অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
অনলাইন পোর্টালের এই যুগে গুজবের ছড়াছড়ি চলছে সর্বত্র। ফেসবুকের মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে সেই গুজব অনেকসময় সত্যের চাইতেও শক্তিশালী হয়ে যায়। বর্তমানে তেমনি একটি শক্তিশালী গুজবের নাম সৌদি আরবে জিয়া পরিবারের কথিত সম্পদ ও শপিংমলের সন্ধান।
এই গুজব সংবাদটি প্রথমে একটি গুজবসর্বস্ব অনলাইন পোর্টালে আসলেও তেমনভাবে ভাইরাল হয়নি। এই গুজব সংবাদটি ছড়িয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাধ্যমে। সম্প্রতি এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি খালেদা জিয়া এবং তার পরিবারের সদস্যদের ‘সৌদি আরবে সম্পদ থাকার কথিত খবর’ বাংলাদেশের গণমাধ্যম এড়িয়ে যাওয়ায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সৌদি আরবে যে বিশাল শপিং মল পাওয়া গেল; এটা তো আমরা বলিনি। এই খবর দেওয়ার কোনো আগ্রহ দেখলাম না। “আমরা তন্ন তন্ন করে দেখেছি। শুধু দুটি চ্যানেল ও দুটি পত্রিকা শুধু নিউজটা করেছে।” খবরটি না ছাপানোর কারণ জানতে চেয়ে সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “এত দুর্বলতা কিসের জন্য? বিনা পয়সায় শপিং করার কার্ড পেয়েছেন?”
গত ৭ ডিসেম্বর শেখ হাসিনার এমন ধমকের সংবাদ প্রচার করতে গিয়ে বিডিনিউজ২৪ডটকম লিখেছে-
“প্রধানমন্ত্রীর তথ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী সম্পাদিত দ্য ডেইলি অবজারভারে এই খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল গত ১ ডিসেম্বর। প্রতিবেদনে সংবাদের উৎস বলা হয়েছিল, আরবভিত্তিক টিভি চ্যানেলগুলোকে উদ্ধৃত করে ‘গ্লোবাল ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক (জিআইএন)’ এবং ‘কানাডার টিভি চ্যানেল দ্য ন্যাশনাল’ এই খবর দিয়েছে।
ইন্টারনেট ঘেঁটে ‘দ্য নাশনাল’ নামে কানাডার কোনো টিভি চ্যানেলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। কানাডার রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলে দ্য নাশনাল নামে একটি নিউজ প্রোগ্রামের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, তবে সেখানে সার্চ দিয়ে খালেদা সংক্রান্ত কোনো খবর পাওয়া যায়নি। আর গ্লোবাল ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক নামে কোনো গণমাধ্যম ইন্টারনেটে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
‘বাংলা ইনসাইডার’ নামে একটি ইন্টারনেট সংবাদপত্রেও ‘খালেদার সম্পদের’ খবরটি ছাপা হয়েছে। সেখানে কোনো সূত্রের উদ্ধৃতি নেই। এই সংবাদপত্রটি ইতোপূর্বে ভুয়া খবর প্রকাশের জন্য আলোচনায় আসে।”
এছাড়া কেউ কেউ আরব নিউজের সূত্র উল্লেখ করেছে। এ ব্যাপারে সাপ্তাহিক সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা “জিয়া পরিবারের টাকা পাচার এবং” শিরোনামে পরিবর্তন ডটকম-এ লিখেন-
“আরব নিউজ’র ওয়েবসাইটে ঢুকে জিয়া পরিবারের দুর্নীতির সংবাদটি বের করার উদ্যোগ নিলাম। “জিয়া পরিবারের দুর্নীতি” “খালেদা জিয়ার দুর্নীতি” “তারেক জিয়ার দুর্নীতি” “বাংলাদেশের একটি পরিবারের দুর্নীতি” ইত্যাদি বাক্য লিখে অনুসন্ধান করলাম বারবার। খালেদা জিয়ার মামলা, কোর্টে হাজির, খালেদা জিয়ার উপর আক্রমণ, খালেদা জিয়ার জনসভা, তারেক রহমানের কিছু সংবাদের লিংক পাওয়া গেল। কিন্তু দুর্নীতি বা টাকা পাচারের কোনো সংবাদ লিংক পাওয়া গেল না।
