আলফাজ আনাম
ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা সারা দেশে কিভাবে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে, তার সামান্য কিছু বিবরণ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এসব খবর প্রকাশের পর সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা দাবি করে থাকেন, এই অপকর্মের সাথে দলের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু দলীয় প্রভাব খাটিয়ে দখল, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। এরমধ্যে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের কুকর্মের তাণ্ডব নিয়ন্ত্রণহীন পর্যায়ে চলে গেছে। এসব সংগঠন স্থানীয়পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রভাব বিস্তারের মূল শক্তি। নেতারা কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে থেকে এদেরকে ব্যবহার করে এলাকায় ক্ষমতা প্রদর্শন করেন। ফলে ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা শ্রমিক লীগের দায় কোনোভাবেই আওয়ামী লীগ এড়াতে পারে না।
সম্প্রতি বগুড়ায় এক কলেজপড়ুয়া গরিব ছাত্রীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করেছে স্থানীয় শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক তুফান সরকার। শুধু তাই নয়, এই ছাত্রী ও তার মাকে বেদম মারধর করে মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছে। তুফান সরকারের পরিচয় দিতে গিয়ে একটি দৈনিকে বলা হয়েছে, ‘খুন, চাঁদাবাজি, মাদকব্যবসা, দখল সব কিছুই ডালভাত তার কাছে। ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত হত্যা, হত্যাচেষ্টা, মাদকব্যবসা ও চোরাচালানের ছয়টি মামলার আসামি এই যুবক। ক্ষমতাসীন দলের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে ছয় বছরে গাড়ি, বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে গেছেন। প্রশাসন আর নেতাদের হাতে রাখতে ঢেলেছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। ক্ষমতা আর অর্থের একচ্ছত্র দাপটে এত দিন নানা অপকর্ম করলেও দলীয় নেতাদের আশীর্বাদে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেছেন তিনি। নানা অপকর্মে জড়িত থেকেও বাগিয়েছেন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন শ্রমিক লীগের শহর শাখার শীর্ষ পদ। এই তুফান ছাত্রী ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনার মূল হোতা। গত শুক্রবার রাতে ধর্ষণ ও অপহরণ মামলায় বগুড়া সদর থানার পুলিশ গ্রেফতার করেছে তাকে। এ ঘটনায় তোলপাড় পড়ে যাওয়ায় সংগঠন থেকে তাকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। ( প্রথম আলো ৩১ জুলাই ২০১৭)
ক্ষমতাসীন দলে তুফানের মতো ঝড় তোলা এমন নেতা সারা দেশেই আছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ ধরনের ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে। বগুড়ার ঘটনাটি যেভাবে বড় আকারে গণমাধ্যমে এসেছে, অন্য ঘটনাগুলো এতটা গুরুত্ব পায়নি। বগুড়ার ঘটনা শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের আরো অনেক দেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে, থানায় বসে থাকা মাথা ন্যাড়া করা মা ও মেয়ের ছবিসহ লন্ডনের ডেইলি মেইল বেশ বড় করে খবরটি প্রকাশ করেছে। আসলে সারা দেশে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা এভাবে নারীদের নানাভাবে নির্যাতনের ঘটনার সাথে জড়িত হয়ে পড়ছে। আমরা গত কয়েক মাসে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর দেখলে পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে অনুধাবন করতে পারব।
১.ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে ধর্ষণ মামলায় উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহিন হোসেন ওরফে শেখ শাহিনসহ (২৩) তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কোটচাঁদপুর পৌর এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হওয়া অন্য দু’জন ছাত্রলীগ কর্মী রাজু আহম্মেদ (২৪) ও কৃষ্ণ সাহা (২৩)। কোটচাঁদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিপ্লব কুমার সাহা বলেন, ৫ মে দুই তরুণী ট্রেনে করে ঢাকায় যাওয়ার জন্য কালীগঞ্জ শহর থেকে কোটচাঁদপুর রেলস্টেশনে আসেন। সেখানে তারা ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। রাত ১০টায় পাঁচ ব্যক্তি তাদের মিথ্যা কথা বলে পাশের আমবাগানে নিয়ে যায়। সেখানে ধর্ষণের শিকার হন দুই তরুণী। পরে ভয় দেখিয়ে তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বুধবার সকালে এক তরুণী বাদি হয়ে পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে কোটচাঁদপুর থানায় একটি মামলা করেন (মামলা নম্বর ৯)। শেখ শাহিন ওই মামলার ১ নম্বর আসামি। পুলিশ এজাহারভুক্ত তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। (প্রথম আলো ১১ মে ২০১৭)
২. ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় এক ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে ঘটনার পাঁচ মাস পরে মামলা হয়েছে। কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি কামরুল ইসলাম জানান, মেডিক্যাল টেস্টে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় ছাত্রীর বাবা তিনজনকে আসামি দেখিয়ে মামলা করেছেন। আসামিরা হলেন- উপজেলার হবিরবাড়ি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর কবির, তার বন্ধু তুষার (২৬) ও স্থানীয় মাইক্রোবাসচালক মোখলেছ (২৫)। ছাত্রীর বাবা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার কলেজছাত্রী মেয়েকে কলেজে যাওয়া-আসার পথে আলমগীর প্রায়ই উত্ত্যক্ত করত। ‘গত ১১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের কাছে একটি মাইক্রোবাসে তুলে ধর্ষণ করে আলমগীর ও তার সঙ্গীরা। তারা তাকে অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে যায়। পরে তার বান্ধবীরা তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।’ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ২৪ মে ২০১৭)
