ড. আবদুল লতিফ মাসুম
যেমনটি ভাবা হয়েছিল তেমনটিই হয়েছে। আশঙ্কায় ছিল মানুষ। আইনপক্ষের যুক্তিবাদী লোকেরা বলেছিল তিনি বেকসুর খালাস পাবেন। অপর দিকে ক্ষমতাপক্ষের লোকেরা স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছিলেন তাকে জেলে যেতেই হবে। ছাগলের তৃতীয় ছানাটি বলেছিল ‘এক দিনের জন্য হলেও তাকে জেলে যেতেই হবে’। পতিত স্বৈরাচার তাকে জেলে দেয়ার মধ্যদিয়ে প্রতিশোধের সুযোগ সন্ধান করছিল। সরকারের তোতা পাখিটি দাবি করেছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ভাগ্যিস তিনি ফাঁসি দাবি করেননি। আদালত বেগম খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন। শাস্তি দিয়েছেন তারেক রহমানসহ অন্যদের। তাও আবার ডাবল। বিচারব্যবস্থার ওপর সরকারের অদৃশ্য হাত যখন প্রবল, তখন এমনটিই হবে।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সরকারের বিরুদ্ধে রায় দিয়ে কিভাবে নাস্তানাবুদ হয়েছেন- পাঠক সাধারণের নিশ্চয়ই তা মনে আছে। তার এই ক্ষমাহীন ঔদ্ধত্য! এর কারণে রাজাকার উপাধি পেতে হয়েছে। তার বিরুদ্ধে উচ্চারিত হয়েছে ১১টি দুর্নীতির অভিযোগ। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি আরো প্রমাণ করা যায়। তারেক রহমানকে যে বিচারক বেকসুর খালাস দিয়েছিলেন, তার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সরকার। অবশেষে ভদ্রলোক মালয়েশিয়া পালিয়ে গিয়ে প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন। নিম্ন আদালত এমনিতেই সরকারের অধীন রয়েছে। সেখানে দুর্নীতিও ব্যাপক। টিআইবি ব্যাপক অনুসন্ধান সাপেক্ষে এ ধরনের প্রতিবেদন দিয়েছিল। সেজন্য তাদের কম নাকানি- চুবানি খেতে হয়নি। সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে বিতাড়ন করার পর ‘নিম্ন আদালত নিয়ন্ত্রণবিধি’ জায়েজ করতে অবশ্য সরকারের বেগ পেতে হয়নি। রাষ্ট্রের দুই অঙ্গ- আইন সভা তথা জাতীয় সংসদ এবং নির্বাহী বিভাগ তথা আমলাতন্ত্রকে নিরঙ্কুশ দলীয়করণের পর সরকার বিচার বিভাগকে অনুরূপ নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ষোড়শ সংশোধনী গ্রহণ করে, তা অবশেষে তাদেরই মনোনীত বিচারপতি বাতিল করে দিলে তাদের মাথায় বাজ পড়ে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাটির ইতিহাস যারা জানেন তারা স্বীকার করবেন যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই ২০০৮ সালের ৩ জুন তৎকালীন ক্ষমতাসীন তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই মামলাটি দায়ের করে। একই সাথে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা দায়ের করা হয়। রাজনৈতিক সচেতন মহল জানেন যে ওই সব মামলার উদ্দেশ্য ছিল ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ কার্যকর করা। এ ফর্মুলা দিয়ে বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক নেত্রী- বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে বিতাড়ন করে তৃতীয় শক্তিকে ক্ষমতায় স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল। বেগম খালেদা জিয়া কোনোক্রমেই বিদেশে যেতে রাজি না হওয়ায় পরিকল্পনা অবশেষে ভেস্তে যায়। তার প্রতিপক্ষ বিদেশে গিয়েও ফিরে আসতে সক্ষম হন। অভিযোগ আছে- ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ বাস্তবায়নের কুশীলবদের সাথে ‘প্যাকেজ ডিল’ এর আওতায় তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ক্ষমতায় যেতে না যেতেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো প্রত্যাহার কিংবা নিষ্পত্তি করা হয়। তখন বিবেকসম্পন্ন একজন প্রবীণ প্রফেসর বলেছিলেন, ওই মামলাগুলো মোকাবেলা করার পরই কেবল তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারেন। এই অপরাধে! তাকে অবশ্য মর্যাদাপূর্ণ সংগঠনের পদটি ছাড়তে হয়।
সে যা হোক, ওই সময়ের দায়ের করা মামলা ছাড়াও এই আমলে আরো অনেক মামলা বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে আরো ৩৫টি মামলা রয়েছে। অন্যান্য আদালতের উপস্থাপিত মামলা ছাড়াও আলিয়া মাদরাসার বিশেষ আদালতে বিচারের জন্য পাঠানো হয়েছে এরকম মামলার সংখ্যা ১৪টি। এর মধ্যে রয়েছে রায় হওয়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা। এখন জিয়া চ্যারিটিবল ট্রাস্ট মামলার শুনানি চলছে। আরো রয়েছে গেটকো নাইকোসহ কয়েকটি বিস্ফোরক আইনের মামলা। দেশবাসী দেখছেন, এর আগে মোটামুটি প্রতি সপ্তাহে তিন দিনই খালেদা জিয়াকে ওই আদালতে হাজির থাকতে হয়েছে। দুর্ভাগ্যক্রমে একটি সামরিক সমর্থিত সরকার যে ফর্মুলায় তাকে মাইনাস করতে চেয়েছে, তিনি এখন একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে একই ফর্মুলা প্রয়োগ করছেন।
