রকীব কমিশনের ধারাবাহিকতায় আস্থা হারাচ্ছে নতুন দায়িত্ব নেয়া নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গণমাধ্যমের সাথে বৈঠক শেষে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যস্থতার দায়িত্ব না নেয়ার ঘোষণা দেন সিইসি। নির্বাচনী ব্যবস্থা কী হবে তা সরকারের ওপর ছেড়ে দেন। এ ছাড়াও গণমাধ্যমের সাথে সংলাপের সময় চারটি প্রথম সারির দৈনিকের সম্পাদককে দাওয়াত না দিয়ে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের কর্মকাণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ফলে ইসিকে ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে নানা ধরনের প্রশ্ন। এভাবে চলতে থাকলে ইসির প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলবে বলে আশঙ্কা করছেন নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত জুলাই মাসের প্রথম দিকে সিইসি ও ইসি সচিব নির্বাচন কমিশনারদের না জানিয়ে পাঁচজন আঞ্চলিক কর্মকর্তা, ১৮ জন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাসহ ৩৩ জনের রদবদলের আদেশ জারি করেন। এতে বিস্ময় প্রকাশ করেন বাকি চার নির্বাচন কমিশনার।
সে সময় ইসি সচিবকে ইউও নোটে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার লেখেন, বিষয়টি আমাকে কিছুটা বিস্মিত করেছে। কারণ কোনো পর্যায়েই আমাকে তা অবহিত করা হয়নি।
তিনটি বিষয় জানতে চেয়ে তিনি লেখেন, নিয়োগ, পদোন্নতি, প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্বিন্যাস এবং দক্ষতা উন্নয়ন কমিটি নামে ১২ জুন যে কমিটি গঠিত হয়েছে, এ বদলি-পদোন্নতি তার কার্যপরিধির আওতায় পড়ে কি না; এ কমিটির সভায় তা আলোচিত হওয়া উচিত ছিল কি না ও কমিটিকে অবহিত করা না হলে কমিটির আবশ্যকতা থাকে বলে প্রতীয়মান হয় কি না এবং কোন নিয়মনীতি অনুসরণ করে তা করা হয়েছে। পাশাপাশি এ সম্পর্কে যাবতীয় নির্দেশ, আদেশ ও অন্যান্য নথিপত্র তার কাছে দ্রুত পেশ করার পরামর্শ দেন মাহবুব তালুকদার।
এ ঘটনার পর গত ২০ জুলাই নির্বাচন কমিশনের সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহকে শিল্প মন্ত্রণালয়ে বদলি করে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার হেলালুদ্দীন আহমদকে ভারপ্রাপ্ত সচিব পদমর্যাদায় নির্বাচন কমিশনের সচিব নিয়োগ দেয় সরকার।
নতুন এই ভারপ্রাপ্ত সচিব ১৯৮৮ সালে চাকরিতে যোগদান করেন। তার মেধাক্রম ৭৭ হলেও ৭৬ জনকে ডিঙিয়ে তাকে সচিব পদে প্রমোশন দিয়ে ওই ব্যাচের মধ্যে সর্বপ্রথম সচিব করা হয়।
২০০৪ সালে তিনি চট্টগ্রামের মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিনের পিএস হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত চার বছর ফরিদপুরের ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০১২ সালে তিনি ডিসির দায়িত্ব পালনকালে ওই বছরের অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় ময়েজউদ্দীন উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে তার ছেলেকে অনৈতিক সুবিধা দেন। ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়িতে চড়ে এসে অবৈধভাবে হলে ঢুকে জেলা প্রশাসকের ছেলে সারজাত শামীমকে নকল সরবরাহ করে জিলা স্কুলের গণিত শিক্ষক মো: আলাউদ্দীন। পরে পুলিশ তাকে আটক করলেও হেলালুদ্দীনের চাপে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। বিষয়টি ওই সময়ের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তার দলীয় আনুগত্যে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে একাধিকবার শ্রেষ্ঠ জেলা প্রশাসক বানায় সরকার।
নতুন সচিব হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর সরকারের আস্থাভাজন এই কর্মকর্তা নির্বাচন কমিশনের কলকাঠি নাড়তে শুরু করেন। অন্য চারজন নির্বাচন কমিশনারকে বাদ দিয়ে শুধু সিইসিকে সাথে নিয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে থাকেন।
ইসির ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী গত ৩১ জুলাই সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের সাথে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এ সংলাপেও প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান, প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীনের মতো গুণীজনদের দাওয়াত দেয়া হয়নি। এরপর গত ১৬ ও ১৭ আগস্ট গণমাধ্যমের সাথে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সংলাপেও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি দেশের প্রথম সারির দৈনিক নয়া দিগন্ত, ইনকিলাব, আমার দেশ ও সংগ্রাম সম্পাদককে। কলামিস্ট হিসেবেও ভিন্নমতের কারণে অনেকে তালিকায় স্থান পাননি। বিএফইউজের সরকার সমর্থক অংশের সভাপতি ও মহাসচিবকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও বাদ দেয়া হয়েছে অপর অংশের সভাপতি শওকত মাহমুদকে।
এরপর গণমাধ্যমের সাথে সংলাপের শেষ দিনে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে বক্তব্য দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। সে দিন তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলের মধ্যে মধ্যস্থতা করা ইসির কাজ নয়। ইসি সেটি করতেও চায় না। এ ছাড়া নির্বাচনের সময় কোন ধরনের সরকার থাকবে, তাও ইসির দেখার বিষয় নয়। সরকারের নির্ধারিত ফর্মুলায় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সিইসির এমন বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সব দলের অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণের দায়িত্ব ইসির। যেভাবে সুষ্ঠু ভোট সম্ভব সে ব্যবস্থাই করতে হবে ইসিকে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে তার এ বক্তব্য কোনোভাবেই কাম্য নয়।
সূত্র: নয়াদিগন্ত
Discussion about this post