অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা কি দেশটিকে একটি একনায়কতান্ত্রিক বা স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করছে? এমন প্রশ্ন রেখেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা। গত ৪ এপ্রিল তারা বাংলাদেশের রাজনীতির নানা দিক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর উপর সরকারি দলের দমন পীড়ন, নেতাকর্মীদের গুম-হত্যা, নির্যাতন নিয়ে এক নাতিদীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আলজাজিরায় প্রকাশিত সেই প্রতিবেদটি বাংলায় ভাষান্তর করেছে অ্যানালাইসিস বিডি। পাঠকদের জন্য তা হুবহু তুলে ধরা হলো:
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে বিতর্কিতভাবে কারান্তরীণ রাখা এবং বিরোধী মতের উপর রাষ্ট্রীয় নির্যাতন পরবর্তী সংসদীয় নির্বাচনে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশংকাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পুনরাবৃত্তির আশংকা দেখা দিয়েছে। যখন প্রায় সব বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করেছিলো এবং বাংলাদেশে সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড ছড়িয়ে পড়েছিলো। কারণ ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকারের উপর বিরোধীদলের উপর সম্মিলিত নির্যাতনের অভিযোগ ছিলো।
নির্বাচনী বছরে কী ঘটতে চলেছে তা নিয়ে সাধারণ মানুষ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। কারণ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা জেলে যাওয়ার ভয় বা তার চেয়েও খারাপ পরিণতির আশংকা নিয়েই সরকারের বিরোধীতা করে আসছে।
ঢাকার বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা নাদিয়া তাবাসসুম খান আল-জাজিরাকে বলেন, আওয়ামীলীগ বিরোধী সকল মতকে দমন করে রেখেছে যার কারণে তিনি মনে করছেন না কেউ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস করবে।
ঢাকার একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মালিক হাসান হাবিব। তিনি বলেন, দুই নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক দলের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্ব সুষ্ঠু নির্বাচন বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব করে ফেলছে।
গুম
বাংলাদেশের বিরোধী দলীয় নেত্রী ও দুইবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে বিতর্কিতভাবে কারান্তরিণ করার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে আসা স্বৈরশাসনের অভিযোগ অস্বীকার করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
খালেদা জিয়ার স্বামী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নামে করা একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য বিদেশ থেকে আসা ২১ মিলিয়ন টাকা অনুদান আত্মসাৎ এর অভিযোগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। তাঁর বড় ছেলে এবং অন্য আরো ৪ জনকে ১০ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়।
একমাসের কাছাকাছি সময় পর খালেদা জিয়া জামিন পান। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যেই দেশের সুপ্রীম কোর্ট কোনো ধরণের কারণ দেখানো ছাড়াই জামিন স্থগিত করে এবং ৭২ বছর বয়সী খালেদা জিয়াকে ৮ মে পর্যন্ত কারান্তরিণ রাখার নির্দেশ দেয়, যেদিন জামিন শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে আটক ও পরবর্তিতে জেলে পাঠিয়ে হাসিনা সরকার বিরোধী দলকে রাজনীতির বাইরে রাখার ষড়যন্ত্র করছে বলে দাবী করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে বিএনপি নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশ ও সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশের দেয়া তথ্য মতে খালেদা জিয়ার রায়ের দিন প্রায় ৩০০ বিএনপি নেতাকর্মী আটক হয়। এই বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিরোধী দলের ৩ হাজারেরও অধিক নেতাকর্মীকে পুলিশ আটক করে।
হাসিনা এবং খালেদা জিয়া- এই দুই নারী গত ২ দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। বস্তুত, দেশের সর্বাধিক ক্ষমতাশালী এই দুই নারীর মধ্যকার চরম দ্বন্দ্ব বাংলাদেশকে সহিংসতা ও অস্থিতিশিলতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
বিএনপি অভিযোগ করেছে, ২০১৪ সাল থেকে এই পর্যন্ত তাদের ৫০০ এর অধিক নেতাকর্মীকে হত্যা এবং প্রায় ৭৫০ নেতাকর্মীকে গুম করেছে পুলিশ। গুম হওয়া নেতাকর্মীদের মধ্যে অন্তত ১৫০ নেতাকর্মীকে হয় বিচারবহির্ভুতভাবে হত্যা করা হয়েছে না হয় গুম করা হয়েছে।
প্রধান বিরোধী দল এখনো পর্যন্ত খালেদা জিয়ার রায় নিয়ে কোনো কর্মসুচীর সিদ্ধান্ত নেয়নি। দলটি দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে। যদিও রাজনৈতিক সভা সমাবেশের অনুমতি না পাওয়ায় শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী অব্যাহত রাখার বিষয়ে ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে দলটির। বড় ধরণের সহিংসতার আশংকা এই বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন ভন্ডুল হওয়ার কারণ হতে পারে।
গত সপ্তাহে, জার্মানীর গবেষণা প্রতিষ্ঠান “বার্টেলসম্যান ফাউন্ডেশন” একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে বলা হয় বাংলাদেশ এখন স্বৈরশাসনের কবলে। ১৩টি দেশের তালিকা করা হয় যে দেশগুলোতে রাজনৈতিক অবস্থা বর্তমানে একেবারেই ভঙ্গুর। প্রতিবেদনে বলা হয় এর মধ্যে বাংলাদেশ, লেবানন, মোজাম্বিক, নিকারাগুয়া এবং উগান্ডা- এই ৫টি দেশে গণতন্ত্র বছরের পর বছর বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং সেখানে গণতন্ত্রের ন্যুনতম বৈশিষ্ট্য অবশিষ্ট নেই।
