মিজানুর রহমান খান
পুলিশ ডাকলে যদি স্বায়ত্তশাসন নষ্ট হয়, তাহলে পুলিশের কাজ ছাত্ররা করলে স্বায়ত্তশাসন নষ্ট হবে না কি? দুই দল ছাত্র কমবেশি বা তুলনার অযোগ্য পাল্টাপাল্টি সহিংস আচরণ করেছে। ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সহিংসতা আর অন্যায় দমনে সহিংসতা-কোনোটিই আইন সমর্থন করে না। কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং সেটা যখন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে ঘটে, তখন সেই প্রতিষ্ঠানটি দুই বিবদমান গোষ্ঠী থেকে দূরত্ব বজায় রেখে কীভাবে নিজেদের নিরপেক্ষতা রক্ষা করার চেষ্টা করেছে, সেটা বিচার করা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়।
যে সহিংসতা ঘটে গেছে, সেখানে তিনটি পক্ষ থাকার কথা। দুই দলের বিবদমান ছাত্র, যাদের সঙ্গে বহিরাগতদের যোগসাজশ থাকতে পারে, এর বিপরীতে থাকবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। যারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার চেষ্টা করেছে বলে জনগণের কাছে প্রতীয়মান হবে। কিন্তু ভিসি, তাঁর প্রশাসন ও ছাত্রলীগ কার্যত একাকার হয়ে গেছে বলে মনে হয়।
কদিন আগেই ডাকসু নির্বাচন ছয় মাসের মধ্যে করার একটা নির্দেশনা হাইকোর্ট দিয়েছেন। আমরা দীর্ঘকাল ডাকসু নির্বাচন চাইছি। কিন্তু আমরা আশঙ্কা করি, যে উদ্দেশ্যে আমরা বিকল্প নেতৃত্বের পথ সুগম করে দিতে ডাকসু চেয়েছি, সেখানে যদি ন্যূনতম মৌলিক পরিবেশ না থাকে, তাহলে এই ডাকসু নির্বাচন আমাদের কী দেবে? আমরা জাতীয় সংসদের গঠনে যে দৃশ্য দেখি, তেমন একটি দৃশ্য কি আমরা ডাকসুতেও দেখতে পাব?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সামনে একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ বলে মনে হয়। আর সেটা হলো তাদের এটা প্রমাণ করা যে ছাত্রদের সংগঠন বা যেকোনো ছাত্রগোষ্ঠীর প্রতি তারা নিরপেক্ষ। কোনো ধরনের পক্ষপাতের যদি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটে, তাহলে আর রক্ষে নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সুচিন্তিতভাবে পুলিশি সাহায্য না নিয়ে, প্রকারান্তরে ছাত্রলীগের ক্যাডারদের সাহায্য নিয়েছিলেন কি না, সে বিষয়ে তাদের কাছ থেকে একটি বিবৃতি প্রত্যাশিত। কারণ, ভিসির অবরুদ্ধ বা আক্রান্ত হওয়া-কোনোটিই আকস্মিক ছিল না। অনেকেই সন্দেহ করতে পারেন, ভিসি ও তাঁর সতীর্থরা স্বায়ত্তশাসনের তথাকথিত মর্যাদা রক্ষায় হয়তো সাধারণ ছাত্রদের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবহার করতে চাননি। কিংবা ওটা তুলনামূলক বেশি ঝামেলাপূর্ণ মনে করেছিলেন।
ঘটনাটি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিবৃতি আমাদের ব্যথিত, ক্ষুব্ধ ও বিচলিত করেছে। সেটা আন্দোলনকারীদের আন্দোলনের বৈধতা প্রত্যাখ্যান করার জন্য যতটা নয়, তার থেকে অনেক বেশি জোরালো এ কারণে যে তারা তাদের রেফারির ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তাই তারা বলেছে, ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বহিরাগত বাম সন্ত্রাসীদের সংঘাত হয়, আর তাতে যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নষ্ট না হয়, সে জন্য ছাত্রলীগ দুই পক্ষকেই নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।’ এই ‘মান’ রক্ষার একটা লোক দেখানো তাগিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন অনুভব করেছে, সেটা বিবৃতি প্রমাণ করে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জন্য গভীর লজ্জার বিষয় প্রধানত দুটি। এক. ভিসি তাঁর জীবন রক্ষায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সাহায্যের ওপর নির্ভর করেননি। দুই. পক্ষপাতদুষ্টভাবে শুধু আন্দোলনকারীদের অভিযুক্ত (হয়তো যথার্থই করেছেন) করা এবং ছাত্রলীগের ব্যানার ব্যবহার করে যারা সন্ত্রাস করেছে, তাদের বিষয়ে টুঁ-শব্দ উচ্চারণ না করা। তিন. অসত্য তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের কৌশল ও ভিসির কৌশল অভিন্ন বলে প্রতীয়মান হতে দেওয়া। উভয়ে বলেছে, সহিংসতা ও সন্ত্রাস, সেটা নির্মম, সহিংস, পাল্টাপাল্টি হামলা ও মারধর কিংবা কলাপসিবল গেট ভেঙে ফেলা, যেখানে যা হয়েছে, তা করেছে, যথাক্রমে ‘বহিরাগত বাম সন্ত্রাসী’ ও ‘সহিংস ও বহিরাগত যুবক’। এর মাধ্যমে তারা নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের সম্ভাব্য রোষ থেকে নিজেদের বাঁচাতে চেয়েছে, আর পুলিশ বাহিনীর যথাদায়িত্ব পালনকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে। তদন্ত ছাড়াই দোষী কারা, তা ছাত্রলীগ না হয় বলে দিল, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কীভাবে পারল? এরপর কোনো প্রশাসন থাকে?