এখানে গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করতে হয়, দূরদর্শী বেগম খালেদা জিয়া আনুগত্যের প্রতিশ্রুতিশীল একটি সামরিক সরকারের স্থায়ীকরণের চেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক সরকারের প্রতিষ্ঠাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। সেই গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফল কি এই যে তাকে অব্যাহত রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হয়ে জেলে জীবনযাপন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতীতে একটি নির্মম ও শোকাবহ পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছেন। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে হত্যা ষড়যন্ত্র ও জুলুমের কোনো স্থান নেই। সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজনীতির সেই নির্মম ও ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় অল্প বয়সে তার স্বামীকে হারিয়েছেন। ১/১১-এর সময় কারাগারে থাকতে তিনি মাকে হারিয়েছেন। এই সরকারের সময় অফিসে অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় প্রিয় সন্তানকে হারিয়েছেন। জ্যেষ্ঠ সন্তান নির্যাতনে পঙ্গু হয়ে দূরদেশে এখনো চিকিৎসাধীন। কাছে নেই পরিবারের আর কেউ। পরিবার আপনজন থেকে বিচ্ছিন্নভাবে যাপন করছিলেন একান্ত নিঃসঙ্গ জীবন। কষ্টের কথা এই বয়সে তাকে নির্মম নিপীড়নের শিকার হতে হলো।
বিস্ময়ের ব্যাপার বেগম খালেদা জিয়া এ অবস্থায় এই বয়সে এখনো অনড় সুদৃঢ় এবং অটল রয়েছেন। তিনি হেঁটে হেঁটে নিজেকে জেলে সমর্পণ করেছেন। বিচার পূর্ববর্তী সন্ধ্যায় এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, ‘আমি যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত আছি। আমাকে জেল বা সাজার ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ হবে না। আমি মাথা নত করব না। জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি থেকে পিছু হটব না। আপনাদের খালেদা জিয়া কোনো অন্যায় করেনি। ন্যায়বিচার হলে আমার কিছুই হবে না। আর যদি ক্ষমতাসীন মহলকে তুষ্ট করার জন্য রায় হয়, তা কলঙ্কের ইতিহাস হয়ে থাকবে। দেশবাসীকে ছেড়ে যাবো না। আমি আপনাদের সাথেই আছি, আপনাদের সাথেই থাকব।’
বিগত ৩৬ বছরের রাজনৈতিক জীবনে বেগম খালেদা জিয়া অনেকবার নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাকে গ্রেফতার করে। তাকে সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপন করা বিশেষ কারাগারে রাখা হয়। উল্লেখ্য, ওই সময় অনুরূপ কারাগারে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের আদেশে মুক্ত হন খালেদা জিয়া। অনুরূপভাবে তারেক রহমানও কারা নির্যাতনের পর হাইকোর্টের আদেশে চিকিৎসার জন্য ব্রিটেনে যান। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বেশ কয়েকবার তিনি আটকাদেশের মুখোমুখি হন। ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে এবং ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর আটক হন তিনি। ১৯৮৭ সালের হোটেল পূর্বাণীতে এক অনুষ্ঠান থেকে আটক করে আরো কয়েকজন নেতার সাথে তাকে মতিঝিল থানায় নেয়া হয়। সে সময় পুলিশ তাকে জেলে পাঠায়নি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের কিছু সময় তাকে একরকম গৃহবন্দী করা হয়।