নির্বাচনে সংশয়
বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে রাজনৈতিক গবেষকবৃন্দ হাসিনা সরকারের ব্যাপারে নিন্দা করেছেন বিশেষ করে স্বাধীন ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে। ২০১৪ সালে একটি বিতর্কিত ও সংঘাতময় নির্বাচনের মাধ্যমে হাসিনা ২য় বারের মত ক্ষমতায় আসে যা বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো বর্জন করেছিলো।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার ১০ বছরের ক্ষমতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে বিরোধী মতকে দমন করার অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের মানবাধিকার লংঘনের ব্যাপারে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা ‘আইন ও শালিস কেন্দ্র’ বলেছে ২০১০ সাল থেকে এই পর্যন্ত ৫১৯ জনকে গুম করা হয়েছে যার মধ্যে ৩শরও অধিক মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছে।
কাতার ও ভিয়েতনামের বাংলাদেশী সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামানের মেয়ে শবনম জামান বলেন, “গত ৪ ডিসেম্বর থেকে আমার বাবা নিখোঁজ রয়েছেন”। গত বছরের ডিসেম্বরে ফেসবুকে সরকার বিরোধী পোস্ট দেয়ার অভিযোগে মারুফ জামানকে সাদা পোশাকধারীরা ঢাকা থেকে তুলে নিয়ে যায়। তিনি আল-জাজিরাকে বলেন,পুলিশ আমার বাবার গুম হওয়ার ঘটনা জেনেও তদন্ত বন্ধ করে দিয়েছে”।
এ বছরের ১৩ মার্চ জাকির হোসেন নামক এক ছাত্রদল নেতাকে পুলিশের কাস্টডিতে নির্যাতন করে হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বলা হয় বাংলাদেশ সরকার শতশত মানুষকে গোপনে আটক করছে যার অধিকাংশই হাসিনা সরকারের বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী।
সম্পুর্ণ স্বাধীন, দাবী সরকারের
আওয়ামীলীগ সরকার অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বিএনপির অভিযোগ সম্পর্কে আল-জাজিরার পক্ষ থেকে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, বিরোধী দল তাদের গণতান্ত্রিক কর্মসূচী বাস্তবায়নে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জননিরাপত্তা ইস্যুতে তাদের তৎপরতা চালাবে না।
বিএনপি কর্তৃক বর্জন করা ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচন প্রশ্নে ইনু বলেন, “২০১৪ সালের নির্বাচন সংবিধানের আলোকেই হয়েছে। নির্বাচন বর্জন বিএনপির একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিলো এবং এখন তাঁরা তাদের ভুল বুঝতে পারছে।
বাংলাদেশের এই মন্ত্রী আওয়ামীলীগ সরকারকে স্বৈরশাসন আখ্যা দেয়া জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং তা উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও ভিত্তিহীন বলে দাবী করেন। যে তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে তিনি তা জানার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
ইনু আরো বলেন, সত্যিকারের গণতন্ত্রের সহায়ক শক্তি হিসেবে গণমাধ্যম ও বিচার বিভাগ এদেশে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন।
সিনিয়র আওয়ালীগ নেতা ফারুক খান বলেন মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলো মোটেও সত্য নয়। তিনি বলেন, আমাদের সরকার মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে জায়গা দিয়ে সারা বিশ্বের সামনে মানবাধিকারের এক নজির স্থাপন করেছে।
গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত
কিন্তু বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা সরকারের এই দাবীর সাথে একমত নন। মিনাক্ষি গাঙ্গুলি, যিনি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া পরিচালক, তিনি বলেন বাংলাদেশ হয়তো মিয়ানমার থেকে পালিয়া আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরকে আশ্রয় দিয়ে বিশ্বের প্রশংসা কুড়িয়েছে কিন্তু স্থানীয় মানবাধিকারের অবস্থা আশংকাজনক।
গাঙ্গুলি আল-জাজিরাকে বলেন, সরকার গুমের বিষয়টি বারবার অস্বীকার করছে। এটা অবশ্যই উপলব্ধি করা প্রয়োজন প্রত্যেককেই আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক আটক করা হয়েছে। যাদের অধিকাংশই বিরোধী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত।
গাঙ্গুলি আরো বলেন, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা ভীতির মধ্যে আছেন কারণ ফেসবুকে সরকার বিরোধী পোস্ট দেয়ার কারণে অনেককেই শাস্তি দেয়া হয়েছে।
আমেরিকার ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ আল-জাজিরাকে বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়।
রিয়াজ মনে করেন, যদি বিএনপি ও তার শরীক দলগুলো পরবর্তি সংসদীয় নির্বাচন বর্জনে বাধ্য হয় তাইলে তা ২০১৪ সালের মতোই একটি অন্তঃসারশূন্য নির্বাচন হবে যার কোনো নৈতিক বৈধতা থাকবেনা। ‘বিরোধীদলের উপর ক্রমবর্ধমান অত্যাচার শুধুমাত্র অবিবেচনাপ্রসুতই নয়, বরং তা খুবই খারাপ ফল বয়ে আনবে’ ,রীয়াজ বলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, সরকার নিরাপত্তার অজুহাতে বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলোকে র্যালী ও বিক্ষোভ মিছিল করার অনুমতির আবেদন প্রত্যাখ্যান করছে।
নজরুল বলেন, “সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো যারা ভাবছে তারা একে অপরের প্রতি দায়বদ্ধ নয়, এটি গণতন্ত্রের জন্য ভয়ঙ্কর সংকেত”।
আলজাজিরার প্রতিবেদনটির লিংক: Is Bangladesh moving towards one-party state?