অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ হাউস অব লর্ডসে আয়োজিত বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক সংকট নিয়ে এক সংলাপ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য লন্ডনে গিয়েও তাতে যোগ দেয়নি আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল। গতকাল মঙ্গলবার লন্ডনের স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে চারটা থেকে সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত ‘বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ ও আইনের শাসন’ শীর্ষক এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।
কেন শেষ মূহুর্তে আওয়ামী লীগ সংলাপ বর্জন করেছিল, বিবিসি বাংলার কাছে তার কারণ ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একজন উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেছেন, এটি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আয়োজিত কোন সংলাপ ছিল না জানতে পারার পরই- তারা সেটি বর্জন করেন।
প্রশ্ন হলো, কাদের আমন্ত্রণে এই সংলাপ ছিলো, সেটা কি তাদেরকে দেয়া দাওয়াতপত্রে ছিলো না? যেই দাওয়াতপত্র পেয়ে তারা লন্ডন গিয়েছিলেন? নিশ্চই ছিলো। তাহলে কি প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টা মূল সত্যকে চাপিয়ে গেছেন? কেনো তারা শেষ মুহুর্তে এই সংলাপ বর্জন করেছেন?
ড. মসিউর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে লন্ডনে যায়। দলটিতে আরও ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আরেকজন উপদেষ্টা গওহর রিজভী ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা: দিপু মনি।
বাংলাদেশ থেকে আসা বিএনপির একটি প্রতিনিধিদলও সেখানে অংশ নেয় এবং সে দলটির নেতৃত্বে ছিলেন দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
এই সংলাপে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি, যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরের দুই প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন, তাদের এড়াতেই কি আওয়ামী লীগ সে অনুষ্ঠানে যায়নি ?
এদিকে এই সংলাপে আমন্ত্রিত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ইউরোপের মুখপাত্র ব্যারিস্টার আবু বকর মোল্লা তার এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সেই সংলাপ বর্জনের কারন হিসেবে সেখানে বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামীকে সেই সংলাপে আমন্ত্রণ জানানোতেই তারা সেই সংলাপ বর্জন করেছে। যদিও এই জামায়াত মুখপাত্র জানিয়েছেন, তাকে গত ৭ জুলাই দাওয়াত দেয়া হয় এবং এ সম্পর্কে আওয়ামী লীগও অবগত ছিলেন।
https://www.youtube.com/watch?v=kiwdtlZABu0
তাহলে কেন আওয়ামী লীগ সংলাপ বর্জন করলো? এ সম্পর্কে আবু বকর মোল্লা তার ভিডিও বার্তায় বলেছেন, কিছুদিন আগে সংগঠিত ব্রিটিশ পার্লামেন্টের একটি মিটিংয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নামে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বরাত দিয়ে বিভ্রান্তমূলক ও অসত্য বক্তব্য পেশ করেছিলেন। যে অভিযোগগুলো তখন তিনি(আবুবকর মোল্লা) পার্লামেন্টে আওয়ামী লীগ নেতোদের সামনেই মিথ্যা প্রমান করেছিলেন এবং মিথ্যাচার প্রমাণিত হওয়ায় আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টে উশৃঙ্খল আচরণ শুরু করে। আবুবকর মোল্লার ধারনা এবারও সেরকম পরিস্থিতির তৈরি হতে পারে এমন ভয়েই আওয়ামী লীগ শেষ মুহুর্তে সংলাপ বর্জন করে।
ওদিকে লন্ডনে বিএনপির প্রতিনিধি দলের নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন হাউজ অব লর্ডসের ওই সেমিনারে আওয়ামী লীগের না থাকা রহস্যজনক।
সংলাপে উঠে আসে বাংলাদেশের রাজনীতি, আগামী নির্বাচন এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, সরকার বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ লালন করছে বিরোধীদের দমনের জন্য। গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে পড়ছে।
বিএনপির নেতারা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশাসন ও পুলিশসহ সব ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করছেন। নির্বাচনকালীন সরকারের নেতৃত্ব তাঁর হাতে থাকলে তখনো তিনি প্রভাব বিস্তার করবেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশের গুম-খুন নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ২০১৩ সাল থেকে শত শত মানুষকে অবৈধভাবে আটক করেছে এবং গোপন স্থানে আটকে রেখেছে। যাদের মধ্যে কয়েকজন বিরোধী নেতাও রয়েছেন। সেই প্রতিবেদনে অন্তত ৯০ জনের তথ্য প্রমান হাজির করা হয়, যাদেরকে কেবল ২০১৬ সালে গুম করা হয়েছে। তারও কিছুদিন আগে সুইডিশ রেডিওর এক প্রতিদনে বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাব এর গুম খুনের নৃশংস চিত্র ফুটে উঠে।
অনেকের ধারণা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির এমন ভয়ংকর চিত্র সম্পর্কে এবং বিএনপি ও জামায়াতের অভিযোগসমূহেরও সঠিক জবাব দেয়াটা ছিলো আওয়ামী লীগে নেতাদের পক্ষে কঠিন। কারন এসব অভিযোগে তাদের সংশ্লিষ্টতা অনেকটা ওপেন সিক্রেট ব্যপার হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন।
গত মে মাসে বাংলাদেশ বিষয়ে একটি রিপোর্ট পেশ করার জন্য বাংলাদেশে আসতে চাইলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তাদের বাংলাদেশ সরকার ভিসা দিতে রাজি হয়নি। রিপোর্টের প্রতিপাদ্য বিষয়গুলো সরকারের জন্য খুব একটা স্বস্তিদায়ক হবে না, এটা আঁচ করেই বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে ভিসা দেয়নি। এরপর বাধ্য হয়ে রিপোর্ট লঞ্চের জন্য তারা দিল্লিকে বেছে নেয়।
এভাবেই একের পর এক দেশি বিদেশি জবাবদিহিতার যায়গা গুলোতে পাশ কাটিয়ে চলেছে বাংলাদেশ সরকার। তারই ধারাবাহিকতায় গত মঙ্গলবার আওয়ামী লীগ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বাংলাদেশ বিষয়ক সংলাপ বর্জন করেছে বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা। তাদের মতে দেশের মানুষের মুক্তমত প্রকাশের স্বাধীনতার কণ্ঠরোধ করে এবং বিদেশিদের কাছে জবাবদিহিতা থেকে পালিয়ে বেড়ানো সরকারের অপরাধী মনোভাবেরই বহি:প্রকাশ। জবাবদিহিতাকে নির্বাসনে পাঠানো কোনো সরকার, জনগন কিংবা দেশের জন্যই শুভ লক্ষণ নয়।
Discussion about this post