আওয়ামী লীগ শাসন আমলের বিগত এক দশকে তিনি সবচেয়ে বেশি নিগ্রহের মুখোমুখি হন। তাকে সেনানিবাসের বাসা থেকে অপমানজনকভাবে বিদায় করা হয়। ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর গুলশানের বাসায় অবরুদ্ধ করা হয়। ওই সময় তার একটি জনসভায় বক্তৃতা দেয়ার কথা ছিল। ২০০৫ সালের ৫ জানুয়ারি তার গুলশানের কার্যালয়ের দুই পাশে বালু বোঝাই ট্রাক রেখে তাকে কার্যত গৃহবন্দী করা হয়। সরকারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য এই ব্যবস্থা নেয়া হয়। ৯৩ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আদালতে হাজিরা দেয়ার পর তাকে বাসায় ফিরতে দেয়া হয়। এ সময় ‘ট্রাকের চাকায় পিষ্ঠ গণতন্ত্র ’ অভিধাটি জনপ্রিয়তা লাভ করে।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অন্যায় অত্যাচার থেমে থাকেনি। দল হিসেবে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য স্বৈরাচার এরশাদ নিপীড়ন ও বিভাজনের নীতি অনুসরণ করেছিল। তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার জেল জুলুমের সাথে নকল বিএনপি তৈরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান সরকার প্রথম থেকে বিগত প্রায় এক দশক ধরে শুধু হামলা-মামলা, জেল-জুলুম করেই ক্ষান্ত হয়নি, অসংখ্য নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। এখন তারা বিএনপিকে ভাগ করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে। এতে অতীতে লাভ হয়নি। বর্তমানেও হবে না। যারা অবৈধভাবে হিরো হতে চেয়েছেন, তারা সবাই জিরো হয়েছেন। বেগম খালেদা জিয়া এ ধরনের লোকদের সতর্ক করেছেন। দ্বিতীয়বার ক্ষমা করা হবে না বলেও সাবধান করেছেন। আমাদের বিশ্বাস বিএনপিতে এখন আর এরকম লোক নেই। শত অন্যায় অত্যাচার করেও বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। বর্তমান রায়কে কেন্দ্র করে বিএনপি-জামায়াতের অসংখ্য নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছে গণগ্রেফতার। পুলিশ বলেছিল যারা প্রিজন ভ্যানে আক্রমণ করেছিল তাদেরই ধরা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে রাজধানীসহ সর্বত্র জেলা উপজেলা পর্যায়ে গণগ্রেফতারি চলছে। সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, ‘তাহলে কি ঢাকার বাইরে থেকে তারা রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে পুলিশের ওপর হামলা করেছিল?’ শুধু তাই নয়, গ্রামে গ্রামে আওয়ামী লীগ তালিকা তৈরি করছে। তালিকা ধরে পুলিশ গ্রেফতারবাণিজ্য করছে। শাসক দলকে এটা মনে করিয়ে দেয়া যায় যে, অত্যাচার-অনাচার কোনো কালেই কোনো শক্তিধর শাসককে রক্ষা করতে পারেনি।
বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো সরকারের একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি। বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। দেশের যে কয়টি নির্বাচনে যতটি আসন থেকে বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচন করেছেন, কোনো দিন কোনো পর্যায়ে তিনি পরাজয় বরণ করেননি। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপিতে আনুষ্ঠানিক যোগদানের পর বিএনপি পুনরুজ্জীবন লাভ করে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সেই সময়ে বিশেষত যুবসমাজের মধ্যে বেগম খালেদা জিয়ার সম্মোহনী নেতৃত্ব লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশে এর আগে গৃহীত বিভিন্ন জনমত জরিপেও খালেদা জিয়ার অপূর্ব জনপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায়। শহীদ জিয়াউর রহমানের উত্তরাধিকারকে তিনি যথার্থভাবে ধারণ করেন। শহীদ জিয়াউর রহমান যেমন একজন সামরিক শাসক হয়েও বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেন, ঠিক তেমনি বেগম খালেদা জিয়া এরশাদ অপহৃত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেন। ১৯৯০ সালে জাতীয় সমঝোতাকে মর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্রপতি সরকারব্যবস্থার পরিবর্তে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করেন। বিগত দশ বছর ধরে তিনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে নিরলস নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। তাই তিনি হয়ে দাঁড়িয়েছেন গণতন্ত্রের প্রতীক।
