জাতীয় রাজনীতিতে এখন নতুন হাওয়া বইছে। বিএনপির জন্য এটিকে বসন্তের বাতাস হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতারা এ সময়টাকে তাদের জন্য ‘দুঃসহ’ বলে মনে করছেন। আওয়ামী লীগের সুখের দিনগুলো যেন একে একে হারিয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে চার বছর পার হতে চললো। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির পর আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরা প্রায়ই টিটকিরি দিয়ে বলতেন, ‘ট্রেন মিস করে ফেলেছে বিএনপি। এখন কান্নাকাটি করলে চলবে না। ট্রেন ঘুরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’ সেই নির্বাচনী ট্রেন আবার ঘুরে এসেছে। এবার আর বিএনপিকে ফেলে রেখে একা ট্রেনে উঠা সম্ভব নয়। বিএনপি যে রকমের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং পরিকল্পিতভাবে এগুচ্ছে তাতে ট্রেনের প্রায় পুরো জায়গা তারাই দখল করে নিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের উপেক্ষা করা তো সম্ভব হচ্ছেই না, উল্টো পুরো জায়গা দখল হওয়ার উপক্রম- বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে আওয়ামী লীগ নেতাদের। যদিও মামলার সাজাসহ নানা কায়দায় বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার একটা পরিকল্পনা সরকারের মধ্যে এখনও আছে, কিন্তু সেটি আদৌ বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
বস্তুত বিশ্লেষকরা এমনই মনে করছেন যে, দেশের ভেতরের বাইরের সার্বিক পরিবেশ এখন বিএনপির অনুকূলে। জনসমর্থন এখন বলা যায় ‘তুঙ্গে’। সরকারের সংস্থাগুলোই এমন রিপোর্ট দিচ্ছে। বলা হচ্ছে, নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হলে চরম ভরাডুবি হবে আওয়ামী লীগের। আর যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে নিরপেক্ষ নির্বাচন দেওয়া ছাড়া উপায়ও নেই। একদিকে বিএনপির জনপ্রিয়তাকে উপেক্ষা করা এবার আর সম্ভব হচ্ছে না, অন্যদিকে দেশের ভেতরে বাইরে আওয়ামী লীগ বলা যায় এক রকমের বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। বন্ধু তো নেই-ই, উল্টো শত্রুর সংখ্যা এতো বেড়ে গেছে যে, এরা সবাই সময় গুণছে বা সময়ের অপেক্ষা করছে কখন ভোটের সুযোগ আসে। আর এমন পরিস্থিতিকে আওয়ামী লীগ ভয়ানক বিপদ হিসেবেই দেখছে, ঘনিষ্ঠ একজন আওয়ামী লীগ নেতা শীর্ষকাগজ প্রতিবেদককে জানালেন।
৫ জানুয়ারি এবং এখনকার বাস্তবতা
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতাটা ছিল ভিন্ন। বিএনপির সাংগঠনিক ভিত এবং জনসমর্থন অবশ্য তখনও ছিল। কিন্তু, রাজনীতির নানামুখী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও সরকারের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য মোকাবেলা করার মতো তাদের সুষ্ঠু কোনও পরিকল্পনা ছিল না। অগোছালো কায়দায় কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি তখন। সেই সুযোগটিই নিয়েছে সরকার। নানা ইস্যুর ‘টোপ’ দিয়ে বিরোধীদলের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে দিয়েছিল সরকার। মারপিট দিয়ে নির্বাচনের আগেই নানা ইস্যুতেই অনেকটা কাবু করে ফেলেছিল বিএনপি-জামায়াতকে। বিদেশি সমর্থনও প্রকৃত অর্থে কেউই বিএনপির পক্ষে ছিল না। পশ্চিমারা ওই সময় ডুয়েল রোল প্লে করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। বিএনপি তখন সেটি বুঝতে পারেনি। অন্যদিকে চীন-ভারত এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের কোনোটিই বিএনপির পাশে ছিল না। ভারত সরাসরি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বহাল রাখার ব্যাপারে কাজ করেছিল। চীনও ব্যবসায়িক স্বার্থসহ নানা কারণে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল। কিন্তু, এখনকার বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক পরিবেশ এখন বিএনপিমুখি। দেশের মধ্যেও ভেতরে ভেতরে, অনেকে বাইরে প্রকাশ্যেই বিএনপির দাবির প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে। তাছাড়া জনসমর্থনও আগের তূলনায় অনেক বেড়েছে বিএনপির। সাংগঠনিক দুর্বলতাও দ্রুত কাটিয়ে উঠছে।
নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে কঠোর বিএনপি
মাঝে রাজনৈতিকভাবে চরম কোনঠাসা অবস্থায় পড়ে বিএনপি। দলীয় সাংগঠনিক কর্মকা-ও সর্বনিম্ন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে। ওই সময়ে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে বিএনপি কিছুটা নরম হয়ে গিয়েছিল। তারা নির্দলীয় সরকারের দাবিকে ‘সহায়ক সরকার’-এ নামিয়ে এনেছিল। বেগম খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে ফেরার পর সহায়ক সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করবেন বলেও জানানো হয়েছিল। বিএনপি নেতারা, এমনকি বেগম খালেদা জিয়াও ন্যূনতম হলেও কোনও রকমের একটা সমঝোতার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছিলেন। কিন্তু, গত এক মাসে তাদের সেই অবস্থানের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। সহায়ক সরকারের কথা এখন তারা আর বলছেন না। সরাসরি আগের অবস্থানে অর্থাৎ নির্দলীয় সরকারের দাবিতেই এখন অনড় বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এতোদিন তারা সরকারকে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন, সরকার কর্ণপাত করেনি। এখন সরকারই তাদেরকে আলোচনার প্রস্তাব দেবে, এমনটি আশা করছেন বিএনপি নেতারা।
খালেদা জিয়ার মামলায় সাজা হতে পারে?
বলা হচ্ছে, শিগগিরই খালেদা জিয়ার একটি মামলার রায় হয়ে যাবে। এটিতে তার সাজা হবে। তাতে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। সেই পরিস্থিতিতে বিএনপিকে দুই ভাগ করে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে বিএনপির একটি অংশকে অনুগত বিরোধীদল করা হবে। অবশ্য, অনেক পুরনো পরিকল্পনা এটি। বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার সময় এখন নেই। অনেক আগেই তা পার হয়ে গেছে। এটা সম্ভব ছিল ২০১৬ সাল পর্যন্ত। সেই সময় বিএনপির পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে, ‘আসল বিএনপি’ নামে আখ্যায়িত করে কতিপয় টোকাইকে দিয়ে বিএনপি অফিস দখল করারও চেষ্টা হয়েছিল। এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, ড. হাসান মাহমুদসহ কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতার নেপথ্য সমর্থনে এসব করা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, এখন হয়তো বেগম খালেদা জিয়াকে মামলায় সাজা দেয়া যেতে পারে। কিন্তু, বিএনপি ভেঙে পরিকল্পনা মতো এগোনো আদৌ সম্ভব হবে না। বরং তাতে হিতে-বিপরীত হতে পারে।
সূত্র: শীর্ষকাগজ
Discussion about this post