অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
কথিত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মুফাস্সির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে আপিল বিভাগের দেয়া আমৃত্যু কারাদণ্ড রায়ের ওপর রিভিউ শুনানি চলছে। আজ রোববার সাঈদীর পক্ষে শুনানি করেছেন খন্দকার মাহবুব হোসেন। আগামীকাল সোমবার রাষ্ট্রপক্ষের শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। এনিয়ে এখন জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যেও টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। সরকার যদি আবারো সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড ফিরিয়ে আনে তাহলে পরিস্থিতি ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির রূপ নিতে পারে বলে মনে করছেন রাজনীতিক বিশ্লেষকরা।
কারণ, ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এবং ২ এ যে কয়টি মামলা হয়েছে এখন পর্যন্ত তার মধ্যে নানা কারণে আলোচিত এবং ঘটনাবহুল মামলা ছিল মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলা। এই মামলার শুরুতেই প্রশ্ন ওঠে ট্রাইব্যুনালের পদত্যাগী চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের নিরপেক্ষতা নিয়ে। এরপর সর্বশেষ স্কাইপ কেলেঙ্কারি এবং ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে মাওলানা সাঈদীর পক্ষের একজন হিন্দু সাক্ষী অপহরণের ঘটনা, রাষ্ট্রপক্ষের হিন্দু সাক্ষী গণেশ চন্দ্র মাওলানা সাঈদীর পক্ষে এসে স্বাক্ষ্য দেয়ার ঘটনা দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। বিদেশি গণমাধ্যমেও স্থান পায় স্কাইপ কেলেঙ্কারি এবং সাক্ষী অপহরণের ঘটনা।
স্কাইপ কেলেঙ্কারির কারণে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে হয় ট্রাইব্যুনাল চেয়ারাম্যান বিচারপতি নিজামুল হককে। মাওলানা সাঈদীর মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিচারপতি নিজামুল হক থাকলেও তিনি এ মামলার রায় ঘোষণা করে যেতে পারেন নি। স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন এবং ট্রাইব্যুনালে নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় এ টি এম ফজলে কবিরকে। নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগের কারণে মাওলানা সাঈদীর বিচার কার্যক্রম শেষ হওয়ার পরও নতুন করে শুরু করতে হয় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন। এ ছাড়া বিচার চলাকালে ট্রাইব্যুনালের আরেক সদস্য বিচারক জহির আহমেদ পদতাগ করেন। তাকে সরকারের চাপে পদত্যাগ করতে হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিচারক জহির আহমেদ পদত্যাগের পর নতুন নিয়োগ পান জাহাঙ্গীর হোসেন। এসব কারণে ট্রাইব্যুনালে প্রথম মামলা হওয়া সত্ত্বেও মাওলানা সাঈদীর মামলার রায় ঘোষণার পূর্বে ট্রাইব্যুনাল-২ এ অন্য দু’টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে।
এ ছাড়া আসামিপক্ষ কর্তৃক সেফ হাউজের ডকুমেন্ট উদ্ধারের ঘটনাও এ মামলার একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ছিল। ১৫ জন সাক্ষীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির না করে তাদের জবানবন্দী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার ঘটনাও বেশ সমালোচনার জন্ম দেয়।
এসব কারণে সরকারের ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিল জামায়াত-শিবিরসহ সাঈদীভক্ত সাধারণ মানুষ। কথিত বিচারের নামে সরকার মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছে বলে অভিযোগ ছিল সবার। তাই ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পরই সারাদেশে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। মাঠে নেমে আসে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ। ওই সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল দুই শতাধিকেরও বেশি মানুষ।
