীন যেসব যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে তাও যে খুব মানের নয়- তাও এখন পরিস্কার।
অন্যদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এসে আবার প্রমানীত হয়েছে যে চীন বাংলাদেশের খুব আস্থাভাজন নয়। এর আগে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ যখন মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গা নিধন বন্ধে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছিলো তখন চীন তাতে ভেটো দেয় যা বাংলাদেশ ভালভাবে নেয়নি। অন্যদিকে ভারত বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে দাবী করলেও তারাও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের সাথে ভাল আচরন করেনি। বরং তারা মিয়ানমার সরকারকেই সমর্থন দিয়ে গেছে।
তবে বানিজ্য দিয়ে এই দুই দেশ বাংলাদেশের সেই আস্থার সংকটটাকে কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছে। তবে ভারতের তুলনায় চীনের অর্থনীতি অনেক শক্তিশালী হওয়ায় এই বানিজ্য লড়াইয়ে তারা এগিয়ে আছে বলেও প্রতিবেদনে দাবী করা হয়।