অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
আইএফআইসি ব্যাংক কর্মকর্তা শামীম আহমেদ। অফিসের লাঞ্চের বিরতিতে লাঞ্চ করতে এসেছেন খানা বাসমতিতে। ব্যস্তময় পল্টনের জনপ্রিয় খাবারের রেস্টুরেন্ট সেটি। কে জানতো অপহরণকারীরাও সেখানে আয়েশ করে খেয়েছে বেশ সময় নিয়েই। সাম্প্রতিক এই অপহরণের ঘটনা নিয়ে বেশ তোলপাড় হয় সর্বত্র।
শামীম আহমেদ আইএফআইসি ব্যাংকের করপোরেট কমিউনিকেশন্স ও ব্র্যান্ডিং বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট। গত ২৩ আগস্ট বুধবার দুপুর ১টার কিছু পর মোবাইলে ফোন করে একসঙ্গে খাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে অফিস থেকে শামীমকে ডেকে নেন তার বন্ধু টিটু। দুপুর পৌনে ২টার দিকে পুরানা পল্টন এলাকার ‘খানা বাসমতি’ রেস্টুরেন্টের সামনে যান শামীম। রেস্টুরেন্টে ঢোকার আগমুহূর্তে একটি সাদা রঙের কালো গ্লাসের হাইয়েস মাইক্রোবাসে তাকে জোর করে তুলে নিয়ে যায় মধ্য বয়সী ৯-১০ ব্যক্তি। এর পর থেকে তার দুটি সেলফোনই বন্ধ পাওয়া যায়। এদিকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর শামীমের দেরি দেখে অপেক্ষমাণ তার বন্ধু টিটু হোটেলের ভেতর থেকে বের হয়ে সামনের পান-সিগারেটের দোকান ও গার্ডদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন ‘ডিবি পুলিশ’ পরিচয়ে শামীম আহমেদকে তুলে নিয়ে গেছে কয়েকজন। এর পর টিটু আইএফআইসি ব্যাংক ও শামীমের স্বজনদের বিষয়টি জানান।
হোটেলে আসা থেকে শুরু করে অপহরণের পুরো দৃশ্য ধরা পড়েছে বাসমতি রেস্টুরেন্টের সিসিটিভি ফুটেজে, যা ইতোমধ্যে পল্টন থানা পুলিশ ও র্যাব ৩-এর কর্মকর্তারা সংগ্রহ করেছেন। তাতে দেখা গেছে, ঘটনার আগে শামীমের অপহরণকারীরা ওই রেস্টুরেন্টের সামনে প্রায় দুই ঘণ্টা সাদা রঙের একটি ‘হাইয়েস মাইক্রোবাস’ নিয়ে অপেক্ষা করে। রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবারও খায় তারা। এর পর শামীম রেস্টুরেন্টে খেতে এলে তাকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে নেয় দুর্বৃত্তরা। অপহরণকারীদের চেহারা, গাড়ির নম্বর, খাওয়া-দাওয়া সব সিসিটিভির ফুটেজে রেকর্ড আছে। সদিচ্ছা থাকলে ওইসব ফুটেজ দেখে খুব সহজে অপহরণকারীদের চিহ্নিত করা সম্ভব। কিন্তু তাকে উদ্ধার দুরে থাক; তার অবস্থানও শনাক্ত করতে পারেননি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
কে বা কারা শামীম আহমেদকে তুলে নিয়ে গেছে, তা ধারণা করতে পারছেন না জানিয়ে শামীমের স্ত্রী শিল্পী বলেন, নিখোঁজের পর কেউ আমাদের কাছে মুক্তিপণ চায়নি। শামীমকে কেউ কখনো কোনো হুমকি দিয়েছে বলেও আমাদের জানা নেই। তা ছাড়া সে কোনো রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত নন।
‘খানা বাসমতি’ রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রত্যক্ষদর্শীসূত্রে জানা গেছে, সেদিন দুপুরে হোটেলের সামনে প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাস দাঁড়ানো ছিল। দুপুর ১টা ১০ মিনিটের দিকে দুজন লোক রেস্টুরেন্টে এসে নিচতলায় মাঝামাঝি স্থানে দুটি টেবিল বুক করে। এর পর পূর্বনির্ধারিত টেবিলে না বসে ৯ জনের ওই দল রেস্টুরেন্টে প্রবেশের মুখে প্রথম দুটি টেবিল একসঙ্গে করে দুপাশে চারজন করে বসে খাওয়া-দাওয়া করে। পাশের টেবিলে আলাদা বসেন দলের একজন। এই ৯ জনের খাবার পরিবেশনের দায়িত্বে ছিলেন রেস্টুরেন্টের বয় ময়নাল হোসেন। খাবারের বিল ৩ হাজার ৩৪০ টাকা পরিশোধের পাশাপাশি বয় ময়নালকেও তারা ৫০ টাকা বকশিশ দেয়।
হোটেলের কর্মচারি খান বাহাদুর প্রথম আলো পত্রিকাকে বলেছেন, স্যুট-টাই পরা একটা লোককে (শামীম) কিছু লোক টানাহ্যাঁচড়া করছিলেন। একপর্যায়ে সেই লোকটির একটি পা নালায় পড়ে যায়। এতে করে সেখানে লোকজন জমে যায়। কেউ এগোতে গেলে অপহরণকারীরা বলেন, ‘এ আমাদের আসামি।’ পরে ধরে লোকগুলো টেনে তাঁকে মাইক্রোবাসে তোলেন।
