সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় সম্পর্কে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও বর্তমান আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হকের সংবাদ সম্মেলনে দেয়া বক্তব্য নিয়ে আইনাঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়েছে।
তার কিছু মন্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞসহ দেশের একাধিক শীর্ষ আইনজীবী। তারা বলেছেন, বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং সংঘাতময় পরিস্থিতির জন্য বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকই দায়ী। প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায় একটি পক্ষকে খুশি করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা (ত্রয়োদশ সংশোধনী) বাতিল করেছেন। অথচ এ ব্যবস্থা ছিল দেশের সাধারণ মানুষের আন্দোলনের ফসল। আশা-আকাঙ্খা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কেন্দ্রবিন্দু। অথচ একটি পক্ষকে খুশি করতে গিয়ে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেশকে চূড়ান্তভাবে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় সংবিধান বিশেষজ্ঞসহ শীর্ষস্থানীয় একাধিক আইনজীবী এসব কথা বলেন। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, ‘সাবেক কোনো প্রধান বিচারপতি আপিল বিভাগের রায় নিয়ে অতীতে কখনও মন্তব্য করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। তিনি অতি উৎসাহী হয়ে এ কাজটি করেছেন, যা দুঃখজনক।
বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক হয়তো বলবেন, তিনি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে কথা বলেছেন, প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এটি তার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না।’
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম যুগান্তরকে বলেন, ‘বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক আইন কমিশনের চেয়ারম্যান। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে কথা বলার জন্য তিনিই যথার্থ এবং উপযুক্ত ব্যক্তি। আইন কমিশনের কাজই হচ্ছে আদালতের দেয়া রায় মূল্যায়ন করা, রায় পর্যালোচনা করা, রায়ের ভালো-মন্দ, ত্রুটি-বিচ্যুতি উভয় দিক দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে এবিএম খায়রুল হক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সঠিক কাজটিই করেছেন।’
উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব জাতীয় সংসদে পাস হয়, যা ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পরিচিত। এক রিট মামলার রায়ে হাইকোর্ট গত বছর ওই সংশোধনী ‘অবৈধ’ ঘোষণা করলে ৩ জুলাই আপিলের রায়েও তা বহাল থাকে। ১ আগস্ট আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে জানা যায়, ৯৬ অনুচ্ছেদের ছয়টি ধারা পুনর্বহাল করার মধ্য দিয়ে সামরিক সরকারের করা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান ফিরিয়ে এনেছেন সর্বোচ্চ আদালত।
মোট ৭৯৯ পৃষ্ঠার এ রায়ের পর্যবেক্ষণে রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনামূলক বেশ কিছু বক্তব্য তুলে ধরা হয়। প্রথমদিকে এ ইস্যুতে কথা না বললেও রায়ের এক সপ্তাহ পর মুখ খোলেন সরকারের সিনিয়র মন্ত্রীসহ শীর্ষ নেতারা। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়কমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানান। এর আগেই বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে রায় সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া দেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক।
ওই রায়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার কিছু পর্যবেক্ষণ নিয়ে তিনি কঠোর সমালোচনা করেন। সর্বোচ্চ আদালতের ওই রায়কে ‘পূর্বধারণাপ্রসূত’ এবং সংসদ সদস্যদের নিয়ে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণকে এবিএম খায়রুল হকের কাছে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ মনে হয়েছে। এছাড়া শব্দচয়নে তিনি দেখতে পাচ্ছেন ‘অপরিপক্বতা’।
২০১০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১১ সালের মে পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করা এবিএম খায়রুল হক সংবাদ সম্মেলনে আরও বলেন, বাংলাদেশ যেহেতু প্রজাতন্ত্র, সেহেতু জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী সংসদের কাছে বিচারকদেরও জবাবদিহিতা থাকার কথা। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের ফলে তা আর থাকল না। তিনি বলেন, ‘আমরা এতকাল জেনে এসেছি, দিস ইজ পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ, কিন্তু এ রায়ের পরে মনে হচ্ছে, উই আর নো লংগার ইন দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ। উই আর রাদার ইন জাজেস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ।’
বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের এ মন্তব্যের পরপরই শুরু হয় ব্যাপক তোলপাড়। বিশেষ করে আইনাঙ্গনে দেখা দেয় তীব্র প্রতিক্রিয়া। আদালতের বিষয় তাই এ নিয়ে যুগান্তরের কাছে রাজনীতিবিদরা মতামত প্রকাশ করতে না চাইলেও একাধিক শীর্ষ আইনজীবী এবিএম খায়রুল হকের কঠোর সমালোচনা করেন। তার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তারা।
এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক আরও বলেন, ‘যে কোনো রায় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা-পর্যালোচনা হবে। কিন্তু এ কাজটি আইন কমিশনের নয়। এটি আইন কমিশনের কাজের মধ্যে পড়েও না। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক হয়তো বলবেন, ব্যক্তি হিসেবে রায়ের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এটিও কোনোভাবেই সমীচীন নয়।
তিনি রায় নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে নিজের অবস্থান, আইন কমিশন এবং বিচার বিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। যা সত্যিই দুঃখজনক। একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে মানুষ এমনটা আশা করেন না।’
ড. শাহদীন মালিক আরও বলেন, ‘রায় আগে থেকেই লিখে রাখা হয়েছে’, ‘বিচার বিভাগ অপরিপক্ব’- এ ধরনের কথাবার্তা তার (এবিএম খায়রুল হক) মুখ থেকে শোভা পায় না। একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ ধরনের কথা কোনো অবস্থাতেই বলতে পারেন না। কারণ, তিনি নিজেও কর্মজীবনে অনেক রায় দিয়েছেন। কেউ যদি তার দেয়া সেসব রায় নিয়ে এখন প্রশ্ন উত্থাপন করেন- জবাবে কি বলবেন?’
