টাকার অভাবে শিক্ষকদের এমপিও দিতে না পারলেও বিলাসী প্রকল্পে আগ্রহী শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নন এমপিও শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি, অবসর ভাতার জন্য অপেক্ষায় থাকা ৭০ হাজারের বেশি শিক্ষকের দাবি পূরণের চেয়ে নতুন নতুন বড় প্রকল্পের দিকে মনোযোগ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের। এসব প্রকল্পের কোনো কোনোটির কার্যকারিতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। শিক্ষা বিশ্লেষকরা এসব প্রকল্পকে বিলাসী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তারা বলছেন, মাত্র ১৭০০ কোটি টাকার জন্য বছরের পর বছরে ধরে কাঁদছেন ৭০ হাজার শিক্ষক। অথচ প্রয়োজন নেই তবুও সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে চলন্ত সিঁড়ি করতে ১১১৬ কোটি বরাদ্দ রাখা হয়।
অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের স্মার্টকার্ড দিতে নেয়া হয়েছে ৩২৯ কোটি টাকার অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প। একটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব টেলিভিশন চ্যানেল করতে ১৮৬ কোটির টাকার প্রকল্প প্রস্তাব দিয়েছে। সরকারি কলেজগুলোয় গ্রীন ক্যাম্পাস করতে বড় অংকের টাকা চাওয়া হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে। গতকাল সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আর মহীয়সী নারীদের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছে মাউশি। এটি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষকদের দাবি দাওয়া ও সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দেয়া না হলেও বিলাসী প্রকল্প নেয়াকে রহস্য হিসেবে দেখছেন শিক্ষাবিদরা। তারা বলছেন, এখানে মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে লুটপাট। যা অতীতে বিভিন্ন প্রকল্পের লুটপাটের চিত্র আইএমইডি’র প্রতিবেদন ধরা পড়েছে। অথচ এদিকে কারও নজর নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষকদের এসব কাজে আর্থিক কোনো সুবিধা নেই। বিলাসী প্রকল্প কোনোরকম পাস করিয়ে আনতে পারলেই নানা কমিশন। এজন্য সবার দৃষ্টি থাকে বিলাসী প্রকল্পের দিকে। এখানে বিশেষ মহল লাভবান হয় কী না তাও খতিয়ে দেখতে বলছেন তারা।
অন্যদিকে শিক্ষকরা সব সময় অবহেলিত। সর্বশেষ ৮ম পে স্কেল বাস্তবায়ন হলেও বেসরকারি শিক্ষকরা নানারকম বৈষম্যের শিকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একজন অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক এবং একজন অফিস সহকারীর বাসা ভাড়া ১০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা করা হয়েছে। এটি কি শিক্ষকদের জন্য সম্মানজনক, নাকি অবহেলার? একজন অধ্যক্ষের সঙ্গে একজন অফিস সহকারীর বাসা ভাড়া একই হওয়া নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
শিক্ষা খাত সংশ্লিষ্ট তিনটি বির্তকিত প্রকল্প নিয়ে সম্প্রতি প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। এর মধ্যে আছে ১১১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে এসকেলেটর (চলন্ত সিঁড়ি), সারা দেশের শিক্ষার্থীদের ট্র্যাকিং আইডি কার্ড দিতে ৩২৯ কোটি টাকার প্রকল্প এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন প্রকল্পের জন্য ১৮৬ কোটি টাকার প্রকল্পে।
অন্যদিকে এমপিও স্থগিতাদেশ, অবসর, মৃত্যু, ভুলক্রমে বেশি টাকা যাওয়া ইত্যাদি কারণে অবিতরণকৃত ৬১৪ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংকে। এই টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়ার নির্দেশ থাকলেও গত আট মাসে তা জমা হয়নি।
এদিকে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা অবসরে যাওয়ার পর তাদের অবসর ও কল্যাণ ভাতার অপেক্ষা পার করছেন বছরের পর বছর। প্রায় ৭০ হাজারের বেশি শিক্ষক আছেন এই ভাতার অপেক্ষায়। ভাতা না পেয়ে অপেক্ষায় সময় পার করে মৃত্যু হয়েছে অনেকের। অবসর ও কল্যাণ ভাতা দিতে সব মিলিয়ে দরকার ১৭০০ কোটি টাকা। গত কয়েক বছর ধরে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হলেও কোনো সুফল আসেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ প্রসঙ্গে মানবজমিনকে বলেন, শিক্ষার অনেক প্রকল্প অপ্রয়োজনীয়। তারপরও এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এগুলোর পিছনে টাকা খরচ অনেকটা অপচয়। শিক্ষকদের অভুক্ত রেখে এভাবে বিলাসী প্রকল্প নেয়া কোনো মানেই হয় না। তিনি বলেন, সরকার শিক্ষাকে গুরুত্ব দিলে শিক্ষকদের গুরুত্ব দিতে হবে। অথচ লজ্জার ব্যাপার পুরনো দাবি নিয়ে শিক্ষকরা দিনের পর দিন অনশন করে যাচ্ছেন। তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে বলেই তারা আন্দোলনে নেমেছেন। তাদের অনশন আমাদের জন্য লজ্জার। শিক্ষকদের বেতন ও ভাতা পর্যাপ্ত নয়- এটা সবাই জানি। আমি মনে করি, শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল হওয়া উচিত। একই সঙ্গে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা সুনির্দিষ্ট করে দেয়া উচিত। তাহলে আমরা মেধাবী শিক্ষক পাবো। আর ভালো শিক্ষক ছাড়া ভালো শিক্ষা পাওয়া যায় না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-এর (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, এসব বিলাসী প্রকল্প আগে, নাকি শিক্ষার মান আগে- সে বিষয়ে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শিক্ষার মান না বাড়িয়ে এসব মেগা প্রকল্প নেয়ার কতটা যৌক্তিকতা তা সরকারকে ভাবতে হবে। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মৌলিক দাবি পূরণ না করে এসব প্রকল্প হাতে নিলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে। তিনি বলেন, শিক্ষার অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে হবে কোনটা আগে কোনটা পরে করতে হবে।
মানবজমিন অবলম্বনে