এখন আবারও রাষ্ট্রপক্ষ মাওলানা সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড চেয়ে আবেদন করায় জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীসহ সাঈদী ভক্তদের মধ্যে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। আপিল বিভাগের রিভিউ পরবর্তী রায়কে কেন্দ্র করে রাজনীতির মাঠ আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছে রাজনীতিক বিশ্লেষকসহ সাধারণ মানুষ। সাঈদীর বিরুদ্ধে যদি মৃত্যুদণ্ডের রায় আসে তাহলে এর বিরুদ্ধে বড় ধরণের আন্দোলনে যেতে পারে বলে জামায়াত-শিবিরের একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এবার তাদের চুড়ান্ত টার্গেট হবে হয়তো সাঈদীর জীবন রক্ষা নয়তো সরকারের পতন।
কারণ, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী একদিকে হলেন দলটির শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা অন্যদিকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন ইসলামী চিন্তাবিদ। শীর্ষ নেতা হওয়ার কারণে যেমন দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে তার অনেক গুরুত্ব অপরদিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একজন ওয়াজেনে কেরাম হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যেও রয়েছে তার বিশাল গ্রহণযোগ্যতা।
জামায়াত সূত্রে জানা গেছে, আব্দুল কাদের মোল্লার রায় কার্যকরের পর দেশব্যাপী হরতাল-অবরোধসহ বড় ধরণের আন্দোলনের পর কামারুজ্জামান, আলী আহসান মোহম্মদ মুজাহিদ ও মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকরের পর হরতালের মধ্যে তাদের প্রতিক্রিয়া সীমাবদ্ধ ছিল। তবে সাঈদী ইস্যুতে তারা আবারও বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানোর চিন্তা-ভাবনা করছে। আর সাঈদীর রায় কেন্দ্রিক আন্দোলনে তারা কিছু ইতিবাচক দিকও দেখছেন।
জামায়াত নেতারা মনে করছেন, রাজনীতির মাঠে আওয়মী লীগ-জামায়াতের মধ্যে দ্বন্দ্ব, মত পার্থক্য বা রেষারেষি থাকলেও মাওলানা সাঈদীর প্রতি আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীর ইতিবাচক ধারণা রয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগের মধ্যেই একটি অংশ সাঈদীর ফাঁসি হোক এটা তারা চায় না। সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে দেশে গৃহযুদ্ধ বেধে যাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। আর এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে আওয়ামী লীগ তাদের নিজ দলেরই একটি অংশকে আন্দোলনে মাঠে পাবে না বলেও তাদের ধারণা।
এরপর সু-দ্বীর্ঘ ৪০ বছর যাবত দেশের আনাচে-কানাচে কুরআনের তাফসীর করে এক বিশাল গ্রহনযোগ্যতা অর্জন করেছেন মাওলানা সাঈদী। তার প্রতি দলমত নির্বিশেষে সাধারণ জনগণেরও রয়েছে অকুণ্ঠ ভালবাসা আর সমর্থন। সরকার মাওলানা সাঈদীকে ফাঁসিতে ঝুলাতে পারে এমন প্রচার-প্রচারণাও চালাচ্ছে জামায়াত-শিবির। রিভিউতে যদি পুনরায় সাঈদীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় আসে তাহলে সরকার বিরোধী আন্দোলনে সারাদেশের লাখ লাখ সাঈদী ভক্তদেরকে তারা পাশে পাবে।
তারপর মাওলানা সাঈদী এদেশের আলেম-ওলামাদের কাছেও একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত। জামায়াতের সাতে অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর ছোট খাটো মতপার্থক্য থাকলেও সাঈদীর ফাঁসির বিরুদ্ধে সকলেই একমত। ২০০০ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার শাইখুল হাদীস আজিজুল হককে গ্রেফতারের পর তার মুক্তির জন্য সারাদেশে যে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল এর মধ্যে মাওলানা সাঈদীর ভুমিকাও ছিল অন্যতম। মাওলানা সাঈদীর মত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এমন একজন আলেমকে যদি সরকার ফাঁসি দেয়ার চেষ্টা করে তাহলে সকল ভেদাভেদ ভুলে সর্বস্তরের আলেম ওলামা রাজপথে নেমে আসবে বলে মনে করছে জামায়াত।
Discussion about this post