অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
সাংবাদিকরা জাতির বিবেক। এটা একটা প্রচলিত কথা। এই প্রচলিত হয়তো কিছু সাংবাদিকের জন্য সত্য হতে পারে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাংবাদিকরা জাতির বিবেকের ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়। এর বড় কারণ মিডিয়া হাউসগুলোর মালিক। সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না। তার উপর সরকারি বিধিনিষেধ, চোখ রাঙানিতো আছেই।
সাংবাদিকতা হচ্ছে একটি বিশাল কর্ম। এই বৃহৎ কর্মযজ্ঞ নিপুনভাবে সম্পাদন করে থাকেন সাংবাদিক। প্রখ্যাত লেখক আবুল ফজল বলেছেন, “জাতীয় সংবাদপত্র জাতির কন্ঠস্বর, সে কন্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেয়া মানে জাতিকে বোকা বানিয়ে দেয়া।” জাতীয় আশা-আকঙ্খা, সুখ-দুঃখের প্রতিফলন ঘটে একমাত্র সংবাদপত্রেই। সংবাদপত্র সাধারণ মানুষের শিক্ষকের ভূমিকা পালন করে থাকে। গণতন্ত্রের লালন ও বিকাশের ক্ষেত্রে সরকারের চতুর্থ স্তম্ভ খ্যাত সংবাদপত্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সংবাদপত্রের গুরুত্ব অনুধাবন করে আইভান তুর্গীনিভ বলেছেন, “একটি বইয়ের একশত পৃষ্ঠা পাঠ করে যে ধারণা লাভ করা যায় একটি মাত্র ছবিতে একবার চোখ বুলালে সেই ধারণা লাভ করা সম্ভব’।
এবার আসি সাম্প্রতিক প্রসঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশ সফর করে এসে নিয়মিত একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। এটা খুবই ভালো একটি বিষয় যে, এতে তিনি বিদেশ সফরে কেন গিয়েছিলেন, কী করলেন- সেসব দেশের মানুষের জানার সুযোগ তৈরি হয়। তিনি যা বলবেন, উপস্থিত সাংবাদিকরা প্রশ্ন করে আরো কিছু বের করবেন। তিনি প্রশ্নোত্তরের জন্যেই প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় বরাদ্দ রাখেন। এটা সংবাদকর্মীদের জন্য বেশ আনন্দের খবর বটে। দেশের বিভিন্ন সার্বিক বিষয়ে সরকারের নানান চিন্তা ও পরিকল্পনা বের হয়ে আসে। যাতে জনগণের সাথে সরকারের ভুল বুঝাবুঝির অবসান হতে পারে। তাছাড়া সরকারের শীর্ষ ব্যাক্তি জানতে পারে জনগণের মনোভাব।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের প্রশ্নোত্তর পর্বটা পৃথিবীর অন্য যে কোনো সংবাদ সম্মেলনের চেয়ে একটু অন্যরকম। এখানে প্রশ্ন হয় না, হয় অন্য কিছু। তোষামোদির নতুন সব কলা নতুন সব কৌশল এখান থেকে জনগণ শিখতে পারে। এটাকে প্রশ্নোত্তর পর্ব না বলে ‘প্রধানমন্ত্রীর সাথে একটুখানি বিনোদন’ এমন নামও বলা যেতে পারে। প্রথিতযশা সাংবাদিকরা একের পর এক ভাড়ামি করে প্রধানমন্ত্রীর আনুকূল্য পাওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। মাঝে মধ্যে প্রধানমন্ত্রীকেও দেখা সাংবাদিকদের কাউকে হেয় করে হাস্যরস করতে। আর বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে তাচ্ছিল্য করে হাসির খোরাক তৈরী করা তো নৈমিত্তিক পরিবার।
কম্বোডিয়া থেকে এসে প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত গুরুতর একটি অভিযোগে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন গণমাধ্যমকে। ‘খালেদা জিয়ার পরিবার সৌদি আরবসহ বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন। সেখানে মার্কেটসহ আরো অনেক কিছুতে বিনিয়োগ করেছেন। বিদেশের গণমাধ্যমে এসব সংবাদ প্রকাশের পরও দেশের তিনটি পত্রিকা ছাড়া আর কোনো পত্রিকা সেই সংবাদ প্রকাশ করেনি।’
এই অভিযোগ এনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণমাধ্যমকে শুধু অভিযুক্তই করেননি, রীতিমতো তিরস্কার করেছেন। প্রতিটা মিডিয়ারই নিজস্ব সংবাদ নীতি রয়েছে। সে অনুসারে যাচাই বাছাই করে তারা সংবাদ প্রচার করে থাকে। প্রধানমন্ত্রী কি ঠিক করে দেবেন কী নিউজ প্রচার হবে বা হবে না? তারপর প্রধানমন্ত্রীর সেই অভিযোগের যদি ভিত্তি খুঁজে পাওয়া না যায় তাহলে তো ব্যাপারটা আরো জটিল হয়ে যায়।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘জিয়া পরিবারের ১২টি দেশে ১২শ’কোটি টাকা পাচার সংক্রান্ত ‘গ্লোবাল ইন্টিলিজেন্স নেটওয়ার্ক (জিআইএন)’ রিপোর্ট সরকারের হাতে এসেছে। এ নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্তে প্রমাণিত হলে যারা দেশের জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করে বিদেশে পাচার করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই সঙ্গে পাচারকৃত অর্থ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশে ফেরত আনা হবে।’
