রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনযজ্ঞের পূর্বাভাস পেয়েছিল জাতিসংঘ। এমনকি এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনও জাতিসংঘের হাত পৌঁছায়।
কিন্তু সেই বিষয়টি সচেতনভাবেই চেপে গিয়েছিল তারা। যার পরিণামে রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ আজ রোহিঙ্গাশূন্য হতে চলেছে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ শুরুর পর থেকে জীবন বাঁচাতে দলে দলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছেন রোহিঙ্গারা। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
জাতিসংঘে পাঠানো ওই পর্যালোচনা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন ইয়াঙ্গুনভিত্তিক বিশ্লেষক ও জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা রিচার্ড হর্সে। রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের পূর্বাভাস সংক্রান্ত এ প্রতিবেদনে মিয়ানমারে জাতিসংঘের কর্মকৌশল ও দৃষ্টিভঙ্গিরও সমালোচনা করা হয়েছে। সতর্ক করে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় জাতিসংঘ প্রস্তুত নয়।
২০১৭ সালের মে মাসে ওই পর্যালোচনা প্রতিবেদনটি জাতিসংঘের হাতে পৌঁছায়। এর তিন মাসের মাথায়ই রোহিঙ্গাদের নির্মূলে সর্বাত্মক অভিযানে নামে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
অথচ ওই পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল ‘মানবাধিকারের বিষয়ে কোনও নীরবতা নয়।’
ওই পর্যালোচনা প্রতিবেদনের একটি কপি দ্য গার্ডিয়ানের হাতে পৌঁছেছে। এতে ছয় মাসের মধ্যে পরিস্থিতির গুরুতর অবনতির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর আচরণ হবে মারাত্মক এবং বাছবিচারহীন। এতে সুপারিশ করা হয়, রোহিঙ্গা ইস্যুতে যেন দ্রুত একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে জাতিসংঘ।
পর্যালোচনা প্রতিবেদনটির প্রণেতা ও সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা রিচার্ড হর্সে জানান, জাতিসংঘ সদর দফতরে পাঠানো তার প্রতিবেদনে জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। আহ্বান জানানো হয়েছিল, যেন পরিস্থিতির উন্নতির উপায় শনাক্ত করা হয়।
রিচার্ড হর্সে বলেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে সমাজের মানুষদের জন্য বেপরোয়া মনোভাবসম্পন্ন আরসা’র মতো সংগঠনের জন্য উর্বর ভিত্তি তৈরি করে। আন্তর্জাতিক ইসলামি জঙ্গি সংগঠনগুলোও এই বেপরোয়া পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে রোহিঙ্গাদের জঙ্গি কর্মকাণ্ডের জন্য সংগ্রহ করতে পারে।
পর্যালোচনা প্রতিবেদনে রিচার্ড হর্সে ১৬টি সুপারিশ তুলে ধরেন। সরকারের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনার জন্য মিয়ানমারে জাতিসংঘের নতুন জনবল নিয়োগের আহ্বান জানান। একইসঙ্গে এ প্রতিবেদনের বিষয়ে ত্রাণ সংস্থাগুলোকে অবহিত করার আহ্বান জানান এ বিশ্লেষক।
জাতিসংঘ সূত্র এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, রিচার্ড হর্সে’র ওই প্রতিবেদন শুধু উপেক্ষাই করা হয়নি; বরং সেটা গোপন রাখা হয়েছিল। পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য গার্ডিয়ান’কে বলেন, ওই প্রতিবেদনটিকে অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছিল। জাতিসংঘের ফোরাম এবং ত্রাণ সংস্থাগুলোর কাছেও এটা সরবরাহ করা হয়নি। এর কারণ হচ্ছে, মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রেনাটা লক ডেসালিয়ান পর্যালোচনা প্রতিবেদনটি পছন্দ করেননি।
মিয়ানমারে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা রেনাটা লক ডেসালিয়ান-এর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা নিধনে সহযোগিতার অভিযোগ অবশ্য নতুন নয়। এবারের রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকেই মিয়ানমারে নিয়োজিত জাতিসংঘের কর্মকর্তারা দেশটিতে রোহিঙ্গা নিপীড়নের ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। খোদ জাতিসংঘের অভ্যন্তরীণ সূত্র ও মানবিক সহায়তা প্রদানকারী সংগঠনগুলোই সংবাদমাধ্যমের কাছে এমন অভিযোগ তুলছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, জাতিসংঘের ব্যর্থতার কারণেই কী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষের এই করুণ পরিণতি?
বিবিসি’র এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তা রেনেটা লক ডেসালিয়ান চাননি মানবাধিকার সংগঠনগুলো সংকটপূর্ণ এলাকা পরিদর্শন করুক। স্পর্শকাতর রোহিঙ্গা এলাকায় মানবাধিকার কর্মীদের প্রবেশ প্রতিহত করেছেন তিনি।
বর্তমান সংকট শুরু হওয়ার চার বছর আগে থেকেই কানাডীয় নাগরিক রেনেটা লক ডেসালিয়ান বিভিন্নভাবে রোহিঙ্গা এলাকা পরিদর্শনে বাধা দিয়েছেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সোচ্চারমূলক প্রচারণা কাজে বাধা দিয়েছেন। তাছাড়া যেসব কর্মকর্তা সতর্ক করতে চেয়েছেন যে, এভাবে চলতে থাকলে জাতিগত নিধন অনিবার্য, তাদেরকেও তিনি বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন। এ ব্যাপারে বিবিসি ডেসালিয়ান-এর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি রাজি হননি।
দ্য গার্ডিয়ানের অনুসন্ধান বলছে, ইয়াঙ্গুনভিত্তিক বিশ্লেষক রিচার্ড হর্সে’র ২৮ পৃষ্ঠার পর্যালোচনা প্রতিবেদনটি রেনাট লক ডেসালিয়ানকেই দেওয়া হয়েছিল। তিনি এতে খুশি হতে না পারায় সেটি আর বিতরণ করেননি।
মিয়ানমারে জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তার এমন ভূমিকার বিষয়টি অবশ্য নাকচ করে দিয়েছেন সংস্থাটির মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস। গত ২৯ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতিতে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফান দুজারিক সংস্থাটির এমন অবস্থানের কথা জানান।
বিবৃতিতে বলা হয়, মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর রেনাটা লক ডেসালিয়ান-এর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ব্যাপারে জাতিসংঘ দৃঢ়ভাবে ভিন্নমত পোষণ করছে। আবাসিক সমন্বয়কারী এবং তার টিমের প্রতি মহাসচিবের শতভাগ আস্থা রয়েছে।
জাতিসংঘে পাঠানো ওই পর্যালোচনা প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছিল, যে পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হচ্ছে সে সম্পর্কে যেন বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা এবং সেভ দ্য সিলড্রেন-এর মতো সংস্থাগুলোকে অবহিত করা হয়।
দ্য গার্ডিয়ানের অনুসন্ধান বলছে, রেনাটা লক ডেসালিয়ান এই সংস্থাগুলোর কাউকেই বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করেননি। ফলে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ শুরুর পর থেকে জীবন বাঁচাতে দলে দলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছেন রোহিঙ্গারা।
সূত্র: কালেরকণ্ঠ
Discussion about this post