জুনায়েদ আব্বাসী
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এদেশের একটি পুরনো, আলোচিত, সমালোচিত ও সর্ববৃহৎ ইসলামি রাজনৈতিক দল। দলটির মতে তারা ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। দীর্ঘ পথ চলায় দলটির কার্যক্রম মাঝখানে নিষিদ্ধও করা হয়েছে কয়েকবার। বহুবার সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও দলটির গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রয়েছে। এছাড়া সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই দলটি মাঠে-ময়দানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
স্বাধীনতার পর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের মাধ্যমে যে কয়টি সংসদ গঠিত হয়েছে প্রতিটি সংসদেই জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব ছিল। ১৯৯১ সালে জামায়াতের সমর্থন নিয়েই সরকার গঠন করেছিল বিএনপি।
তৎকালীন বিএনপি সরকারের স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীই প্রথম রাজপথে আন্দোলনের সূচনা করেছিল। বিএনপি সরকারের আচরণ দেখেই জামায়াত মনে করছিল যে আগামীতে বিএনপির অধীনে সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। এলক্ষ্যে জামায়াতের তৎকালীন আমির অধ্যাপক গোলাম আযম নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের রূপরেখা পেশ করেছিলেন।
দেখা গেছে, তখন প্রধান বিরোধীদল আওয়ামী লীগও জামায়াতের এই কেয়ারটেকার সরকারের রূপরেখা সমর্থন করেছিল। জামায়াতের দেয়া এই ফর্মূলা কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে তখন জামায়াতকে নিয়ে আওয়ামী লীগ বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে। ৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর সরকার পতনের যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেখানে জামায়াতের অবদানই ছিল বেশি। আওয়ামী লীগ-জামায়াতের আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপি সরকারের পতনের পর ১২ জুন আবার সব দলের অংশগ্রহণে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
ওই নির্বাচনে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ জামায়াতের ৩ জন এমপি নির্বাচিত হন। অভিযোগ রয়েছে, ওই নির্বাচনে প্রতিবেশি দেশ পরোক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করেছিল। এবং পরিকল্পিতভাবে অনেক জনপ্রিয় প্রার্থীদের হারানো হয়েছিল।
এরপর ১২ জুনের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করার পরই আওয়ামী লীগের পুরনো চেহারা প্রকাশিত হতে থাকে। শুরু হয় জামায়াতের ওপর আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়ন। দিন যত যায় সরকারের নির্যাতনের মাত্রাও বাড়তে থাকে। বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে মিলে যখন জামায়াত সরকার বিরোধী আন্দোলনে মাঠে নামে তখনই চরমভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে আওয়ামী লীগ।
তারপর ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের কাছে বিপুল আসনে পরাজিত হয় আওয়ামী লীগ। সরকারে জামায়াতের দুইজনকে দুইটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী কৃষি ও শিল্প মন্ত্রণালয় এবং সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব সফলভাবে পালন করেন।
পরবর্তীতে ওয়ান ইলেভেনের সময় দুর্নীতির দায়ে অনেককে আটক করলেও জামায়াতের দুই মন্ত্রী ও এমপিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ খুঁজে পায়নি ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের সেনাশাসিত সরকার। দুর্নীতিমুক্তভাবে মন্ত্রণালয় পরিচালনা করে দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিলেন জামায়াতের দুই মন্ত্রী।
তারপর ২০০৯ সালের সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতা গ্রহণ করেই তারা জামায়াতের বিরুদ্ধে বিতর্কিত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তুলে। হত্যা-ধর্ষণের কথিত অভিযোগে গ্রেফতার করে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদেরকে। সাজানো বিচারের মাধ্যমে একে একে জামায়াতের ৫ জন শীর্ষ নেতার ফাঁসি কার্যকর করে আওয়ামী লীগ সরকার। এছাড়া দলটির নেতাকর্মীদের ওপর চলে স্মরণকালের সেরা নির্যাতন।
জানা যায়, বাংলাদেশের ইতিহাসে এত নির্যাতন-নিপীড়ন অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ওপর করা হয়নি। শুধু বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন করতেই সরকার জামায়াত নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতনের এই স্টিম রোলার চালিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনীতিক বিশ্লেষকরা। বিগত ৮ বছর যাবত জামায়াতের নেতাকর্মীরা বাসা বাড়িতে থাকতে পারে না। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসতে পারে না। রাস্তায় প্রকাশ্যে হাটতে পারে না। মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে পারে না। এখন পুরুষদেরকে না পেয়ে বাসা বাড়ি থেকে মহিলা ও শিশুদেরকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
জামায়াত নেতাকর্মীরা একসঙ্গে কয়েকজন কোথাও বসলেও সরকার বলছে তারা নাসকতার জন্য গোপন বৈঠক করছে। পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠানও করতে পারছে না তারা। কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারে না জামায়াত নেতাকর্মীরা। এমনকি, দলের কেউ মারা গেলে তার জানাজার নামাজেও সরকার অন্যদেরকে অংশ নিতে দিচ্ছে না।
সোমবার বিকেলে সাতক্ষীরা জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির ও বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন মাওলানা রফিকুল ইসলামের জানাজা পড়ে বাড়ি ফিরার সময় পুলিশ জামায়াতের শতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করেছে। এটাকে চরম অমানিক বলে মনে করছেন সচেতন মানুষ। এদিকে আজ পুলিশ লক্ষ্মীপুর জেলা আমির রুহুল আমীন ভূঁইয়াকে আটক করেছে।
সরকারের এসব কর্মকাণ্ড নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সর্বমহলে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সচেতন মানুষ বলছে, জামায়াত কোনো নিষিদ্ধ সংগঠন নয়। জামায়াতের নেতাকর্মীরা সমাজে ভাল মানুষ হিসেবে পরিচিত। সরকার তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে কেন? আওয়ামী লীগের লোকজন যদি রাজনীতি করতে পারে তাহলে জামায়াতের লোকজন পারবে না কেন? সরকারতো তাদেরকে নিষিদ্ধ করেনি।
Discussion about this post