৩. বরিশালের বানারীপাড়ার বেতাল গ্রামে টেম্পোচালক স্বামীকে আটকে রেখে নববধূ ধর্ষণ মামলায় উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সুমন হোসেন মোল্লাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সে বেতাল গ্রামের মৃত খবির উদ্দিন মোল্লার ছেলে এবং বানারীপাড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। এক লাখ টাকা চাঁদা না দেয়ায় বেতাল গ্রামে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সুমন মোল্লা গত শনিবার রাতে স্বামী সেলিমকে আটকে রেখে নববধূকে ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় গত রোববার ধর্ষিতা বাদি হয়ে মামলা করেন। (মানবজমিন ১৮ জুলাই ২০১৭)
আমরা দেখছি কয়েক বছর ধরে দেশে ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের মতো ঘটনা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, সমাজবিরোধী ব্যক্তিরা এখন নানাভাবে ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে চলছে। এরা হয়ে পড়ছে স্থানীয়পর্যায়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। বগুড়ায় তুফান সরকার, বরিশালে সুমন মোল্লা কিংবা ঝিনাইদহের শেখ শাহিনের মতো ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতারা যখন নিজেরাই এমন অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে, তখন তাদের অনুগত ক্যাডাররা স্থানীয়পর্যায়ে কতটা বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। এ ধরনের ব্যক্তিরা যখন সমাজের নিয়ন্ত্রক বনে যায়, তখন সমাজে অপরাধ বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। সংবাদপত্রে খবর প্রকাশের পর এদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু তার আগে এদের কোনো অপরাধ খুঁজে পায় না! এরা দিনের পর দিন নানা ধরনের অপরাধ করলেও দলীয়পর্যায়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। কারণ দল এদেরকে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে দমনের কাজে ব্যবহার করে আসছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নিয়ে এরা সব ধরনের অপকর্ম করে যাচ্ছে।
সমাজে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে; বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে তা বোঝা যায়। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে দেশে নারী ধর্ষণ যে পরিসংখ্যান দিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ছয় মাসে ৩৭১ জন নারী ও মেয়েশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে ১০৫ জন নারী, ২৬৩ জন মেয়েশিশু এবং তিনজনের বয়স জানা যায়নি। ওই ১০৫ জন নারীর মধ্যে ৯ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে, ৩৬ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং দুইজন নারী আত্মহত্যা করেছেন। ২৬৩ জন মেয়েশিশুর মধ্যে ৮ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে, ৫৩ জন গণধর্ষণের শিকার এবং দুইজন মেয়েশিশু আত্মহত্যা করেছে। এই সময়কালে ৪৮ জন নারী ও মেয়েশিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ধর্ষণের মতো মারাত্মক অপরাধ সমাজে ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে এবং সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে ধর্ষণের শিকার ভিকটিমরা ও তাদের পরিবারগুলো ধর্ষণের বিষয়টি গোপন করে অথবা প্রকাশ করলেও বিচার পান না।
সমাজে এই যখন অবস্থা তখন নারী অধিকার নিয়ে যারা সোচ্চার, তারা একেবারেই নিশ্চুপ। বিশেষ করে এ দেশের পরিচিত নারীবাদীরা রহস্যময় নীরবতা পালন করছেন। এর কারণ বোঝা খুব কঠিন নয়। আওয়ামী লীগের মতো প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা যখন এমন অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে তখন তারা খুবই লজ্জা পান। তারা এতটাই অধোবদন হয়ে পড়েন যে, মুখে আর কথা ফুটে না। কিন্তু গ্রামেগঞ্জে কোনো হুজুর ওয়াজ মাহফিলে নারীদের নিয়ে ‘অসম্মানজনক’ কিছু বললে তাদের মুখে খই ফোটে। হুজুরকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের দাবি তো থাকেই, কিভাবে ওয়াজ মাহফিল বন্ধ করতে হবে তার নানা পথও বাতলে দেয়া হয়। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের অপরাধী ক্যাডাররা শির উঁচু করে ঘোরাফেরা করলে তারা শুধু লজ্জা পান। স্কুল বা কলেজপড়ুয়া মেয়েকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করলে তার প্রতিবাদ করার সাহসটুকুও হারিয়ে ফেলেন। ১৯৯৫ সালে বিএনপি সরকারের আমলে দিনাজপুরে ইয়াসমিন হত্যা নিয়ে এ দেশের নারীবাদীরা প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। এই আন্দোলনের কারণে সে সময় সরকারকে শুধু দেশের ভেতরে নয়, বাইরে থেকে প্রবল চাপের মুখে পড়তে হয়েছে। এখন ইয়াসমিন ধর্ষণের মতো বহু ঘটনা ঘটলেও তারা নীরব থাকেন।
আজকে অপরাধীরা যে সমাজে নিয়ন্ত্রক হয়ে গেছে, এর কারণ শুধু ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা নয়, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য তথাকথিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বেসরকারি সংগঠনগুলোর দ্বিমুখী আচরণ কম দায়ী নয়। নারী নিপীড়নের মতো অপরাধ কমিয়ে আনার জন্য বা অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে তারা যতটা সোচ্চার তার চেয়ে বেশি সোচ্চার কিভাবে ইসলামপন্থীদের কোণঠাসা করা যায় তার কৌশল আঁটতে। অথচ নারীরা এখন সবচেয়ে লাঞ্ছিত, অবহেলিত এবং অবমাননা ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া সমাজবিরোধী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর হাতে। ওদের সাথে ক্ষমতাসীন দল কিংবা কথিত প্রগতিশীল সুবিধাবাদী রাজনৈতিক শক্তির গভীর সংযোগ রয়েছে। অপরাধীদের সাথে রাজনৈতিক চক্রের এই কাঠামো যদি ভাঙা না যায়, তাহলে এ দেশে নারীদের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়ন কোনোভাবেই বন্ধ করা যাবে না।
সূত্র: নয়াদিগন্ত
Discussion about this post