‘রোগী’ সেজে কারাগার থেকে আবারও হাসপাতালে গেছেন সাংসদ ও খুনের মামলার আসামি আমানুর রহমান খান রানা, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী তোফায়েল আহমেদ জোসেফ ও ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীন। তাঁদের কারও পিঠে ব্যথা, কারও পায়ের সমস্যা।
ইয়াবা ব্যবসায়ী আমিন হুদাকে নিয়ে গণমাধ্যমে বেশ কয়েক দফা খবর প্রকাশিত হওয়ার কারণে কারা প্রশাসন বেশ সতর্ক। এখন তাঁকে কারাগার থেকে হাসপাতালে আনা-নেওয়া করা হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক খায়রুল হুদা চপল হাওরে বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর এক সপ্তাহ কারাগারে ছিলেন। ‘বুকে ব্যথা’র রোগী হিসেবে দুই মাস ধরে তিনি হাসপাতালে আছেন।
কারা অধিদপ্তর থেকে ১৫ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খুনের আসামিসহ সারা দেশে বেশ কয়েকজন সাজাপ্রাপ্ত বন্দী চিকিৎসার জন্য কারাগারের বাইরের হাসপাতালে অবস্থান করছেন। ঢাকার বাইরে ৬৫টি কারা হাসপাতালে চিকিৎসক না থাকায় সেখানকার বন্দীদের চিকিৎসার জন্য বাইরের হাসপাতালে যাওয়ার একধরনের যুক্তি রয়েছে।
তবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্র জানায়, কারাগারে হাসপাতাল থাকলেও অনেকেই অসুস্থ না হয়েও আরাম-আয়েশে থাকতে হাসপাতালে ভর্তি হন। সে ক্ষেত্রে ঘুরেফিরে আসছে পাঁচ প্রভাবশালীর নাম, যাঁরা বিত্তবান ও প্রভাবশালী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় কারাগারের একাধিক চিকিৎসক জানান, তদবিরের চাপে প্রভাবশালী আসামিদের তাঁরা হাসপাতালে পাঠান। জটিল রোগ না থাকলেও হাসপাতালেই থাকছেন তাঁরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকার জ্যেষ্ঠ জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসার দরকার হলে তো বন্দীদের হাসপাতালে পাঠাতেই হবে।
জটিল রোগে আক্রান্ত না হলেও এসব বন্দীকে দিনের পর দিন হাসপাতালে রাখার ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, এত কড়াকড়ি আরোপ করার পরও আবার কেন তাঁদের হাসপাতালে পাঠানো হলো সে বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। কেউ যদি সুযোগ নিয়ে থাকেন এবং কারাগারের কোনো কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা যদি মেলে, তবে অবশ্যই তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আমানুর এক মাস হাসপাতালে
‘রোগী’ সেজে হাসপাতালে থাকার জন্য সবচেয়ে আলোচিত টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের সরকারদলীয় সাংসদ আমানুর রহমান খান। খুনের মামলার এই আসামিকে ‘উন্নত চিকিৎসার’ জন্য কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয় গত মাসে। এরপর গত ২৫ সেপ্টেম্বর তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কেবিনে ভর্তি করা হয়। এর আগেও তিনি মূত্রাশয়ের (ইউরোলজিক্যাল) সমস্যা নিয়ে তিন মাস একই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। হাসপাতালে থাকা নিয়ে সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে গত ৯ মে আমানুরকে কারাগারে ফেরত নেওয়া হয়। তাঁর বিরুদ্ধে হাসপাতালে বসেই দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে রাজনৈতিক সভা করার অভিযোগ ছিল।
সাংসদ আমানুর রহমান টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগের নেতা মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি। এই মামলার অভিযোগপত্র দাখিলের পর ২২ মাস তিনি পলাতক ছিলেন। এরপর গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। তখন থেকে তিনি কারাবন্দী। টাঙ্গাইলের বিভিন্ন থানায় পাঁচটি হত্যাসহ ৪৭টি মামলা রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
১৮ অক্টোবর সাংসদ আমানুর রহমানকে আদালতে হাজির না করায় মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি। কোমরে ব্যথার কারণে আমানুর ভ্রমণের উপযুক্ত নন, তাই তাঁকে হাজির করা সম্ভব হয়নি বলে কারা কর্তৃপক্ষ আদালতকে জানিয়েছে।
কাশিমপুর কারাগার-১-এর জেল সুপার সুব্রত কুমার প্রথম আলোকে বলেন, ‘অসুস্থ বলেই আমরা তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়েছি।’
আবার হাসপাতালে জোসেফ
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী তোফায়েল আহমেদ জোসেফ আবারও হাসপাতালে ফিরে এসেছেন। চিকিৎসকের দাবি, এবার জোসেফের পা ফুলে গেছে। এর আগে কোনো জটিল রোগ ছাড়াই টানা ২০ মাস তিনি হাসপাতালে ছিলেন। পরে তাঁকে ফেরত নেওয়া হয় গত ৮ মে। চার মাস পর গত ২৪ সেপ্টেম্বর আবারও তাঁকে ভর্তি করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৯৯ সালের একটি হত্যাকাণ্ডে জোসেফের মৃত্যুদণ্ড হয়। এই রায় বহাল রাখেন হাইকোর্ট। পরে আপিল বিভাগ সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।
রফিকুল আমীন দুই মাস বারডেমে
