প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে পরীক্ষার সময় কোচিং সেন্টার বন্ধ, পরীক্ষার্থীদের আধা ঘণ্টা আগে পরীক্ষাকক্ষে বসা এবং কেন্দ্রের ভেতর মোবাইল ফোন না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। কিন্তু কোনো পদক্ষেপই কাজে আসেনি। পরে প্রশ্ন ফাঁসকারীদের ধরিয়ে দিলে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়ার ঘোষণাতেও লাভ হয়নি। পরীক্ষার দিন ইন্টারনেট সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধের চেষ্টা করেও প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো যায়নি।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় পুলিশ কেবল গত তিন দিনে সারা দেশে ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু কোথা থেকে প্রশ্নগুলো ফাঁস হচ্ছে, সেটিই শনাক্ত হচ্ছে না। চলতি এসএসসি পরীক্ষায় এ পর্যন্ত সাত দিনে সাতটি বিষয়েরই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, যা প্রশ্নপত্র ফাঁসের রেকর্ড। একাধিক শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা বোর্ডের কয়েকজন কর্মকর্তার মতে, এবারের মতো আগাম ঘোষণা দিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা আগে ঘটেনি।
এই পরিস্থিতিতে এখন সরকার প্রশ্নপত্র ফাঁস, ছড়ানো ও প্রশ্নপত্র কেনাবেচার কাজে জড়িত ব্যক্তিদের ধরতে ব্যাপক ধরপাকড়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরীক্ষা চলাকালীন কেন্দ্রের ২০০ মিটারের মধ্যে কারও কাছে মোবাইল ফোন পেলে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করা হবে। গত রোববার রাতে পরীক্ষার দিন আড়াই ঘণ্টা করে ইন্টারনেট বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। কিন্তু সমালোচনার মুখে গতকাল সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিষয়ে ন্যূনতম আপস করা হবে না। এটা নির্মূল করার জন্য যা যা করার তাই করা হবে। জড়িত ব্যক্তিদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও বলা হয়েছে।
প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি গতকাল সংসদেও এসেছে। জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির সদস্য নুরুল ইসলাম বলেছেন, পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
অবশ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, এবার পরীক্ষার আগ মুহূর্তে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যেভাবে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটছে, তা প্রতিরোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বিটিআরসি, শিক্ষক সবার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মতে, বর্তমান প্রক্রিয়ায় প্রশ্নপত্র ফাঁস একেবারে বন্ধ করা কঠিন। কারণ, বিতরণসহ প্রশ্নপত্রের সঙ্গে শিক্ষকসহ কমপক্ষে ১৫ হাজার মানুষ জড়িত। এ জন্য প্রশ্নপত্র পরীক্ষার দিন সকালে স্থানীয়ভাবে প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে পরীক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। তবে আগামী দিনে ‘প্রশ্নব্যাংক’ করে প্রশ্নপত্রের অধিক সেট করে পরীক্ষা নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। এমসিকিউ তুলে দেওয়া হবে।
আগে বিভিন্ন সময় দু-একটি বিষয়ের প্রশ্ন ফাঁস হলেও ২০১২ সালের পর থেকে পাবলিক পরীক্ষা হলেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। প্রথম আলোসহ একাধিক পত্রিকার প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১২ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় অন্তত ৮০ বার (পত্রের) প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা এবং বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়। ২০১৫ সালে টিআইবির একটি গবেষণায় বলা হয়েছিল, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও বিতরণের সঙ্গে জড়িত সরকারি ব্যক্তিরা কোনো না কোনো পর্যায়ে প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত। প্রশ্ন তৈরি, ছাপানো ও বিতরণে প্রায় ১৮টি ধাপে প্রশ্ন ফাঁসের ঝুঁকি রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা কখনো নেওয়া হয়নি। কারও বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থাও নেই। মামলা হলে সাজাও হয় না। আগে অস্বীকারও করা হতো। ফলে সমস্যাটি আরও বেড়েছে।
যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আমিরুল আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, এই পরিস্থিতি তো সরকারই তৈরি করেছে। গোটা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে এখন অন্যদের দোষারোপ করা হচ্ছে। পৃথিবীর কোন দেশে এত নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষা হয়? এত কোচিং কোথায় হয়? হয় দলীয়, না হয় টাকা খেয়ে অযোগ্য লোকদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে, তারা তো প্রশ্নপত্র ফাঁস করবেই। তাই সরকার যতক্ষণ না পর্যন্ত সুনীতির বাহক হবে, সুশাসন ও স্বচ্ছতা না আনবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এ ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
সূত্র: প্রথম আলো