সৌদি গেজেট, আল রিয়াদ, ওকাজ, গালফ নিউজ- প্রভৃতি পত্রিকার ওয়েবসাইটে ঢুকেও এ বিষয়ক কোনো সংবাদের লিংক খুঁজে পেলাম না। সৌদি আরব এবং দুবাইয়ে কর্মরত কয়েকজন বাংলাদেশি যারা সংবাদপত্র এবং চ্যানেলের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের ৩ জনের সঙ্গে কথা বললাম। জানতে চাইলাম, খালেদা জিয়া বা জিয়া পরিবারের দুর্নীতি, টাকা পাচারের সংবাদ বিষয়ে তারা কিছু জানেন কিনা। আরব নিউজ বা অন্য কোনো পত্রিকায় এমন কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে কিনা। তারা এমন কোনো সংবাদ জানেন না। দেশের সংবাদ মাধ্যম থেকে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পর তারা জেনেছেন।”
এছাড়া অ্যানালাইসিস বিডির অনুসন্ধানেও বিদেশি কোনো পত্রিকায় জিয়া পরিবারের সম্পদ বিষয়ক কোনো প্রকারের সংবাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
কট্রর আওয়ামী লীগপন্থি একাত্তর টিভির পাশাপাশি এই নিউজ প্রচার করেছে ডিবিসি নিউজ। ডিবিসির মালিকও প্রধানমন্ত্রীর তথ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী। সম্প্রতি ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির একটি টকশোতে উপস্থাপক এ বিষয়ে ইকবাল সোবহানকে জিজ্ঞেস করলে তিনি এর কোনো সদোত্তর দিতে পারেননি। তিনি বলেছেন, ফেসবুক-ইউটিউবে জিয়া পরিবারের সম্পদের এই সংবাদটি পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ ফেসবুক ও ইউটিউবের কথিত ও গুজব নিউজকেই তিনি সংবাদের উৎস হিসেবে তুলে ধরছেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধানমন্ত্রীর কাছে জিয়া পরিবারের কথিত এই নিউজের প্রমান দাবি করেছেন। এমনকি প্রমাণ দিতে না পারলে তারা আইনি ব্যবস্থা নিবেন বলেও হুমকী দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো প্রমাণ পেশ করা না হলেও বিএনপির পক্ষ থেকে এ ব্যপারে আর কোনো তৎপরতা পরে লক্ষ করা যায়নি।
কথিত এই সংবাদটির কোনো প্রকারের তথ্যপ্রমাণ না পাওয়া গেলেও এবং এত বিতর্কের পরও প্রধানমন্ত্রী গতকাল ফের এক বক্তব্যে সেই সংবাদের সূত্র ধরে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছেন। রোববার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী সেই গুজব নিউজের সূত্র ধরে বলেন, ‘ভাঙা স্যুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জি থেকে আগে কোকো-১, ২ নামে জাহাজ বেরিয়েছে। এখন আবার শপিং মল, ফ্ল্যাট ও হাজার হাজার কোটি টাকা বের হচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রীর মুখে বার বার একটি অসত্য ও গুজব নিউজের প্রচারণা সচেতন মানুষকে অবাক করেছে। ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমে যখন গুজবের ছড়াছড়ি, তখন সেই গুজবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং এসব গুজবকে সরকার নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। যা ভবিষ্যতে ভয়ংকর পরিস্থিতির তৈরি করবে।
বাংলা ইনসাইডার নামে একটি অনলাইন গুজব পত্রিকা একের পর এক গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে। গুজবগুলো সরকারের পক্ষে যাওয়ায় সরকারের মন্ত্রী এমপিরা এই গুজব অনলাইনটির সূত্র দিয়ে নানা বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন। ‘বিশ্বের তৃতীয় সৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’ ‘নোবেল শর্টলিষ্টে শেখ হাসিনার নাম’ ‘শেখ হাসিনাকে টেলিফোনের কাছে থাকতে বললো নোবেল কমিটি’ ইত্যাদি নানা ধরণের হাস্যকর গুজব ছড়িয়ে চলেছে অনলাইন পত্রিকাটি। আর সরকারের মন্ত্রী এমপিরা এমনকি প্রধানমন্ত্রীও সেসব গুজব নিউজগুলোর প্রচারণা চালাচ্ছেন।
Discussion about this post