দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে চলা আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ রেখে সরকারের পাতা ফাঁদ এড়াতে পেরেছে বিএনপি। এতে খালেদা জিয়া ও বিএনপির জনপ্রিয়তা বেড়েছে বহুগুন। পাশাপাশি দেশের সাধারণ মানুষ ও আন্তর্জাতিক মহলেও বিএনপির প্রশংসা হচ্ছে। কারণ, বিশ্ব সম্প্রদায় সহিংসতা সমর্থন করেন না। বরং শান্তিপূর্ণ গণ-আন্দোলন ও নির্যাতিতদের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দাঁড়ানোর ঐতিহ্য। এখন দেশের মানুষও সহিংসতা পছন্দ করেন না।
অনেকে ধারণা করেছিলেন, বেগম জিয়াকে জেলে ঢুকানো হলে বিএনপি জ্বালাও-পোড়াওসহ সহিংস কর্মসূচি দিবে। এতে সরকার সন্ত্রাস দমনের নামে বিএনপি নেতাকর্মীদেরও জামায়াতে ইসলামির মতো নির্মূলের সুযোগ পেয়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে তড়িগড়ি জাতীয় নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা আরো স্থায়ী করে নিতে পারবে আওয়ামী লীগ। কিন্তু সরকারের পাতানো সেই ফাঁদে পা না দেয়ায় উল্টো এখন ক্ষমতাসীনদের মধ্যেই হতাশা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল থেকে বিএনপির সঙ্গে বৈঠক, বিবৃতি, সমর্থন ও খালেদা জিয়াকে কারাগারে রাখার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতেও সরকারের প্রতি চাপ বাড়াচ্ছেন বিশ্বনেতারা। গণতন্ত্রের স্বার্থে বিশ্ববাসীর এমন ভূমিকায় সরকারের মধ্যে অস্বস্তিও তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ। আর খালেদা জিয়াকে ‘পাতানো’ মামলায় সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানোর পর তার মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচিতে সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীসহ মানুষের ঢল নামছে। এতে সরকারের সব প্রচেষ্টা আপাত দৃষ্টিতে ‘গুড়েবালি’ হয়েছে বলে মনে করেন বিএনপির শীর্ষনেতারা।
তাদের মতে, ইস্যু তৈরি করে নেতাকর্মীদের রাজপথের আন্দোলনে নামার সুযোগ করে দিয়ে উল্টো বেকায়দায় পড়েছে সরকার। বর্তমানে বিএনপি বেশি ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী। সব ভেদাভেদ ভুলে দলের কর্মসূচিগুলোতে নেতাকর্মীদের সঙ্গে সারা দেশে হাজার হাজার মানুষের ঢল-তারই প্রমাণ। তবে বিএনপি’র এমন মন্তব্যকে উড়িয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতারা বলছেন, সরকার কারো জন্য ফাঁদ পাতেনি, ফাঁদে পড়েওনি।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এক তরফা নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল। এ নির্বাচনের আগে-পরে কয়েক দফা আন্দোলনের ডাক দিয়েও সফল হয়নি বিএনপি। উল্টো নানামুখী চাপে কোণঠাসা হয়ে পড়ে দলটি। লাগাতার অবরোধ চলাকালে বিভিন্ন স্থানে চোরাগোপ্তা হামলার ঘটনা ঘটলেও রাজধানীর রাজপথে নামতেই পারেনি দলের নেতাকর্মীরা।
কিন্তু গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ে বেগম খালেদা জিয়া ও তার বড় ছেলে তারেক রহমানকে সাজা দেয়ার পর থেকে অনেকটাই বদলে গেছে দলটির আন্দোলনের দৃশ্যপট। দলীয় চেয়ারপারসনের মুক্তি দাবিতে ঢাকার রাজপথে নেমে একের পর এক কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছেন দলের শীর্ষনেতা থেকে শুরু করে অসংখ্য কর্মীসমর্থক। রায় নিয়ে চরম অসন্তোষ থাকলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় বিষয়টিকে ‘শাপে বর’ হিসেবেই দেখছেন দলটির শীর্ষ নেতারা।
বিএনপি সরকারের ফাঁদে পা দেয়নি
খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, যে সব কর্মীরা এতদিন নিশ্চুপ ছিল। ঘরে বসে ছিল। যে মুহূর্তে খালেদা জিয়াকে জেলে নিয়েছে তারা আবেগে মাঠে নেমেছে। তারা কর্মসূচিতে যোগদান করেছে। বিএনপি সবচেয়ে লাভবান হয়েছে।
বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে থাকায় ক্ষমতাসীনরা হতাশ হয়ে পড়েছেন বলেও মন্তব্য এই দায়িত্বশীল নেতার। খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, বিএনপি একটি উশৃঙ্খল দল। এমন ফাঁদ পেতেছিল সরকার। বিএনপি সেই ফাঁদে পা দেয়নি। এখন আওয়ামী লীগ হতাশ।
সেই সাথে এই আন্দোলনের মাধ্যমে নির্বাচনের আগে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা বিএনপি’র। তারা বলছেন, খালেদা জিয়ার কারাবন্দী দলের কেউ মেনে নিতে পারেনি। মাঠে ও দলে সক্রিয় সিনিয়র নেতারাসহ দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরাও। যেকোনো প্রয়োজনে কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সিনিয়র নেতারা বসছেন একত্রে। পরামর্শ নিচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের। মাঠে থেকে নেতারাই এগিয়ে নিচ্ছেন চেয়ারপারসনের মুক্তির দাবিতে ঘোষিত সব কর্মসূচি।