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ছাত্রলীগ কী করেছে? উপাচার্য বলেছেন, ছাত্রলীগের ছেলেমেয়েরা যদি এসে উদ্ধার না করত, তাহলে তাঁর জীবনের ওপর হামলার আশঙ্কা ছিল। তবে একই সঙ্গে তিনি এও বলেছেন, ‘ছাত্রলীগ অন্যায় করলে তার শাস্তি হবে।’ এখন প্রশ্ন হচ্ছে ওবায়দুল কাদের উপাচার্যের বরাতে যা বলেছেন তা সঠিক হলে ছাত্রলীগ কি অন্যায় করেছে? তারা তো বরং উপাচার্যকে একদল ‘বহিরাগত সন্ত্রাসীর’ কবল থেকে রক্ষা করেছে। ওরা বীর, পুরস্কারপ্রাপ্য!
যদি আমরা ধরে নিই, ভিসির বয়ান সত্য তাহলে প্রশ্ন উঠবে, তিন ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পরে ভিসি কোন ভরসায় পেছনের দরজা দিয়ে নিষ্ক্রান্ত হতে উদ্যোগী হয়েছিলেন? আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রলীগের আনুষ্ঠানিক বিবৃতির মধ্যে উদ্বেগজনক মিল পাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি বলেছে, ভিসির প্রতি বলপ্রয়োগ ও আক্রমণ করলে ‘মানববলয়’ তৈরি করে তাঁকে ভিসি কার্যালয়ে ফিরিয়ে আনা হয়। ছাত্রলীগও তাই বলেছে।
ঠিক ওই নাজুক মুহূর্তে ভিসি বেরোনোর ‘সাহসী সিদ্ধান্ত’ নিলেন কেন? তিনি ও তাঁর সতীর্থদের জানার কথা ছিল, বেরোতে চাইলে তিনি অপেক্ষমাণ ‘উচ্ছৃঙ্খল’ কিংবা বিদ্রোহী ছাত্ররা তাঁকে ঘিরে ধরতে পারে। তাহলে তাঁকে রক্ষা করার একটা আগাম ভরসা তিনি পেয়েছিলেন। ভিসি নিজেকে বৈধভাবে রক্ষায় আইনের আওতায় আদৌ কিছু করেছিলেন কি না, সেটা তাই এক জরুরি প্রশ্ন।
একদল ‘সহিংস বহিরাগত’, যারা তাঁরই ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে মারমুখী হয়ে আছে, তাদের মোকাবিলায় তাঁকে আমরা ‘মানবঢাল’ গঠন করেও বেরোতে দেখিনি। বরং আমরা দেখলাম ‘আক্রান্ত’ হওয়ার পরে তাঁরা যাকে ‘মানববলয়’ বলেছেন, তাদের পেলব স্পর্শে মেডিকেলে আর্তনাদ ধ্বনিত হয়েছিল। ভিসি ভেবেচিন্তে পুলিশের সাহায্য নেননি। উচ্ছৃঙ্খল বহিরাগতদের তরফে সম্ভাব্য আক্রমণ মোকাবিলায় নিরস্ত্র সহকর্মী ও ছাত্রদের ওপর তাঁর শতভাগ নির্ভরশীল থাকার কোনো কারণ ছিল বলে মনে হয় না।
আন্দোলনকারীরা উপাচার্যকে অন্যায়ভাবে অবরুদ্ধ করেছিল। তারা এর আগে প্রক্টরকে সাড়ে চার ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। তখন প্রক্টর ছাত্রলীগ ডাকতে পারতেন। ডেকেছেন বলে জানা যায় না। ছাত্রলীগ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে উদ্ধারে যেতে পারত, তারা তা করেনি। এখন উপাচার্যের ওই উক্তি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যা প্রকাশ করেছেন, সেটা সত্যি হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের ভবিষ্যৎ বলে আর কিছু থাকছে কি?
বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্তাক্ত ক্যাম্পাসে পুলিশ কেন? জবাব চাই-এমন স্লোগান আমরা শুনেছি। আমরা দেখেছি, পুলিশকে তার বৈধ দায়িত্ব পালনে সব দল মিলে বাধা দিয়েছে। সেটা এখন কোন পর্যায়ে আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে তার একটা ব্যাখ্যা দিতে হবে। সহিংস ছাত্ররা যা করেছে তা আইনগতভাবে সিদ্ধ নয়। যখন অপরাধ সংঘটিত হয়, তখনই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটে, তখন কার কী করণীয়, তা প্রচলিত আইনে নির্দিষ্ট করা আছে। কিন্তু আমরা তা হুকুমনির্ভর করে তুলেছি। প্রকাশ্যে অপরাধ সংঘটনের পরে অভিযুক্তকে বিচারে সোপর্দ করাই পুলিশের কাজ। কিন্তু পুলিশ ওপরের হুকুম না পেলে তারা ক্যাম্পাসে যাবে না।
কলাপসিবল গেট ভেঙে দিয়ে সহিংস ছাত্ররা যখন ‘হেক্সো ব্লেড, রড, লোহার পাইপ, ইটপাথর’ ইত্যাদি নিয়ে তিন ঘণ্টাকাল অবরুদ্ধ করেছিল, তখন ভিসির জীবনহানির বিষয়ে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। তাঁর জীবন বিপন্ন অথচ তিনি পুলিশ ডাকার ঝুঁকি নেননি। অভিযোগ আছে, তিনি টেলিফোনে ছাত্রলীগের সাহায্য কামনা করেছিলেন।
আমরা মহানগর পুলিশের বড় কর্তা, যাঁর দায়িত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা পড়ে, তাঁর কাছে একটি বিবৃতি দাবি করি। আমরা জানতে চাই, অবরুদ্ধ ভিসির নিরাপত্তায় তাঁরা কী করেছিলেন? আগের সাড়ে চার ঘণ্টা প্রক্টরকে অবরুদ্ধ করে রাখার ঘটনায় তাঁরা উদ্বিগ্ন ছিলেন কি না? ওই ঘটনায় ৫০-৬০ জন অজ্ঞাতনামা শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা ছিল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে শাহবাগ থানার একজন বড় কর্তা বলেছেন, ভিসি তাঁদের সাহায্য চাননি। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হাসানের কাছে গতকাল বৃহস্পতিবার জানতে চাইলাম, কেন আপনারা সেখানে যাননি, উত্তরে তিনি অস্ফুটে বললেন, বিশ্ববিদ্যালয় একটি ‘সিস্টেমে’ চলে। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। আসলে পুলিশ পারতপক্ষে ওই এলাকার বিষয়-আশয় এড়িয়ে চলে। সুতরাং একটি অলিখিত দায়মুক্তি সেখানে আছে। অভিযোগ আছে, ছাত্রলীগের হামলায় নিরাপত্তাকর্মী আহত হয়েছেন। তার মানে সাদাপোশাকে তারা ঠিকই ছিল। তাদের উপস্থিতিতে কারা বেশি নিরাপদ বোধ করল?
আলাবামা বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও সমাজবিদ্যার ইমেরিটাস অধ্যাপক জন জো স্লোয়ান ই-মেইলে এই লেখককে বুধবার বলেন, ‘অপেক্ষাকৃত স্বল্প পরিসরে বিপুলসংখ্যক তরুণ একত্রে থাকলে সহিংসতায় তারা জড়াতে পারে। তাই ক্যাম্পাস কোনো অপরাধমুক্ত এলাকা নয়।’ ১৮৯৪ সালে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় দুজন পুলিশ অফিসার নিয়োগ করেছিল। ১৯৬৯ সালে বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয় সশস্ত্র ক্যাম্পাস পুলিশ গড়েছে। অবশ্য ষাটের দশক থেকেই নামকরা মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্যাম্পাস পুলিশ আছে। আমরা কী করব? বিশ্ববিদ্যায় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান নীতিগতভাবে ক্যাম্পাস পুলিশ প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে কমিশন সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছে বলে তিনি জানালেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ সহিংসতায় পুলিশের কী করণীয় ছিল, সে বিষয়ে আমরা পুলিশের তরফে একটি বিবৃতি চাই। আমরা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পুলিশ টিম গড়ার কথা ভাবব, নাকি এখন থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিসিকে সুরক্ষায় মঙ্গলবারের ‘মানববলয় মডেল’ অনুসরণীয় হবে?
লেখক: সাংবাদিক
সূত্র: প্রথম আলো