অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
এবার বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ‘অপাত্র’ আখ্যা দিয়ে প্রচণ্ড ক্ষোভ ঝাড়লেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কম্বোডিয়া সফর পরবর্তী বৃহস্পতিবার গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ফাঁকে ফাঁকে খালেদা জিয়াকে বিভিন্নভাবে খোঁচা দিয়েছেন। তবে, এটাকে খালেদা জিয়ার ওপর প্রধানমন্ত্রীর ধারাবাহিক ক্ষোভ প্রকাশের অংশ বলেই মনে করছেন অনেকে।
এর আগেও দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রী যখনই কোথাও কথা বলার সুযোগ পান তখনই খালেদা জিয়াকে একহাত নেয়ার চেষ্টা করেন। তিনি কথায় কথায় বলেন খালেদা জিয়া অশিক্ষিত, তার ছেলেরাও অশিক্ষিত। অঙ্কে পাস করতে পারে নাই। অশিক্ষিতরা দেশকে কী দেবে? এমনকি খালেদা জিয়া একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতেও দ্বিধা করেন না শেখ হাসিনা। ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর নওগাঁর এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে যেসব ভাষায় কটাক্ষ করেছিলেন তা শুনে দেশবাসী হতভম্ব হয়েছে। খালেদা জিয়ার দুই ছেলেকে কারা উত্তম মধ্যম দিয়েছেন এবং তিনি কেন ম্যাকাপ করেন? কোন দর্জি থেকে গায়ের জামা তৈরি করেন এসব নিয়েও খোঁচা দিয়েছেন। কয়েক মাস আগে এই গণভবনেই আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি খালেদা জিয়া ও ফালুকে নিয়ে এমন এক মন্তব্য করেছিলেন, যা নিয়ে এক সপ্তাহ ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। ওই সময় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিত্ব নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে খোঁচা দিয়ে অনেক কথাই বলেছেন। আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে আনার বিষয়ে তিনি বলেছেন, অপাত্রে আর ঘি ঢালবেন না। মানে খালেদা জিয়ার সঙ্গে আর কোনো আলোচনা করবেন না। একবার ফোনে কথা বলে নাকি ঝাড়ি খেয়েছেন। আরেকবার কোকোর মৃত্যুর সময় দেখতে গেলেও তাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এজন্য খালেদা জিয়ার মানসিকতা ছোট বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৩ সালের গত ২৫ অক্টোবরে তথ্যমন্ত্রী ইনু ঘোষণা দিলেন যে প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনা যেকোন সময় খালেদা জিয়াকে ফোন করবেন। তার এ ঘোষণার পরই সারাদেশে মানুষের মধ্যে কৌতুহল সৃষ্টি হল। কখন ফোন করবেন? আর ফোন করলেও তিনি বিরোধদলীয় নেত্রীকে কি বলবেন? তা শোনার জন্য যেন মানুষেন মধ্যে আগ্রহের কোন শেষ নেই। প্রধানমন্ত্রী তার কাংখিত ফোনটি করলেন ২৭ অক্টোবর সন্ধা ৬.২৫ মিনিটে। কথা বললেন একটানা ৩৭ মিনিট।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের সুবাদে তাৎক্ষণিক জানা যায় প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়াকে গণভবনে খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছেন। আর বলেছেন হরতাল প্রত্যাহারের কথা। সর্বদলীয় সরকার মেনে নেয়ার কথাও বলেছেন। আর কী বলেছেন? তাৎক্ষণিক তা জানা যায়নি।
এরপর ২৮ অক্টোবর তথ্যমন্ত্রী ইনু আবার ঘোষণা দিলেন দুই নেত্রীর ফোনালাপ জাতির সামনে প্রকাশ করা হবে। যেই কথা সেই কাজ। রাতেই সরকারের মুখপাত্র হিসাবে খ্যাত একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল তা প্রকাশ করে। এর পরই দেশের সকল গণমাধ্যম তা প্রকাশ করে। ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও। বেরিয়ে আসে পর্দার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোনের আসল উদ্দেশ্য ও কুটচাল। সারাদেশে তখন এ নিয়ে চলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা।
