রাজপথের কর্মসূচি এড়িয়ে আপাতত কৌশলী অবস্থানে থেকে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। যদিও দলটির নেতারা মনে করছেন, আলোচনার মাধ্যমে প্রত্যাশিত অর্জন না হলে রাজপথেই এর সমাধান হবে।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এ মুহূর্তে অনির্দিষ্টকালের সফরে লন্ডনে অবস্থান করছেন। দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিকিৎসার কথা বলা হলেও দেশের রাজনীতিতে বিএনপিপ্রধানের এ সফরের গুরুত্ব রয়েছে।
দলীয় সূত্র মতে, খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে দলের অবস্থান সুদৃঢ় করার চেষ্টা করছেন। কিছুদিন আগেও নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি উপস্থাপন করলেও এ নিয়ে দলটির পক্ষ থেকে তেমন কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
সহায়ক সরকারের রূপরেখা তৈরিতে দলের নেতা ও বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী যারা জড়িত রয়েছেন তারাও বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন না। এসব বিষয়ে প্রকাশ্যে কেউ কিছু না বললেও নেতাকর্মীদের কেউ কেউ মনে করছেন, রাজপথ বা সহায়ক সরকার নয়, কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে পারলে বিএনপির চাওয়া পূরণ হবে।
যদিও বিএনপির নেতাদের অভিযোগ, সরকার তাদের রাজপথের কর্মসূচি পালনে বাধা দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, বিভিন্ন অভিযোগের মাধ্যমে সরকারকে চাপে রেখে আন্তর্জাতিক মহলের মাধ্যমে বিএনপি তার দাবি আদায়ে তৎপর রয়েছে।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে সংলাপের সম্ভাব্য রূপরেখা ও প্রস্তাব নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে দলটির শীর্ষ নেতারা। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, ১৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিতব্য ইসির সঙ্গে সংলাপে বিএনপির খসড়া প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সম্ভাব্য প্রস্তাবনাগুলোর মধ্যে ইসি’র ক্ষমতার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার, সহায়ক সরকার গঠন ও নির্বাচনকালীন সময়ে সেনা মোতায়েন এবং সংসদ ভেঙে দেয়াসহ বেশ কয়েকটি বিষয় চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানা যায়।
বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আমাদের সংলাপের বিষয় নিয়ে মূল আলোচনা হয়েছে। এছাড়াও সহায়ক সরকার, রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি ও চলমান রাজনীতির কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলাপ হয়েছে।
এরও আগে, ১৮ সেপ্টেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে বাংলাদেশে সফররত ব্রিটিশ কনজারভেটিভ পার্টির একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দলটির সিনিয়র নেতাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও দলটির শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
ঘণ্টাব্যাপী সংলাপ শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ দেখতে চান তারা। আমরাও একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে আমাদের অবস্থানের কথা জানিয়েছি। তারাও জনগণ যাতে নির্ভয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে তেমন পরিস্থিতি দেখতে চান।
আপাতত নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন, বিবৃতি; এছাড়া জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে ঘরোয়া কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ রয়েছে বিএনপির সার্বিক কর্মকাণ্ড।
এসব কর্মসূচিতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, নজরুল ইসলাম খান, আবদুল মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদুসহ হাতেগোনা কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাকে দেখা যায়।
চেয়ারপারসন দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত কি এভাবেই চলবে বিএনপির কার্যক্রম- এমন প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সদস্য সংগ্রহ অভিযান কর্মসূচির মাধ্যমে নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙা রাখার প্রয়াস চলছে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল এ প্রসঙ্গে বলেন, আন্দোলন সফল করেই আমরা স্বৈরাচারকে বিতাড়িত করেছি। সেসব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা যখন চলমান আন্দোলন করতে যাচ্ছি তখন দেখি নতুন নতুন বিষয় সামনে এসে যাচ্ছে। যেমন- এখন মিছিল দেখলেই সরাসরি গুলি করা হচ্ছে। এরশাদের আমলেও হয়েছে। কিন্তু এখন বেশি হচ্ছে, মিছিল দেখামাত্রই গুলি হচ্ছে। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে, কোনো সভ্য দেশে এটি কল্পনাও করা যায় না। এমনকী হিটলার-মুসোলিনির সময়ও তাদের দেশে দেখামাত্র গুলির কোনো নজির নেই।
সাবেক এ ছাত্রনেতা আরও বলেন, একনায়কতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্রের একমাত্র চেহারা আমরা বাংলাদেশেই দেখছি। সুতরাং নতুন এ চেহেরা, নতুন এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় আন্দোলনের কৌশলও আমাদের মাঝে মাঝে পরিবর্তন করতে হচ্ছে। আমরা আশা করছি, সামনের যে আন্দোলন হবে এবং সামনে যে আন্দোলন ঘোষিত হবে, সেই আন্দোলনে আমরা এ স্বৈরশাসকের অত্যাচার ও অবিচার প্রতিরোধ করে সামনে এগিয়ে যাব এবং আমরা সফল হব।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু জাগো নিউজকে বলেন, সরকার আমাদের তো সদস্য সংগ্রহই করতে দিচ্ছে না। বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের পাশাপাশি ও আওয়ামী লীগের অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা আক্রমণ করছে। বাধা দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দিতেও আমাদের ট্রাকগুলো আটকে দেয়া হলো।
‘সার্বিকভাবে দেশে তো কোনো স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রম নেই। এক আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সংগঠন বাদে। অন্য কোনো দল স্বাভাবিক কার্যক্রম করতে পারছে না’- অভিযোগ করেন তিনি।
ছাত্রদলের সাবেক এ সভাপতি বলেন, ম্যাডামের (বেগম খালেদা জিয়া) সহায়ক সরকারের প্রস্তাবনার সঙ্গে সঙ্গে আলোচনার প্রসঙ্গ আসবে। একটি সুনির্দিষ্ট সময়ের পর তো আমরা আন্দোলনে যাব। আন্দোলনটা সহায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে হবে। আমরা তো অনন্তকাল বসে থাকব না, আওয়ামী লীগের এমনটি ভাবাও ঠিক হবে না।
দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে আমরা সদস্য সংগ্রহের অভিযানের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। নেত্রী বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন। তিনি সেখানে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা নিয়ে কাজ করছেন। দেশে এসে বিষয়টি ঘোষণার পর এর পক্ষে আমরা জনমত গড়ে তুলব। জনমত সৃষ্টিতে জনসংযোগমূলক কর্মসূচিও আমরা দেব।
সহায়ক সরকারের দাবি মানা না হলে পরবর্তী কর্মসূচি কী হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে, ‘তখনই দেখা যাবে’ বলে মন্তব্য করেন প্রবীণ এ বিএনপি নেতা।
সূত্র: জাগোনিউজ
Discussion about this post