অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
আজ ১১ মার্চ। প্রতিবছর এই দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে বাংলাদেশের বৃহত্তম ইসলামী ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। ১৯৮২ সালের এই দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বর সাবিবর, হামিদ, আইয়ুব ও জাববার নামে সংগঠনটির চার কর্মীর রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠা লাভের পর এই দিনেই প্রথম কোনো কর্মী শহীদ হয় সংগঠনটির।
ছাত্রশিবিরের দাবি, স্বাধীন বাংলাদেশে ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম শহীদ হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন রাজাশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠনটির কর্মী সাবিবর আহমদ। এরপর আবদুল হামিদ, আইয়ুব আলী, আবদুল জাববারের পথ ধরে এখন পর্যন্ত সংগঠনটির ২৩৪ জন কর্মী বিভিন্নভাবে শহীদ হয়েছে।
শহীদ দিবস উপলক্ষে ইসলামী ছাত্রশিবিরের উদ্যোগে দোয়া ও আলোচনাসহ দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে।
কী ঘটেছিল এই দিনে?
১৯৮২ সালে ১০ মার্চ, ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতরণ করেন লিফলেট। ১১ মার্চ নবীনবরণ। বাম ছাত্রসংগঠনগুলো ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জোর করে ছিনিয়ে তছনচ করে ফেলে লিফলেটগুলো, মারধর করে শিবির নেতা-কর্মীদের। এদিন সকাল ৮টা থেকেই প্রশাসনিক ভবনের পশ্চিম চত্বরে শিবিরের নবীনবরণের ডাকে সাড়া দেয় হাজার তরুণ-যুবকের দল। ছাত্রজনতার ঢল নামে নীল প্যান্ডেলের সামনে। ৯টায় কুরআন তেলাওয়াত দিয়ে নবীনবরণ শুরু হতে যাচ্ছে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেটে আগের দিনের ঘটনা ও শিবিরের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক ডজন পুলিশসহ ম্যাজিস্ট্রেট অপেক্ষা করছে।
হঠাৎ সাড়ে ৯ টার দিকে গাড়িতে করে শত শত ছাত্রমৈত্রী, জাসদ, ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের আগমন ঘটে রাবি ক্যাম্পাসে। অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তারা মিলিত হয় রাবি শহীদ মিনার পাদদেশে। ছাত্র ইউনিয়নের হেলাল; ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি শিশির; ছাত্রলীগের রানা, আজাদ, সাকুর, ফজলে হোসেন বাদশা, করীম শিকদার, কাদের সরকার; জাসদের ফিরোজ প্রমুখ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ক্যাডারদের নেতৃত্বে নিরস্ত্র শিবিরের নেতা কর্মীদের ওপর হামলা চালায়।
নবীন বরণ হয়ে যায় পন্ড। সসস্ত্র ক্যাডাররা হকিস্টিক, রামদা, কিরিচ, চাইনিজ কুড়াল, পালশী নিয়ে হামলে পড়ে শিবির নেতাকর্মীর উপর। শিবির নেতা কর্মীরা ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় হয়ে যায় দিশেহারা। অব্যাহত হামলায় শিবির নেতা-কর্মীরা চিৎকার আর আর্তনাদ শুরু করে। বীভৎস দৃশ্য তৈরি হয়। সেদিন পুলিশ ভিসির অনুমতির অপেক্ষায় ছিল। শিক্ষক, ছাত্র কারও অনুরোধেও ভিসি পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে দেয়নি। ফলে রক্তের লাল বর্ণে মতিহারের সবুজ চত্বর হয় রঞ্জিত।
এমনি মুহূর্তে বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে শহীদ জোহার মাজারের সামনে শিবির নেতা সাবিবরের ওপর নারকীয় হামলা চালানো হয়। রড-কিরিচ-রামদার শত শত আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে রাজশাহী মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়। জোহরের নামাজের সময় জানা যায় সাবিবর আর নেই। শত শত নেতাকর্মী আহত আর রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। শত জনতার সম্মুখে বিএনসিসিসির সামনে শিবির নেতা আব্দুল হামিদের মাথার নিচে ইট রেখে অনেক ইট আর রড দ্বারা আঘাত করলে মগজ ছিটকে বের হয়ে যায়। ৮/১০ ঘণ্টা পর সেও শহীদ হয়। ৩৫ ঘণ্টার ব্যবধানে আহত চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১২ মার্চ শহীদ হয় আইয়ূব। দীর্ঘদিন আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলেন রসায়ন বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবদুল জাববার। কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি যান। ৯ মাস পর ২৮শে ডিসেম্বর তিনিও শহীদ হন।
সেই দিন হাজার জনতার উপচেপড়া ভিড় আর আহতদের ক্ষত-বিক্ষত দেহ গগনবিদারী আহাজারির দৃশ্যাবলী অবলোকন করে কেউ পারেনি অশ্রু নিবারণ করতে। ছাত্রনেতা মামুনের সাতদিন পরও জ্ঞান ফেরেনি। উন্নত চিকিৎসা আর অমানবিক ঘটনার জন্য তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারও ছুটে যান রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তিনি এই হামলা ও হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ ও ঘৃণা প্রকাশ করেন। আর অজ্ঞান মামুনের উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারি হেলিকপ্টার যোগে ঢাকা সামরিক হাসপাতালে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
১৯৮২ সালের এই নৃসংশ ঘটনার পর থেকে প্রতিবছরই ইসলামী ছাত্রশিবির এই দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। এই দিনে তারা শহীদদের মাগফেরাত কামনায় দোয়া, আলোচনা, পথশিশুদের খাবার বিতরণ, শহীদদের কবর জিয়ারতসহ নানা কর্মসূচী পালন করে থাকে।