খালেদা জিয়াকে হেয় করার জন্যই যে প্রধানমন্ত্রী ফোনালাপ রেকর্ড করে আবার জাতির সামনে প্রকাশ করেছেন তা পরিস্কার হয়ে যায়। আর খালেদা জিয়ার বক্তব্যকে বিকৃতি করে প্রচার করতে গিয়ে চরমভাবে ধরা খান প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। দুই নেত্রীর ফোনালাপের পরই এটিএন বাংলার এক সাক্ষাৎকারে চ্যানেলটির বার্তাপ্রধান জ ই মামুনের কাছে এইচ টি ইমাম দাবি করেছেন যে খালেদা জিয়া বলেছেন ৭১ এ মুক্তিযোদ্ধারাই গণহত্যা করেছে। অথচ সেদিন খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ৭১ এ সরকার গঠনের পর আপনাদের লোকেরাই গণহত্যা করেছে।
ফোনালাপ থেকে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী তার ফোনালাপে সেদিন দেশ ও জাতির সংকট নিয়ে কোন কথা বলেননি। জনসভার মত ফোনেও তিনি খালেদা জিয়াকে খোঁচা মেরে কথা বলে আক্রমণ করার চেষ্টা করেছেন।
এই ফোনালাপ প্রকাশের পর থেকে তখন বিরোধীদলীয় নেত্রীকে চুপচাপ দেখা গেলেও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সরব। এ নিয়ে তিনি সভা-সমাবেশগুলোতে নতুন সুরে পুরনো রেকর্ড বাজিয়েছেন। তিনি জনগণের কাছে বিচার দায়ের করে বলেছেন, ফোনালাপের সময় নাকি তিনি অনেক অপমান সহ্য করেছেন। খালেদা জিয়া নাকি তাকে সেদিন ফোনে অনেক ঝাড়ি দিয়েছে।
কিন্তু, ফোনালাপ থেকে জানা গেছে, বেগম জিয়া শুধু প্রধানমন্ত্রীর স্বভাব সূলভ আক্রমণাত্মক খোঁচা মারা প্রশ্নগুলোর জবাব স্পষ্ট ভাষায় দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী সেদিন ফোনালাপে যেসব বিষয়ের অবতারণা করেছেন বর্তমান সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকটের সাথে সেসব বিষয়ের দূরতম কোন সম্পর্কও ছিল না।
রাজনীতিক বিশ্লেষকরা ওই সময় বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী যদি সত্যিই সৃষ্ট সংকট সমাধানের জন্য খালেদা জিয়াকে ফোন দিতেন তাহলে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা আর ১৫ আগস্টের জন্মদিন পালন নিয়ে কঠাক্ষ করতেন না। প্রধানমন্ত্রী প্রতিদিন সভা-সমাবেশে বক্তৃতার যে রেকর্ড বাজিয়ে যাচ্ছেন বেগম জিয়ার সাথে ফোনালাপেও তিনি সেদিন একই রেকর্ড বাজালেন। নিজের পক্ষে জয় নেয়ার জন্য আবার ফোনালাপের রেকর্ড জাতির সামনে তা প্রকাশ করলেন। জনগণ কী শুনল? তার সেই জনসভার কুরুচিপূর্ণ ভাষাগুলোই আবার শুনতে পেল।
তারপর, খালেদা জিয়ার ছেলে কোকোর মৃত্যুর সংবাদ শুনে প্রধানমন্ত্রী দেখতে গিয়েছিলেন কিন্তু তাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এনিয়ে তিনি প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আজ। এবিষয়ে জানা গেছে, তখনই প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিবকে জানানো হয়েছিল যে ডাক্তার খালেদা জিয়াকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন। ওষুধ খেয়ে তিনি এখন ঘুমিয়ে আছেন। প্রধানমন্ত্রী যেন এখন না আসেন। বিএনপির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর অফিসকে এটা বলার পরও তিনি গুলশানে এসেছেন।
এছাড়া খালেদা জিয়া তখন গুলশানের অফিসে অবরুদ্ধ ছিলেন। বালুর ট্রাক দিয়ে সরকার তাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। আর খালেদা জিয়া শুধু বিরোধী দলের নেত্রীই নন, তিনি তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তার ওপর মরিচের পানি ছিটিয়ে দেয়া হয়েছিল। এতে করে খালেদা জিয়া মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেই পুলিশ এটা করেছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ওই সময় রাজনীতিক বিশ্লেষকসহ সচেতন মানুষ বলেছেন, একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ওপর মরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে তাকে বালুর ট্রাক দিয়ে অফিসে অবরুদ্ধ রেখে আবার দেখতে আসা কেমন সৌজন্যবোধ? তাদের মতে, মিডিয়া কাভারেজ নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী এসব নাটক করেছেন। খালেদা জিয়ার প্রতি ভালবাসা নয়, তার উদ্দেশ্য মিডিয়া কাভারেজ নেয়া। যাতে পরের দিন কোকোর মৃত্যুর সংবাদ পত্রিকাগুলো হেড লাইন করতে না পারে।
Discussion about this post