বেগম খালেদা জিয়ার বিগত প্রায় চার দশকের রাজনীতিতে তিনি প্রতিবেশী বা কোনো পরাশক্তির সাথে আপস করেননি। তাই বাংলাদেশের আপামর জনগণ তাকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক বলেই বিশ্বাস করে। আর এ দুটো কারণেই বেগম খালেদা জিয়াকে শাসকগোষ্ঠীর সবচেয়ে বেশি ভয়। ক্ষমতাসীন দল নিজেদের স্বাধীনতার মালিক মোখতার বলেই মনে করে। কিন্তু জনগণ অবিশ্বাস্য রকম বিরোধী তাদের। এই নীরব জনগোষ্ঠী বারবার জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে তার প্রমাণ রেখেছে। সুতরাং ক্ষমতাসীন দল বেগম খালেদা জিয়া এবং তার দল বিএনপিকেই তাদের চিরস্থায়ী ক্ষমতার পথে একমাত্র কাঁটা মনে করে। ২০১৩ সালে ৫টি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে যখন বিএনপির ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ তখন ক্ষমতাসীন সরকার ক্ষমতার জোরে, শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে যেকোনো মূল্যের বিনিময়ে ক্ষমতায় যাওয়ার এবং বিএনপিকে ক্ষমতায় না যেতে দেয়ার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন বোগাস নির্বাচন এ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফলাফল। এ বছরের ডিসেম্বরে ঘোষিত জাতীয় নির্বাচন ক্ষেত্রে বেগম খালেদা জিয়া নেতৃত্ব এবং বিএনপির জনপ্রিয়তাই আওয়ামী লীগের সামনে একমাত্র চ্যালেঞ্জ। ইতোপূর্বে তারা এরশাদ এবং অন্য বিরোধীদের ‘গৃহপালিত জীবে’ পরিণত করেছিল। বিএনপিকে দিয়ে তা সম্ভব নয়। সুতরাং খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে নির্বাসন দেয়ার জন্যই এই মামলা, এই রায়।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, ‘এ নির্বাচনকে সামনে রেখেই সরকারের যত আত্মঘাতী খেলা এবং এ খেলায় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আইন আদালত।’ এ পর্যবেক্ষণের পক্ষে প্রামাণ্য ঘটনা হিসেবে উপস্থাপিত হতে পারে রায়ের তারিখ ৮ ফেব্রুয়ারি ঘিরে সরকারি তৎপরতা। বরাবরের মতো এবারো রায়ের দিন পালিত হলো- অঘোষিত সরকারি হরতাল। ঢাকার প্রবেশপথগুলো বন্ধ করে দেয়া হলো। সব যানবাহনকে চলাচল না করার নির্দেশ দেয়া হলো। সরকারি সমর্থক পরিবহন মালিক শ্রমিকরা তাদের ঘোষিত ২০ হাজার পাহারাদার বসিয়ে মানুষের গমনাগমন প্রতিরোধ করেছে। এভাবে তারা সারা দেশে বিভীষিকা ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। সরকারের এ অন্যায় কার্যব্যবস্থায় নিদারুণ কষ্ট হয়েছে সাধারণ মানুষের। ‘একটি মামলার রায়কে কেন্দ্র করে সবকিছু বন্ধ করে দেয়া কেবল বেআইনি নয়, অমানবিকও।’ যেখানে সরকারের দায়িত্ব জীবন সচল রাখা, সেখানে তারা সবকিছু অচল করেছে। এ যেন নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা।
খালেদা জিয়ার মামলার রায় বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কোনো নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রথম কারাদণ্ড। এটি যদি সত্যি সত্যি একজন দুর্নীতিবাজ নেতার বিরুদ্ধে হতো, তা হলে মানুষ খুশি হতো। কিন্তু এটি এমন একজনের বিরুদ্ধে, যার নামে বিগত প্রায় ৪০ বছরে কোনো বদনাম শোনা যায়নি। দেশে এবং বিদেশে এই মামলার রায় একটি রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি হিসেবে গৃহীত হবে। যেহেতু নির্বাচন সমাগত, আর বেগম খালেদা জিয়া হচ্ছেন সরকারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী; সুতরাং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবে এটি সর্বত্র প্রমাণিত হবে। বিএনপি চেয়ারপারসন যখন কারাদণ্ডাদেশ শুনছেন তখন তার প্রতিপক্ষ নির্বাচনী জনসভায় ভাষণ দিচ্ছেন। বেগম খালেদা জিয়া শাস্তি ঘোষণার পরও থেকেছেন অবিচল এবং ধীরস্থির। তিনি জনগণকে শান্তিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যেতে বলেছেন। দায়িত্বশীল রাষ্ট্রনেতা হিসেবে শাসক আওয়ামী লীগের প্রতি হুমকি ও নির্যাতনের পথ পরিহার করে শান্তি ও গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি শাসক দলের শুভবুদ্ধির উদয় কামনা করেছেন। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতে অস্থির, উদ্বেগ, ব্যাকুল এবং আবেগাকুল না হয়ে সবার উচিত ধৈর্য ধারণ করা। জেলের পথে এটাই ছিল তার সর্বশেষ উচ্চারণ। সবার উচিত দেশনেত্রী প্রদত্ত উপদেশ মেনে অগণতান্ত্রিক পথে অগ্রসর না হওয়া। বরং ক্ষোভকে শক্তিতে পরিণত করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রামে নিজের অর্থ, সময় ও শ্রম ব্যয় করে জাতির গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা। এভাবে আমাদের রক্তের বিনিময়ে যদি গণতন্ত্র মুক্তি পায় তাহলে মুক্তি পাবে খালেদা জিয়া, মুক্তি পাবে স্বাধীনতা এবং মুক্তি পাবে বাংলাদেশ।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: নয়াদিগন্ত