প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগের বাইরে যে দু’তিনটি গণমাধ্যম ব্যতিক্রমী ভূমিকা পালন করেছে তার মধ্যে সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহানের বাংলাদেশ অবজারভার একটি। বাংলাদেশ অবজারভার জিয়া পরিবারের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ পাচার বিষয়ে লিখেছে, ‘আরবভিত্তিক একটি টিভি চ্যানেলে জিআইএনকে (গ্লোবাল ইন্টিলিজেন্স নেটওয়ার্ক) উদ্ধৃত করে প্রতিবেদন উপস্থাপন করার পর পশ্চিমা দুনিয়ায় খবরটি প্রকাশ করেছে কানাডিয়ান টেলিভিশন চ্যানেল ‘দ্য ন্যাশনাল’।
বিডিনিউজ২৪ডটকম এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে লিখল, ‘প্রধানমন্ত্রীর তথ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী সম্পাদিত বাংলাদেশ অবজারভারে এই সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল গত ১ ডিসেম্বর। প্রতিবেদনের সংবাদের উৎস বলা হয়েছিল ‘গ্লোবাল ইন্টিলিজেন্স নেটওয়ার্ক (জিআইএন) এবং কানাডার টিভি চ্যানেল দ্য ন্যাশনাল এই খবর দিয়েছে।
ইন্টারনেট ঘেঁটে দ্য ন্যাশনাল নামে কানাডার কোনো টিভি চ্যানেলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। কানাডার রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলে দ্য ন্যাশনাল নামে একটি নিউজ প্রোগ্রামের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তবে সেখানে সার্চ দিয়ে খালেদা সংক্রান্ত কোনো খবর পাওয়া যায়নি। আর ‘গ্লোবাল ইন্টিলিজেন্স নেটওয়ার্ক’নামে কোনো গণমাধ্যম ইন্টারনেটে খুঁজে পাওয়া যায়নি।’
এখন যখন ‘জিআইএন’খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তখন সরকারের তথ্য, পররাষ্ট্র বা অন্য কোনো মন্ত্রণালয় বা সংস্থার দায়িত্ব বিষয়টি পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা দেয়া। সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা বলেছেন,দ্য ন্যশনাল এবং ‘জিআইএন’র অস্তিত্ব যদি থেকে থাকে, দেশের গণমাধ্যম যদি খুঁজে না পায়- তাহলে দেশের গণমাধ্যমের দৈন্যতা ফুটিয়ে তোলার জন্যও সরকারের এগিয়ে আসা দরকার।
‘আজকের বাংলাদেশ’ নামে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের একটি টকশো অনুষ্ঠানে এসব বিষয় নিয়ে ইকবাল সোবহানকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এগুলো তো ইউটিউবে এসেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এসেছে। এসব জায়গায় এসেছে যেহেতু তবে নিশ্চয়ই এসবের ভিত্তি রয়েছে’।
এই যদি হয় ইকবাল সোবহানের মত মানুষদের বক্তব্য তাহলে বাংলাদেশের মিডিয়া সম্পর্কে আমাদের নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। চাটুকারিতার সর্বশেষ সীমানা অতিক্রম করা হয়েছে। এমন প্রথিতযশা ব্যাক্তিরা মিথ্যা সংবাদ উপস্থাপন করে সাংবাদিকদের হেয় করছেন।
রাষ্ট্রযন্ত্রের নানান বিষয় থাকে। নানান অর্গান থাকে। এসব অর্গান, প্রতিষ্ঠান দিয়ে সরকার মিডিয়া নিয়ন্ত্রন করতে পারে। কিন্তু সব ধরণের নিয়ম কানুনকে উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী একটা মিথ্যা সংবাদ ছাপানোর জন্য গণমাধ্যমকে তিরস্কার করা মানে রাষ্ট্রের নগ্নরূপ প্রদর্শন করা। তাহলে সহজে অনুমেয় রাষ্ট্র কতটা বেপরোয়া। রাষ্ট্রের এই বেপরোয়া রূপ সরকার জনগণ সবার জন্যই রীতিমত ভীতিকর।
এই অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার পিছনে সরকার যতটা দায়ী তার চাইতে বেশী দায়ী চাটুকার সাংবাদিকরা। তারাই সরকার থেকে অন্যায় সুবিধা আদায় করতে গিয়ে সরকারকে এমন বেপরোয়া অবস্থানে নিয়ে এসেছে। গুম খুনের এই দেশে আজ সাহসী সাংবাদিকের বড়ই অভাব। সাহসী সাংবাদিকরা যেদিন এই পরিস্থিতির উন্নয়ন করতে না পারবেন ততদিন ‘সাংবাদিকরা জাতির বিবেক’ এই দাবীর কার্যকারিতা থাকবে না।
Discussion about this post