কেন্দ্রীয় কারাগারের নথিপত্র অনুযায়ী, ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীনকেও আবার বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ২৪ আগস্ট। দুই মাস ধরে তিনি হাসপাতালে আছেন। গ্রেপ্তার হওয়ার পর রোগী হিসেবে বেশির ভাগ সময়ই তিনি বারডেম হাসপাতালে ছিলেন।
গত ৫ আগস্ট রফিকুল আমীনকে কারাগারে ফেরত নেওয়া হয়। প্রায় চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে তিনিসহ ডেসটিনি গ্রুপের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে করা মামলার বিচার শুরু হয়েছে।
হাসপাতালে আমিন হুদার কক্ষ বদল হয়
বারডেম হাসপাতালে কারাবন্দীদের রাখার নিয়ম না থাকলেও মাসের পর মাস সেখানে ছিলেন সাজাপ্রাপ্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী আমিন হুদা। টানা ১৮ মাস থাকার পর গত ৭ মে তাঁকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এর দেড় মাস পর আবারও তাঁকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বারডেম হাসপাতালের বিভিন্ন কক্ষে তিনি ঘুরেফিরে থাকেন। তবে এবার তাঁকে টানা হাসপাতালে রাখা হচ্ছে না। তবে মাঝেমধ্যে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে হাসপাতালে আনা হচ্ছে।
আমিন হুদাকে ২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর গ্রেপ্তার করা হয়। ইয়াবা-সংক্রান্ত দুটি মামলায় তাঁর ৭৯ বছরের সাজা হয়।
এক সপ্তাহ জেলে, দুই মাস হাসপাতালে
সুনামগঞ্জে হাওরে বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির মামলায় গত ১৫ আগস্ট গ্রেপ্তার হন জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক এবং শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি খায়রুল হুদা ওরফে চপল। মাত্র এক সপ্তাহ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকার পরই ‘বুকে ব্যথার’ রোগী সাজিয়ে তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) নেওয়া হয়। এরপর থেকে তিনি সেখানেই আছেন। খায়রুল হুদার বিরুদ্ধে হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার ফসলহানির অভিযোগে সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানায় মামলা হয়। মামলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ১৫ কর্মকর্তাসহ বাঁধের কাজে জড়িত ৪৬ জন ঠিকাদারকে আসামি করা হয়। এই মামলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের বরখাস্ত হওয়া সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আফছার উদ্দিন ও ঠিকাদার মো. বাচ্চু মিয়া জেলে আছেন। কিন্তু প্রায় দুই মাস হাসপাতালে আছেন খায়রুল হুদা। তিনি সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং জেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান নুরুল হুদার ছোট ভাই।
সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে অন্য হাসপাতালে নেওয়ার সুপারিশ করেছেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের চিকিৎসক বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস। জানতে চাইলে বিপ্লব কান্তি প্রথম আলোকে বলেন, জোসেফ অনেক দিন কারাগারে ছিলেন। সে জন্যই তাঁকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আমিন হুদা ও রফিকুল আমিন কিছুটা অসুস্থ। এ ছাড়া খায়রুল হুদার জন্য অনেক সুপারিশ থাকায় তাঁকে হাসপাতালে পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন।
ঢাকার কারা উপমহাপরিদর্শক তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারের চিকিৎসকের পরামর্শেই তাঁদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে চিকিৎসার পর দ্রুত কারাগারে ফেরত আনার ব্যাপারে নির্দেশনা রয়েছে। বিলম্ব হলে সেই দায় কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষের।
এর আগে বিভিন্ন অজুহাতে আসামিদের দীর্ঘ সময় হাসপাতালে অবস্থান নিয়ে প্রথম আলোতে কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনগুলো প্রকাশের পর রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে সব কয়েদিকে কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এ ছাড়া ভবিষ্যতে এভাবে কয়েদিদের হাসপাতালে না রাখার জন্য কারা প্রশাসনকে নির্দেশ দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি হাসপাতালে ভর্তি থাকা বন্দীদের ব্যাপারে ১৫ দিন পরপর প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিবেদন নিয়মিত এলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, এটা অবশ্যই দুর্নীতির মাধ্যমে হচ্ছে। বড় বড় অপরাধী যখন বেআইনি সুযোগ-সুবিধা পায়, তার অর্থ স্পষ্টতই আইনের চোখে সবাই সমান নয়। এই অপরাধীরা কারাগার ও হাসপাতালকেও অপরাধজগতের সঙ্গী বানিয়ে ফেলেছে। এতে করে আইনের শাসন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে।
সূত্র: প্রথম আলো
Discussion about this post