ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
শেখ হাসিনা সরকারের এবারের মন্ত্রিপরিষদে এমন সব লোককে মন্ত্রী করা হয়েছে, যারা সম্ভবত তাদের অবস্থানগত মর্যাদা ও গুরুত্ব সম্যক উপলব্ধি করতে সক্ষম নয়। তারা এমন ভাষায় কথা বলেন যা শুধু অযৌক্তিকই নয়, হাস্যকরও বটে। তা ছাড়া অনেকের বক্তব্যে সরকারের নীতিরও প্রতিফলন ঘটে না। যার যা খুশি অবিরাম বলে যাচ্ছেন। আবার একই মন্ত্রী একেক সময় একেক কথা বলছেন, যা পরস্পরবিরোধী। সাধারণত এমনটি খুব একটা দেখা যায় না। আগেকার দিনে কেউ মন্ত্রী হলে তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনী ছাপার জন্য সংবাদপত্রে দেয়া হতো। তাতে সাধারণ মানুষ জানতে পারত, যারা তাদের মন্ত্রী, কী তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, কী তাদের জীবনাভিজ্ঞতা। এখন আর তা করা হয় না। কারণ সম্ভবত এই যে, তাদের অনেকেই সে যোগ্যতা রাখেন না। শুধু বিভিন্ন লবিং-তদবিরের মাধ্যমে তারা মন্ত্রিত্বের আসন অলঙ্কৃত করেছেন। কিংবা যাদের চাপার জোর আছে বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে কশে গালি দেয়ার। আর এর ফলে বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
যে কাউকে দিয়ে শুরু করা যায়। যেমন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। তার জীবনবৃত্তান্তের কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু তার রাজনীতির ইতিহাস বড় বর্ণাঢ্য। তিনি মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের সভানেত্রী ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি ছিলেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের নেতৃত্বাধীন মস্কোপন্থী ন্যাপের নেত্রী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে পথেঘাটে বক্তৃতা করেছেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় বাকশাল যখন প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন এই ন্যাপ (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) বাকশালে একীভূত হয়ে গেল। মতিয়া চৌধুরী হলেন বাকশালের নেত্রী এবং বঙ্গবন্ধুর গুণকীর্তন শুরু করলেন।
১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান যখন বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করলেন, মতিয়া চৌধুরী তখন আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এখন তিনি আওয়ামী লীগের বড় নেত্রী। কী যে তিনি বলেন, কী যে তিনি বলেন না, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। বাংলাদেশের রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ নিয়ে অনেক কথাই বলা হচ্ছে। এখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্যাতন করেছে। তাদের নির্বিচারে হত্যা করেছে। বাড়িঘর, ফসলের মাঠ জ্বালিয়ে দিয়েছে। আর তাই সব কিছু ফেলে তারা আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে এসেছেন বাংলাদেশে। বাংলাদেশ মানবিক কারণে তাদের আশ্রয়ও দিয়েছে। এখনো মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। এখনো হাজার হাজার রোহিঙ্গা প্রতিদিন বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।
শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা ১৬ কোটি লোক ১০ লাখ রোহিঙ্গার সাথে ভাগাভাগি করে খাবো। তিনি একবারও বলেননি, এই রোহিঙ্গা বিতাড়নের জন্য পাকিস্তান দায়ী। কিন্তু মতিয়া চৌধুরীর কী যে মতিভ্রম হলো, তিনি বলে বসলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি ভেঙে দিতেই পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের আক্রমণ করা হয়েছে। তিনি বললেন, যখন পদ্মা সেতু নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, তখন পাকিস্তান ভাবল, বাংলাদেশকে আর ঠেকানো যাচ্ছে না। মিয়ারমারের সাথে তাদের সম্পর্ক রয়েছে। সে কারণেই মিয়ানমারের সেনারা রোহিঙ্গাদের ওপর আক্রমণ করল। রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশ করল। পাকিস্তান ভেবেছিল, বাংলাদেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। কিন্তু না ভেঙে পড়েনি। আমাদের অর্থনীতিকে তারা নষ্ট করবে না।