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য এবিএম খায়রুল হককে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়ে তিনি (এবিএম খায়রুল হক) তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছেন।
এর মধ্য দিয়ে তিনি দেশের স্থিতিশীলতা ধ্বংস করেছেন। দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিয়েছেন। এ অস্থিতিশীলতার শেষ কোথায় আমরা কেউ জানি না।’ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা দেশের মানুষের আশা-ভরসার জায়গা ছিল। এ ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক দেশের গণতন্ত্রের জন্য সর্বোচ্চ খারাপ নজির স্থাপন করে গেছেন।’
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে এবিএম খায়রুল হক দেশকে চূড়ান্তভাবে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। এ ব্যবস্থা বাতিল করার পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েছেন। ভবিষ্যতে হয়তো আরও বড় কোনো পুরস্কারের আশায় ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে তিনি মনগড়া কথা বলেছেন। ভবিষ্যতে তিনি হয়তো আরও বড় ধরনের পুরস্কারের আশা করছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এবিএম খায়রুল হক পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করার মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমানের শাসনামল অবৈধ ঘোষণা করেন। কিন্তু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল রাখেন, যা জিয়াউর রহমানের সময়েই করা। তখন তিনি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল রাখার পক্ষে মত দিলেন, এখন কেন এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে তো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলই বহাল রাখা হয়েছে। এতে তার-ই তো খুশি হওয়ার কথা।’
অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী আরও বলেন, ‘এবিএম খায়রুল হক একজন স্ববিরোধী মানুষ। আদালতের রায় নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করার মধ্য দিয়ে তিনি নিজের যোগ্যতা নিয়েই প্রকারান্তরে প্রশ্ন উত্থাপন করলেন। বিচার বিভাগের সম্মান এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। যা তিনি কোনোভাবেই করতে পারেন না। আদালতের রায় বিশ্লেষণ করার জন্য আইন কমিশনে তাকে বসানো হয়নি। তার কাজ আইন প্রণয়নে সহায়তা করা। কাউকে খুশি করে বক্তব্য দেয়া তার কাজ নয়।’
তিনি বলেন, ‘বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় যখন আদালতে প্রকাশ্যে পড়ে শোনান তখন তিনি বলেছিলেন আরও দুই মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। অথচ এর ১৬ মাস পর যখন তিনি পূর্ণাঙ্গ রায় লিখিতভাবে প্রকাশ করলেন তাতে এ কথাটাই বাদ দিয়ে জাতির সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। একটি পক্ষকে খুশি করতেই তিনি এ কাজটি করেছেন। পরে এর পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হয়ে।’
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে এবিএম খায়রুল হক যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘এবিএম খায়রুল হক মুন সিনেমা হলের অধিগ্রহণ সংক্রান্ত মামলার রায় দিতে গিয়ে উদ্দেশ্যমূলক পূর্বপরিকল্পিত অপ্রাসঙ্গিকভাবে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেছেন। তিনি পঞ্চম ও ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়কেও বিতর্কিত করেছেন। এ কারণে বিচারপতি খায়রুল হক ষোড়শ সংশোধনীর রায় বাতিলে পূর্ব পরিকল্পনার গন্ধ পাচ্ছেন।’
সূত্র: যুগান্তর
Discussion about this post