সিনিয়র নেতারা বলেছেন, বিএনপি এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ। ক্ষমতাসীনরা তাদের চাপে রাখতে কিংবা নেতৃত্বে ভাঙন ধরাতে দীর্ঘ দিন ধরেই নানা কৌশল প্রয়োগ করে আসছে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি, এবারো হবে না।
১১ বছর ধরে নির্যাতনেও কেউ দল ছাড়েননি
তাদের মতে, মাঠের নেতাকর্মীরা ১১ বছর ধরে নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছেন। কিন্তু কেউই দল ছেড়ে যাননি। এটিই বিএনপির সবচেয়ে বড় সফলতা। দলের চেয়ারপারসনের কারাবন্দী দলের শীর্ষ থেকে তৃণমূল কেউই মেনে নিতে পারেনি। ক্ষোভের পাশাপাশি আবেগের অশ্রুও ঝরিয়েছেন নেতাকর্মীরা। কোনো কোনো মহলের প্রচারণা ছিল, খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিএনপি আরো দুর্বল হয়ে পড়বে। এমনকি ভেঙেও যেতে পারে দলটি। তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
কারাবন্দী হওয়ার পর গত ৯ দিনে বিএনপির সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দলের নেতারা চমৎকার বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম চলছে খুব গোছালোভাবে। তারেক রহমানের পরামর্শে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রয়োজনানুযায়ী সব ব্যবস্থা নিচ্ছেন। সিনিয়র নেতারা তাকে সহায়তা করছেন।
তারেক রহমান প্রতিটি কর্মসূচি মনিটর করছেন
দল পরিচালনার ক্ষেত্রেই নয়, সিনিয়র নেতারা প্রতিটি কর্মসূচিতেও নিজেদের উপস্থিত রাখছেন। গ্রেফতার এড়িয়ে মাঠের নেতারা যে যেভাবে পারছেন, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। দলের এক নেতা গতকাল বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রতিটি কর্মসূচি মনিটর করছেন। এ কারণে সবাই আরো বেশি সতর্ক ও উদ্যমী।
তারেক রহমান রয়েছেন লন্ডনে। দলের বর্তমান প্রতিকূল অবস্থায় তিনি খুব সক্রিয় ও সজাগ ভূমিকা পালন করছেন বলে জানা গেছে। এ পর্যন্ত তিনি তিনবার দলীয় ফোরামে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তৃতা রেখেছেন। এসব বক্তৃতায় দলের ঐক্য বজায় রাখার পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়ে সবাইকে মাঠে থাকার আহবান জানিয়েছেন তিনি।
জানা গেছে, কারাবন্দী হওয়ার পর বেগম খালেদা জিয়া আইনজীবীদের মাধ্যমে বিশেষ বার্তা পাঠিয়েছেন। নেতাকর্মীদের তিনি ভেঙে না পড়ে, আইন হাতে তুলে না নিয়ে রাজপথে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন চালিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। নেতারা বলছেন, বিএনপি প্রধানের নির্দেশমতোই চলছে দল। সাংঘর্ষিক নয়, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেই রয়েছে তারা।
৬ হাজারের বেশি নেতাকর্মী গ্রেফতার
খালেদা জিয়া গ্রেফতার হওয়ার পর এ পর্যন্ত সারা দেশে ছয় হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নতুন করে মামলা হয়েছে দুই শতাধিক। প্রতিনিয়ত পুলিশি অভিযান, তল্লাশি চলছে। দলের বেশির ভাগ নেতাকর্মীই বাসা-বাড়ি ছাড়া। রাজধানীতে রয়েছে পুলিশের কড়া নজরদারি। মহানগরের প্রথম সারির নেতাদের ধরতে পুলিশি তৎপরতা বহাল রয়েছে। অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ নেতারাও রয়েছেন পুলিশের নজরদারিতে। এমন পরিস্থিতিতে গ্রেফতার এড়িয়ে সাংগঠনিক সব কর্মসূচি সফল করার নির্দেশনা দিয়েছে বিএনপি।
প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নেতারা রাজপথেও সক্রিয়
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে বলেন, অতীতের যেকোনো সময়ের চাইতে বিএনপি এখন ঐক্যবদ্ধ। শুধু তা-ই নয়, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নেতারা রাজপথে সক্রিয়ও। সব প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে বিএনপি ঘুরে দাঁড়াবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
তিনি বলেন, মামলা-হামলা, গুম-খুনের পরও একজন কর্মী দল ছেড়ে যাননি। আমাদের আন্দোলন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। তাই শেষ মুহূর্তে কেউ দল ছেড়ে যাবে বলে আমি মনে করি না। বরং যারা দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় ছিলেন দলের এই পরিস্থিতিতে তারা আরো সক্রিয় হচ্ছেন।
বিএনপি মহাসচিব আরো বলেন, দেশের এই চরম সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে বা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আমরা বদ্ধপরিকর। যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে আমরা প্রস্তুত। আন্দোলন সফলে আমরা রাজপথে থাকব। সেখান থেকে জেলে গেলেও আমরা পিছু হটব না।
সূত্র: শীর্ষনিউজ