অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
মাদরাসা শিক্ষাকে কটাক্ষ করে ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামালের সাম্প্রতিক এক বক্তব্য নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে কটাক্ষ করার পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের অতিমাত্রায় ভর্তি হওয়াকে অগ্রহণযোগ্য বলেছেন এই অধ্যাপক। এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।
মেসবাহ কামাল বলেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন একটি উচ্চতর মাদরাসায় পরিণত হয়েছে। ভর্তি পরীক্ষায় মাদরাসার ছাত্রদের সাথে কম্পিটিশন করে স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা জায়গা পাচ্ছে না। আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬০ ভাগেরও বেশি ভর্তি হয় মাদরাসার ছাত্রছাত্রীরা। এটা কোনভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরিক্ষায় সর্বমোট ২০০ নাম্বারের পরিক্ষা হয়। এর মধ্যে যাদের এসএসসি আর এইচএসসি দুইটিতেই জিপিএ ফাইভ থাকে তারা মোট ৮০ নাম্বার আগে থেকেই পেয়ে যায়। বাকি ১২০ নাম্বার পরিক্ষা দিয়ে অর্জন করতে হয়। আর এখানেই প্রতিযোগিতাটা হয়। কারণ যারা পরিক্ষা দেয় তাদের অধিকাংশেরই নাম্বার ৮০ এর মধ্যে ৭০-৮০ এর মধ্যে থাকে।
মেসবাহ কামাল তার বক্তব্যে মাদরাসা শিক্ষাকে কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘মাদরাসায় ছাত্রদেরকে নাম্বার দেয়া শুরুই হয় বোধহয় ৯০ থেকে। পারলে ১০০ এর মধ্যে ১০০ এর চেয়ে বেশি দিয়ে দেয়। তাই মাদ্রাসার ছাত্ররা এমনি এমনি ৮০ পেয়ে যায়। আর স্কুলে আমাদের সন্তানরা যারা পড়ে তাদেরকে অনেক সংগ্রাম করে নাম্বার পেতে হয়!’
তার এই বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, যদি মাদ্রাসায় সত্যিই নাম্বার ৯০ থেকে শুরু হয়, তাহলে ২০১৭ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অন্যান্য বোর্ড থেকে মাদ্রাসা বোর্ডের রেজাল্ট তুলনামূলক খারাপ কীভাবে হয়? ২০১৭ সালের এসএসসি পাসের হার নিচে তুলে ধরা হলো-
রাজশাহীতে পাসের হার ৯০.৭০ শতাংশ।
ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৮৬.৩৯ শতাংশ।
চট্টগ্রাম বোর্ডে পাসের হার ৮৩.৯৯ শতাংশ।
দিনাজপুর বোর্ডে পাসের হার ৮৩.৯৮ শতাংশ।
যশোর বোর্ডে পাসের হার ৮০.৪০ শতাংশ।
কারিগরি বোর্ডে (ভকেশনাল) পাসের হার ৭৮.৬৯ শতাংশ।
মাদ্রাসা বোর্ডে (দাখিল) পাসের হার ৭৬.২০ শতাংশ।
[তথ্যসূত্র: দৈনিক প্রথম আলো ৪ মে, ২০১৭]
যদি মাদরাসায় ৯০ থেকেই নাম্বারিং শুরু হয়, তাহলে ২৪ শতাংশ ফেল করে কীভাবে? ১০০%-ই তো জিপিএ ফাইভ পাবার কথা। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৪ বছর অধ্যাপনা করা একজন প্রফেসরের মুখে এমন অসত্য কথা শুধু লজ্জার না, ঘৃণারও যোগ্য।
বিশ্লেষকদের মতে, এসএসসি এইচএসসিতে এখন প্রশ্ন ফাঁস করে এ প্লাস পাওয়া তো হাতের মোয়া। ‘আই এম জিপিএ ফাইভ’ প্রজন্মের অবস্থা পুরো জাতি দেখেছে। স্কুলের বইয়ের মান, কোয়ালিটি দিনকে দিন শুধু কমছেই। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মান এক্ষেত্রে কিছুটা হলেও স্কুল শিক্ষার্থীদের চেয়ে এগিয়ে। যার দরুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে তারা এগিয়ে। অধ্যাপক সাহেব এই দিকটা তুলে না ধরে নিজের সেক্যুলার আদর্শের দরুন মাদরাসা শিক্ষাকে কটাক্ষ করে নিজেকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।
মেসবাহ কামাল বলেছেন, ‘মাদ্রাসা ছাত্রছাত্রীদের ইংরেজীর ভিত্তি এত খারাপ, মাদ্রাসায় যে ইংরেজী পড়ে আসে সেটা হচ্ছে ক্লাস ফোরের সমমান। ইংরেজীতে দক্ষতা বিহীন মাদরাসার ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হয়ে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে টেনে টেনে নীচে নামিয়ে নিয়ে আসছে।’
https://www.youtube.com/watch?v=fbzyLdqwpVs
এই বক্তব্যের সমালোচনা করে অনেকে বলেছেন, এসএসসিতে জিপিএ ফাইভ পাওয়া শিক্ষার্থী যখন আমি জিপিএ ফাইভ পেয়েছিকে ইংরেজিতে ‘আই অ্যাম জিপিএ ফাইভ’ ট্রান্সলেট করে, তখন কি আমরা জেনারেলের সব শিক্ষার্থীকেই এর দ্বারা মূল্যায়ন করবো? তাদের মতে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা স্কুল শিক্ষার্থীদের চাইতে ইংরেজিত কিছুটা কম দক্ষ এটা ঠিক। কিন্তু মাদরাসা শিক্ষার্থীরা একই সাথে বাংলা, ইংলিশ, আরবি এবং উর্দু শেখার চেষ্টা করে। ১৮-১৯ বছরেই চারটা ভাষা নিয়ে নাড়াচড়া করা সহজ কিছু না। জেনারেল লাইনে দুইটা ভাষা শিখতেই যেখানে শিক্ষার্থীদের গলদঘর্ম অবস্থা।
জানা যায়, এই মেসবাহ কামালের পরামর্শেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তির জন্য ইংরেজিতে কন্ডিশন মার্কস করা হয়েছিলো ১৭/১৮। পরে সেই সেশনে শিক্ষার্থী পেতে সমস্যায় পড়ে বিভাগটি। ফলে পরের বছর থেকে কন্ডিশন মার্কস কমানো হয়। প্রশ্ন হলো, তিনি যেই স্কুল শিক্ষার্থীদেরকে ইংরেজিতে দক্ষ বলছেন, তারা সেই বিভাগে ভর্তি হতে পারেনি কেনো? মাদরাসা শিক্ষার্থীরা না হয় ইংরেজিতে খারাপ, কিন্তু স্কুল শিক্ষার্থীরা ইংরেজির সেই কন্ডিশন মার্কস পায়নি কেনো?