ঘটনার দিন রাতে পল্টন থানার ওসি মো. মাহমুদুল হক বলেন, ব্যাংক কর্মকর্তা শামীমের অবস্থান এখনো শনাক্ত করা যায়নি। ঘটনা তদন্তে বেশ কিছু আলামত জব্দ করা হয়েছে। নিখোঁজের পর থেকে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি বন্ধ থাকায় প্রযুক্তিগত তদন্তে লোকেশন শনাক্ত করা অনেকটাই দুরূহ হয়ে পড়েছে। শামীম আহমেদের পরিবারের পক্ষ থেকে জিডি ছাড়া কোনো মামলা করা হয়নি। ঘটনায় জড়িতদের ধরতে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
https://www.youtube.com/watch?v=Atxg9snD5yo
অপহরণের ৫ দিন পর সেই ব্যাংক কর্মকর্তা শামীম আহমেদকে চোখ বাঁধা অবস্থায় ফেলে গেছে দুর্বৃত্তরা। সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে মতিঝিলের কোনো একটি জায়গায় তাকে ফেলে রেখে যায়। পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় তিনি স্ত্রী শিল্পি আহমেদকে অপরিচিত একটি নম্বর থেকে ফোন করে তার অবস্থানের কথা জানান। এরপর পরিবারের লোকজন এসে তাকে উদ্ধার করে বাসায় নিয়ে যায়।
শামীম ফিরে এলেন। নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। অন্যসব গুমফেরত লোকদের মত তিনিও চুপ হয়ে গেলেন। পুরোপুরি চুপ। কেউ জানলো না তার কী হলো? কেউ আর অপহরণকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করলো না। স্পষ্ট চিহ্নিত হওয়ার পরও পার পেয়ে গেল অপহরণকারীরা।
বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে অহরহ ঘটে চলা গুম অপহরণের জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ সুশীল সমাজ ও দেশি বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়ী করে আসছে। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করা হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে অপহরণের ঘটনাগুলোতে অনেকগুলোতেই দেখা গেছে গুম হওয়া সেই ব্যক্তিকে পরবর্তীতে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তাছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে অপহরণের ঘটনায় জিডি কিংবা মামলা নিতেও পুলিশ অস্বীকৃতি জানায়। এসব কারণে বেশিরভাগ অপহরণ ও গুমের পিছনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জড়িত থাকার ব্যপারটি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যতই অস্বীকার করুকনা কেনো।
এসব অপহরণ ও গুমের পেছনে যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত না থাকতো, তাহলে আইএফআইসি ব্যাংক এর এই কর্মকর্তা অপহরণের ঘটনায় সিসি ক্যামেরায় স্পষ্ট ধরা পড়া দুই ব্যাক্তিকে শনাক্তকরণ ও গ্রেপ্তারের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জড়িত না থাকার ব্যপারটা প্রমান করার সুযোগ ছিলো। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেই কাজটি করেনি।
হোটেলটির সিসি ক্যামেরায় দেখা গেছে, একজন আকাশি ফুল শার্ট, আরেকজন আকাশি পোলো টিশার্ট পরে খাচ্ছেন। তাঁরা স্বাভাবিক গল্পগুজবও করছেন। ক্যামের তাদের চেহারা এতটাই স্পষ্ট ছিলো যে তাদের শনাক্ত করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে খুবই সহজ কাজ ছিলো। কিন্তু তাদেরকে শনাক্ত না করায় এই অপহরণকারীরা যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরই লোক সেটাই আবারও প্রমাণ হলো। এমনকি সিসি ক্যামেরার স্পষ্ট ফুটেজ যাতে আলোচনায় না আসে সেজন্য অপহৃত ব্যক্তিকে দ্রুত ছেড়ে দিয়ে এই ঘটনাকে দ্রুত মাটি চাপা দেয়া হয়েছে বলেও অনেকেই ধারণা করছেন।
এই ঘটনা নিয়ে পল্টন থানার ওসি বলেছেন, “হয়তো আমাদের আওতার বাইরের কেউ অপহরণ করেছেন”। পল্টন থানার ওসির এমন মন্তব্যে জনমনে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। ওসির এই মন্তব্যে অনেকটাই স্পষ্ট যে এসব অপহরণ ও গুমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপরের স্তরের লোকজনই জড়িত। যারা থানা পুলিশ কিংবা ওসির আওতার বাইরে। এজন্যই কি সিসি ক্যামেরায় স্পষ্ট ধরা পড়া অপহরণকারীরা শনাক্ত কিংবা গ্রেপ্তার হয়নি?
Discussion about this post