মতিয়া চৌধুরীর এ বক্তব্য একেবারে আসমানি বলে মনে হলো। কারণ রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ এখন খুবই নিঃসঙ্গ। বাংলাদেশ ভারতকে না চাইতেই সব কিছু উজাড় করে দিয়েছে। ট্রানজিট, করিডোর, সড়কপথ, নৌপথ, রেলপথ, বন্দর সব কিছু। বাংলাদেশের আশা ছিল, এত কিছু দেয়ার পর বাংলাদেশের দুর্দিনে সম্ভবত ভারত তাদের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু ভারত স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছে, রোহিঙ্গা ইস্যু প্রশ্নে তারা থাকবে মিয়ানমারের পাশে। মিয়ানমার থেকে তাদের পাওয়ার আছে অনেক কিছু। চীন, রাশিয়ার ক্ষেত্রেও ঘটেছে একই ঘটনা। এই দুই পরাশক্তির সাথে নানা অর্থনৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ আছে বাংলাদেশ।
আশা ছিল, সেসব কারণে চীন-রাশিয়া দাঁড়াবে বাংলাদেশের পাশে। কিন্তু মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাবে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে চীন-রাশিয়া দুই দেশই ভেটো দিয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের পাশে নেই তারা। এ ছাড়া পাশে নেই মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোও। তারাও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জোরালো কোনো বক্তব্য তুলে ধরেনি। নানা সময়ে নানাভাবে এসব দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের বিনাশ ঘটিয়েছে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার।
এ রকম নিঃসঙ্গ অবস্থায় বাংলাদেশ সরকার শেষ পর্যন্ত বহু ঘৃণীত পাকিস্তানেরই দ্বারস্থ হয়েছে। গত ১১ অক্টোবর ইসলামাবাদে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সে দেশে নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী শাহিদ খাকান আব্বাসির সাথে দেখা করেছেন। হাইকমিশনার তাকে বলেছেন, বাংলাদেশে নতুন করে আসা পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের বাড়িঘরে ফেরত পাঠানো নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে পাকিস্তানকে যুক্ত হতে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ। তাহলে মতিয়া চৌধুরীর বক্তব্যের সারবত্তা কী দাঁড়াল? এক দিকে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে পাকিস্তানের সহায়তা চাইছে; অপর দিকে মতিয়া চৌধুরী বলছেন, পাকিস্তানের ইন্ধনে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা চালিয়েছে এবং তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে।
এটিই একমাত্র উদাহরণ নয়। এমন উদাহরণ প্রচুর পাওয়া যায়। অপর দিকে, এ সরকারের মন্ত্রীদের ভারতপ্রীতি বেহায়াপনার পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। কিন্তু এই প্রীতি কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না। বাংলাদেশ যখন রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে তীব্র সঙ্কটে রয়েছে, তখন আসামে বিজেপি সরকার ঘোষণা করেছে, চলতি বছরেই তারা ৩০ লাখ বাঙালিকে আসাম থেকে বিতাড়িত করবে। কিন্তু এরা কোথায় যাবে, সে কথা বিজেপি সরকার উল্লেখ করেনি। তাদের ভাষ্য থেকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়, এই ৩০ লাখ বাঙালিকে তারা বাংলাদেশেই ঠেলে দেবে। মিয়ানমার সরকার যখন জাতিগত নিধনযজ্ঞের মাধ্যমে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার পরিকল্পনা করছিল, তখন বাংলাদেশের অপরিপক্ব সরকার চুপ করে এই ভেবে বসেছিল যে, ‘দেখি শালা মগ কী করে’। কিন্তু মগরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশে ঠেলে দিলো। আমরা নিরুপায় বসে থাকলাম। এখন শান্তির ললিত বাণী শোনাচ্ছি। বলছি, যুদ্ধের মাধ্যমে নয়, আলোচনার মাধ্যমে সমাধান। কিন্তু এমন আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না মিয়ানমার সরকার। এখন ভারত যদি আসামের ৩০ লাখ বাঙালিকে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিতে শুরু করে, তাহলেও কি আমরা এই ভেবে বসে থাকব, ‘দেখি শালা বাঙাল কী করে’। নাকি এখনই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরব হবো? নাকি এখনই হারানো বন্ধুদের কূটনীতির মাধ্যমে আমাদের পাশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব? নাকি ফের বলব, যদি ১৬ কোটি লোককে খাওয়াতে পারি, তাহলে আরো ৩০ লাখ লোককে খাওয়াতে পারব?
