অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেয়া ছাত্রীর রগ কাটার ঘটনায় অভিযুক্ত সুফিয়া কামাল হল ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সভানেত্রী ইফফাত জাহান এশার বিরুদ্ধে অভিযোগের যেনো শেষ নেই। কেবল মঙ্গলবার দিবাগত রাতেই নয়, এর আগেও এই নেত্রীর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন দলের সাধারণ কর্মীসহ অসংখ্য সাধারণ শিক্ষার্থী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগের সঙ্গে এশার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সেই সম্পর্কের খাতিরেই কোনো কিছুর তোয়াক্কা করতোনা এশা। রাজনৈতিক আশ্রয়ে হলে ওঠা ছাত্রীদের মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার করাটা ছিল তার এক ধরনের নেশা। এজন্য সে ছিলো ছাত্রীদের নিকট এক আতঙ্কের নাম।
হলের আবাসিক এক ছাত্রী জানান, কোটা সংস্কারে এবারের আন্দোলনের আগ পর্যন্ত মেয়েরা এভাবে কোনো আন্দোলনে অংশ নেয়নি। তিনি বলেন, শুরুর দিকে যখন এশার অধীনে হলে উঠি তখন প্রথম ১২ দিন তার পলিটিক্যাল কমান্ডে হেন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই যে, অংশ নিতে হয় নি।
হলে পলিটিক্যাল গণরুমে থাকা ছাত্রীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে বাধ্য করাটা হচ্ছে একটি অলিখিত নিয়ম। মঙ্গলবারের ন্যায় নির্যাতন এর আগেও অনেকবার হয়েছে। সেগুলো এভাবে প্রকাশ পায় নি। ছাত্রীর রগ কাটার ঘটনা প্রকাশের পর থেকেই মূলত তার নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন শিক্ষার্থীরা।
হলের আরেক শিক্ষার্থী জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেয়ার কারণে সোমবার রাতেও কয়েক শিক্ষার্থীকে বকাঝকা করেছেন এশা। সাধারণ মেয়েরা তাদের ডেকে জানতে চাইলে কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন ভুক্তভোগীরা। এশার অত্যাচারের ভয়ে কোনো ছাত্রীই মুখ খুলতে সাহস পেতেন না। রাজনৈতিক আশ্রয়ে হলে ওঠা ছাত্রীদের মনে একটি শঙ্কাই কাজ করতো, এই বুঝি তাদের সিট বাতিল হয়ে যায়।
গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্সের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে হলের ছাত্রীদেরকে জোরপূর্বক নিয়ে গিয়েছিলেন এশা। এমন কি রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত তাদেরকে সেখানে থাকতে বাধ্য করেন এই নেত্রী। যেখানে ছাত্রীদের হলে রাত ৯টার পর বাইরে থাকার কোনো সুযোগ নেই। তখন এ নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় ও সমালোচনা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এশার গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার ৩নং দিগনগর ইউনিয়নের দেবতলা গ্রামে। তার বাবা ইসমাইল হোসেন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক এবং জেলা দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি)। ২০০১ সালে শৈলকুপার গাড়াগঞ্জ একটি জনসভায় তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। এশা ঝিনাইদহ সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি ও ২০১২ সালে ঝিনাইদহ সরকারি নুরুন্নাহার মহিলা কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ২০১২-২০১৩ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে ভর্তি হন। বর্তমানে তিনি মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।
গত মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে কবি সুফিয়া কামাল হলে তিন ছাত্রীকে মারধর করে রক্তাক্ত করার ও এক ছাত্রীর পায়ের রগ কেটে দেয়ার অভিযোগ উঠে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইফফাত জাহান এশার বিরুদ্ধে। এশা আন্দোলনে অংশ নেয়া তিন ছাত্রীকে নিজ কক্ষে (৩০৭) ডেকে নিয়ে নির্যাতন করেন। এসময় তাদের চিৎকার শুনে হলের অন্য সাধারণ ছাত্রছাত্রী তাদের উদ্ধারে এগিয়ে যান। তখন মোর্শেদা খানমকে পায়ের রগ কাটা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
এ ঘটনার প্রতিবাদে সাধারণ ছাত্রীরা হলটির মাঠে অবস্থান নিয়ে এশাকে বহিষ্কারের দাবি করেন। নিশ্চয়তা চান নিরাপদভাবে হলে অবস্থানের। এসময় ‘নির্যাতনকারীর কালো হাত, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘মরতে নয়, পড়তে চাই’, ‘বোনের ওপর হামলা কেন, প্রশাসন জবাব চাই’- স্লোগান দিতে থাকে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ক্ষোভে ফেটে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা। ছাত্রলীগের বাধা উপেক্ষা করে ছেলেদের হল থেকে মিছিল নিয়ে কবি সুফিয়া কামাল হলের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করে ৪-৫ হাজার শিক্ষার্থী। এসময় তারা এশাকে বহিষ্কারের দাবি করেন।
এক পর্যায়ে এশাকে হল ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বহিষ্কার করা হয় ছাত্রলীগ থেকেও। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, ‘ছাত্রী মারধরের অভিযোগে ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানসহ সিনিয়র শিক্ষকরা বসে তাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’
অন্যদিকে ছাত্রলীগের সভাপতি মো. সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে এশাকে হল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে বৃহস্পতিবার ছাত্রলীগ সভাপতি ও সেক্রেটারি স্বাক্ষরিত আরেকটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সেদিনের ঘটনার তদন্তের জন্য ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ৪ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এদিকে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি করাকে ভালো চোখে দেখছেন না হলের ছাত্রীরা। তারা এটাকে এশার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের চক্রান্ত হিসেবে দেখছেন। কারণ ইতোমধ্যেই ছাত্রলীগের বিভিন্ন নেতারা এশাকে নির্দোষ উপস্থাপন করে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার প্রোপাগাণ্ডা চালাচ্ছে।
এদিকে ছাত্রীর রগ কাটার দায়ে বহিষ্কারের আগে এশাকে জুতার মালা পরিয়ে হলচ্যুত করে সাধারণ ছাত্রীরা। বিক্ষুব্ধ ছাত্রীদের অভিযোগ, ছাত্রলীগের হল শাখা সভাপতি এশা আগেও সাধারণ ছাত্রীদের নিজের কক্ষে ডেকে নিয়ে মারধর করতেন। তবে এতদিন ভয়ে কেউ মুখ খুলেনি।