মুসাফির রাফি
সকাল থেকে দেশে বিদেশে বসবাসরত ষোল কোটি মানুষ তাকিয়ে ছিল ঢাকার বকশীবাজারের আদালতের দিকে। অবশেষে জানা গেল সেই রায়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে বিতর্কিত দুর্নীতির মামলায় ৫ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।
বেগম খালেদা জিয়া আপোষহীন গনতন্ত্রকামী নেত্রী। কোন আমলেই আপোষ করার কোন অভিযোগ নেই তার বিরুদ্ধে। আওয়ামী আমলের বর্বরতার বিরুদ্ধে বিশেষ করে শরীক দলের শীর্ষ নেতাদেরকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করার পর প্রতিবাদ না জানানোয় এবং বিগত আন্দোলনগুলোতে ব্যর্থতার জন্য দায়ী বিএনপির বেঈমান নেতাদেরকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় অনেকে বেগম জিয়ার সমালোচনা করেন। এগুলোর সবই তার সীমাবদ্ধতা। তবে একই সংগে এটাও ঠিক যে, শত ষড়যন্ত্র আর চাপকে উপেক্ষা করে তিনি ২০টি দলের মাধ্যমে জোট প্রতিষ্ঠা করে দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীকে এক রেখে তিনি এখনো নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন।
আমি মনে করি, এই পর্যন্ত বিএনপির পাল্লায় যেই ব্যর্থতা জুটেছে, তার দায় খালেদা জিয়ার একার নয়, বরং তার দলের অন্যন্য নেতাদের। কারন আওয়ামী লীগের ১০ বছর এবং তার আগের দুই বছর জরুরী অবস্থার সরকারের সময় ব্যক্তিগতভাবে ৭৩ বছর বয়সী খালেদা জিয়া যেই স্যাক্রিফাইস করেছেন তার কোন তুলনা সাম্প্রতিক সময়ের রাজনীতিতে মেলা ভার।
দল মাঠে না নামলেও তিনি মাঠে নেমেছেন, নামতে চেয়েছেন বারবার। এই বয়সের একটা বিধবা নারী যাকে স্বামীর দেয়া বাড়ী থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, তাতেও তিনি দমে যাননি। দুই ছেলেকে মেরে অক্ষম বানিয়ে দেয়া হয়েছে, তিনি ভেঙ্গে পড়েননি। ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি থেকে বহুদুরে একা একটি বাড়ীতে এই বয়সের একটি মহিলা মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কিভাবে বাস করেন সেটা ভাবলে গা শিহরিত হয়ে উঠে। বিগত আন্দোলনে দলীয় অফিসে আটকা পড়ে ছিলেন দুই মাসের বেশী সময়। সরকার ঠিকমত খাবার দিতে দেয়নি, লোকজনকে সাক্ষাত করতে দেয়নি। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে দিনের পর দিন। তবুও এই নেত্রী আপোষ করেননি। দুই ছেলের মধ্যে একটি ছেলে মারা গেল সেই অবরোধের সময়। ছেলের লাশ দেখলেন নিজের বাড়ীতে নয়, পার্টি চেয়ারম্যানের অফিসে। এরপরও আন্দোলন থেকে সরে যাননি। বুকে পাথর বেঁধে আবারও এসেছেন জনতার দাবী নিয়ে জনতার কাতারে।
কয়েকদিন আগে গেলেন লন্ডন, বড় ছেলে তারেক জিয়ার কাছে। তখনও আজকের যেই মামলায় তাকে কারাদন্ড দেয়া হলো, সেই মামলাটি চলছিল। কোর্ট থেকে তার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে নানা ধরনের হুমকিও দেয়া হচ্ছিল। অনেকেই ধারনা করছিলেন, এই মামলায় যেহেতু শাস্তি হবে নিশ্চিত; হয়তো খালেদা জিয়া আর লন্ডন থেকে ফিরবেন না। কিন্তু সবার সেই ধারনাকে মিথ্যা প্রমান করে আবারও তিনি দেশে ফিরে এলেন, প্রমান করলেন তিনি ভীত নন মোটেও।
খালেদা জিয়ার এই আপোষহীন মানসিকতাই হয়তো তাকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। আজ আদালতে যাওয়ার সময় শুধু বিএনপি, ছাত্রদল বা যুবদল নয়, সাধারন মানুষ যেভাবে রাজপথে নেমে এসে তার বহরকে সঙ্গ দিয়েছে, এগিয়ে দিয়েছে তাতে পরিস্কার বোঝা গেছে, জনগন তার সাথেই আছে। জনগন বুঝিয়ে দিয়েছে যে, তারা সকলেই জানে এই মামলাটি ভুয়া মামলা এবং অন্যায্যভাবেই বেগম জিয়াকে দন্ড দেয়া হচ্ছে।
আজ জনগনের এই স্বতস্ফুর্ত সাড়া খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম সেরা অর্জন। কেননা বিপুল সংখ্যক আইনশৃংখলা বাহিনীর উপস্থিতিকে তোয়াক্কা না করে যেভাবে মানুষ তাকে ভালবেসে রাজপথে নেমেছে, ভয়কে জয় করেছে, তা আগামী দিনের বাংলাদেশের রাজনীতির গুনগত পরিবর্তনই ইংগিত করে। সরকারী ইশারায় মামলার রায়ে তিনি হেরে গেলেও আপোষহীন নেত্রী হিসেবে আজ বিজয়ীর আসনে খালেদা জিয়া; একথা নি:সন্দেহে বলা যায়।
আর এভাবে অন্যায্যভাবে শাস্তি দিয়ে জনগনের কাছে হেয় হবে সরকার। এই মানের একজন নেত্রী, সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রীকে এভাবে পরিত্যক্ত একটি কারাগারে পাঠিয়ে, একাকী আটকা রেখে আওয়ামী লীগ কতটা লাভবান হবে জানিনা, তবে বাংলাদেশের গনতন্ত্র হুমকির মুখে পড়বে। দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা এই দেশটাকে নিয়ে গেম খেরার আরো সুযোগ পাবে। পরাশক্তিগুলো দেশের মানুষের ঘাড়ের উপর আরো তীব্রভাবে চেপে বসবে। মজলুম জনগন আগেও একা ছিল, এখন আরো একা হয়ে যাবে। তাই খালেদা জিয়ার মামলায় পরাজিত হয়েছে বাংলাদেশ, সংকটে পড়েছে দেশের রাজনীতি।
অনাচারের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে আমাদের নেতৃবৃন্দ মুক্ত হবেন, জনগনকে মুক্ত করবেন, দেশ ও জাতিকে এই ভয়ংকর দম বন্ধ করা পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করবেন, সেই প্রত্যাশায় এখনো জেগে আছে বাংলার নিপীড়িত মানুষ।