এ প্রসঙ্গে এসেছি এ কারণে যে, পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেছেন, বন্যা-পরবর্তী সময়ে সংস্কারকাজে পত্রপত্রিকায় শত শত কোটি টাকা হরিলুটের কথা বলা হলেও তা সঠিক নয়। যেখানে বরাদ্দই আছে ৪২০ কোটি টাকা, যার মাত্র ২০ কোটি টাকা বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের জন্য- সেখানে লুট হতে পারে, হরিলুট হয়নি। অর্থাৎ লুট ভালো, হরিলুট ভালো নয়। তিনি দুর্নীতিবাজদের পক্ষ অবলম্বন করে বলেছেন, এবারের বন্যা গাফিলতি বা অব্যবস্থাপনার কারণে হয়নি। হয়েছে অতিরিক্ত পানিপ্রবাহ ও বৃষ্টিপাতের কারণে। তিনি বলেছেন, অব্যবস্থাপনা নয়, বন্যার জন্য দায়ী ইঁদুর এবং কৃষক। তার ভাষ্য মতে, ইঁদুর বাঁধের নিচ দিয়ে গর্ত করে বাঁধ নড়বড়ে করে ফেলে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধানের নৌকা নিয়ে যাওয়ার জন্য কৃষকেরা বাঁধ কেটে দেয়। ফলে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। বন্যার অনেক আগে থেকেই পত্রপত্রিকা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই মর্মে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিল যে, বাঁধগুলো সঠিক উচ্চতায় ও প্রশস্ততায় নির্মাণ করা হয়নি। ফলে সহজেই বন্যার সৃষ্টি হতে পারে। পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সে দিকে গেলেনই না, বরং এত বড় বন্যার জন্য তিনি ইঁদুর এবং কৃষককে দায়ী করলেন। এত বড় গণবিরোধী ও জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তি কিভাবে মন্ত্রী বা পানিসম্পদমন্ত্রী হলেন, বোঝা দায়।
সরকার নিঃসন্দেহে দুর্নীতিবান্ধব। কোনো প্রকল্পই তারা যথাসময়ে শেষ করতে পারে না বা শেষ করে না। সময় যতই গড়ায় প্রকল্পের ব্যয় তত বাড়ে। বাড়ে দুর্নীতিও। প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত বোঝানো হয়েছে যে, সময় বাড়লেই প্রকল্প ব্যয় স্বাভাবিকভাবে বাড়বেই। কারণ তত দিনে জিনিসপত্রের দামও মোটামুটি বাড়ে। কিন্তু যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়েছে, নির্ধারিত সময়ে যদি তারা সে কাজ শেষ করতে না পারে, তবে তাদের জরিমানা হওয়ার কথা। টাকা বাড়িয়ে দেয়ার কথা নয়। আমরা সে রকমটা দেখতে পাচ্ছি না। উল্টোটাই বরং সব সময়ই ঘটছে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নানা ধরনের কথা বলে বিতর্কের জন্ম দেন। কিন্তু গত ১৯ অক্টোবর তিনি কিছু সত্য কথা বলে ফেলেছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের (মহাজোট) অনেক এমপি অত্যাচারী ও অসৎ। তারা মানুষের কাছ থেকে নানা ধরনের টাকাপয়সা আদায় করে। তবে একে ঠিক ঘুষ বলব না। তিনি বলেন, নির্বাচনে যদি প্রতিযোগিতা হয়, তাহলে আমাদের (আওয়ামী লীগের) অনেক এমপিকে পাস করতে বেগ পেতে হবে। তার হিসাবে যারা এই অসৎ কাজে যুক্ত, তাদের সংখ্যাটা কম নয়, অনেক। আমিই জানি কয়েকজনের কথা। নির্বাচনে প্রতিযোগিতা হলে তারা তখন শিক্ষা পাবেন। ভালোই শিক্ষা পাবেন।
শিক্ষা পাবেন কি পাবেন না, সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই। কিন্তু অসততা, দুর্নীতি, ঘুষ সমাজে ওপেনসিক্রেটে পরিণত হয়েছে। এ ব্যাপারে রাখঢাক লজ্জা-সরম দূরীভূত হয়ে গেছে। কিছু দিন আগে পত্রিকায় দেখলাম, একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ঘুষের টাকা গুনে নেন না, ওজন করে নেন। অত টাকা গোনার তার সময় নেই। ঘুষ-দুর্নীতিতে তেমন একটা শাস্তিও হয় না। ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে যায়, সুরাহা হয় না। ঘুষের টাকা আদায়ও হয় না। ব্যাংকের টাকাও আদায় হয় না। কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত ভিসি চাকরি দেয়ার নাম করে যে ঘুষ খেয়েছেন, সে কথা স্বীকারও করেছেন। সে রিপোর্টও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, চাকরি দিতে না পারলে টাকা ফেরত দেবো, অসুবিধা কোথায়। দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিতে দিতে চোরদের গলা এতটাই বড় হয়েছে, সবাই দুর্নীতিবাজের পক্ষে, নিরীহ ইঁদুর আর অসহায় কৃষকের বিরুদ্ধে। এর প্রতিকার যে কবে হবে কে বলতে পারে!
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
সূত্র: নয়াদিগন্ত
Discussion about this post