বক্তব্যের পুরোটা সময় মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি চরম বিদ্বেষ প্রকাশের পর সর্বশেষ তিনি মাদরাসা শিক্ষাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনিয়ির মাদরাসায় পরিনত হবে এবং গোটা দেশটা মাদ্রাসার কাছে জিম্মি হয়ে যাবে এটা আমি মনে করি না, বরং মাদরাসাকে মূলধারায় আনতে হবে। মাদরাসা শিক্ষাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, আসলে এদের গাত্রদাহ হচ্ছে, যখন এরা দেখছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের ৬০ ভাগ সিট মাদ্রাসার ছেলেরা দখল করে নিচ্ছে। আর সেটা জেনারেল ছেলেদের সাথে প্রতিযোগিতা করেই। ড. মেসবাহ এর মতো মানুষেরা আসলে সেক্যুলার পরিবেশে ধর্মীয় আধিপত্য দেখে ভয় পেয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে মেসবাহ কামালের বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাও। ড. মাসুম সরকার আল আজহারী নামে এক মাদরাসা পড়ুয়ার ফেসবুক স্ট্যাটাসের কিছু অংশ অ্যানালাইসিস বিডির পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো:
“ড. সাহেব, আপনার জানা থাকার কথা, “I am GPA 5” কিন্তু কোন মাদ্রাসা পড়ুয়া বলেনি। আপনাদের সন্তান বলে আপনি যাদেরকে বুঝাচ্ছেন এটা তাদের মুখের ইংলিশ। আপনার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই খোজ নিয়ে দেখেন, মাদ্রাসার ছাত্ররা একাধিক বার এডমিশন টেস্টে ইংলিশে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েছে ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কত জন মাদ্রাসা পড়ুয়া এ পর্যন্ত ইংলিশে অনার্স- মাস্টার্স করেছে তার হিসেব আপনার জানা থাকার কথা। ইংরেজি বিভাগে ভর্তির সুযোগটা একটু উন্মুক্ত করে দিয়ে দেখুন মাদ্রাসার ছাত্ররা কী চমক দেখাতে পারে।
আপনি জেনে আবাক হবেন যে, মাদ্রাসার ছাত্ররা হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকেও ডিগ্রী নিচ্ছে। তাই মাদ্রাসার ছাত্ররা আপনার মতো ডক্টরদের ইংরেজি শিখাতেও পারবে। তার সাথে বাংলা, আরবি ও উর্দু বোনাস পাবেন। আপনি যেখানে মাত্র একটি বিদেশী ভাষা শিখতেই গলদঘর্ম হয়ে পড়েন, সেখানে মাদ্রাসার ছাত্ররা একই সাথে ৩টি বিদেশী ভাষা চর্চা করে থাকে।
আপনার জ্ঞাতার্থে আরো বলতে চাই, ভাষার জ্ঞানই কেবল প্রকৃত মেধার পরিচয় বহন করে না। ব্রিটেন, আমেরিকা, কানাডাসহ বিশ্বের অনেক দেশের গৃহপালিত কুকুরও প্রয়োজনীয় ইংলিশ বুঝে। তাই বলে ওরা কিন্তু…..
আর আপনার শ্রদ্ধেয় পিতা মনজুর সাহেবও নাকি একজন মাদ্রাসা পাস ছিলেন। যদি তাই হয়, তাহলে একজন মাদ্রাসা পড়ুয়ার হাতেই কিন্তু আপনার লেখা-পড়ার হাতেখড়ি।
সারকথা হলো, ভাল-মন্দ মাদ্রাসা-স্কুল-কলেজ সব জায়গায়ই আছে। তাই আপনাদের মতো উচ্চ শিক্ষিতদের কাছে এ ধরণের একপেশে বক্তব্য জাতি কখনো প্রত্যাশা করে না।”