আমরা আর মামুরার নির্বাচন। সংগত কথাই বলেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। ২০১৪ সালে ১৫৩ জন এমপি বিনাভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের এই সমস্যা ঠিক করতে চেয়েছে। কিন্তু ২০১৮ সালে নির্বাচনে ডেকে নিয়ে বিএনপিকে ধোঁকা দেয় আওয়ামী লীগ। তাই এখন আর আওয়ামী লীগের সুযোগ নেই প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতকে নির্বাচনে নিয়ে আসার।
২০১৮ সালে বিএনপিকে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলে নিয়ে এসে ধোঁকা দেয় আওয়ামী লীগ। বহু কেন্দ্রে রাতেই ব্যলট বক্স পূরণ করে ফেলা হয়। আমি ঢাকা-১৫ আসনের নির্বাচন পর্যবেক্ষন করছিলাম। সেখানে ধানের শীষ মার্কায় নির্বাচন করছিলেন বর্তমান জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান। জামায়াতের এজেন্টকে দায়িত্ব পালন করতে দেয়াই হয় নি, উল্টো অধিকাংশ কেন্দ্র থেকে শফিকুর রহমানের পোলিং এজেন্টকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। কয়েকটি স্থানে শফিকুর রহমানের এজেন্টদের পিটিয়েছে আওয়ামী লীগের কর্মীরা।
মোটামুটি সারাদেশের চিত্র এরকমই ছিল। বিএনপিকে পাতানো নির্বাচনে আনতে পারবে না বিধায় আওয়ামী লীগ এখন শুরু করেছে আমরা আর মামুরার নির্বাচন। এই নির্বাচনের ‘ভাইরাল ইস্যু এখন ডামি প্রার্থী। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রত্যেক আসনে ডামি প্রার্থী দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ২০১৪ সালের মতো কোনো প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে শেখ হাসিনার তরফ থেকে।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে এবং শুরুতে আমি বলেছি ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ জন নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবার ২০২৩ সালে এসে আমরা শেখ হাসিনার তরফ থেকে জানতে পারলাম বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়া একটা অপরাধ এবং তা দলীয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ!
অথচ ডামি প্রার্থী দেয়াই অপরাধ হওয়ার কথা। ডামি অর্থ কৃত্রিম, সাক্ষিগোপাল, মূর্তি, কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর নকল যা আসল ব্যক্তি বা বস্তুর উপস্থিতির উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে, সাক্ষিগোপাল, সাজানো, পুতুল ইত্যাদি। এই যে পুতুল পুতুল খেলা; ভোটারের সঙ্গে ছলনা! তা কি শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়? দেশের কোনো আইনে হয়তো সেটি সরাসরি অপরাধের শ্রেণিভুক্ত নয়। কিন্তু আইনের যে দর্শন, যে মর্মবাণী সেই দর্শন অনুসারে ভোটারের সঙ্গে প্রতারণা এবং জনগণকে বিভ্রান্ত করা অবশ্যই একটি অপরাধ।
দেশের এই সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ডামি প্রার্থী দেয়ার নির্দেশনাই বলে দেয় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনও কেমন হবে? ইতিমধ্যে মানবাধিকার এবং অধিকার কর্মীরা এই নির্বাচনকে ‘নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন বলে অভিহিত করেছেন। অর্থনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মী, রাজনীতি বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, এটি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের ভয়াবহ রূপ।
ডামি প্রার্থী দেওয়ার নির্দেশনা ও একইসাথে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার কথিত অপরাধ থেকে বাঁচতে নতুন খেলা শুরু হয়েছে। কেউ তার স্ত্রীকে সতন্ত্র প্রার্থী বানিয়ে নিজের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। কেউ নিজের কাজের বুয়াকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। কেউ তার ছেলেকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। হাসিনা ভেবেছে এর মাধ্যমে বিশ্ববাসী দেখবে বিএনপি নির্বাচনে না আসলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হচ্ছে।
শেখ হাসিনার এই ষড়যন্ত্রের সাথে সরাসরি যুক্ত রয়েছে নির্বাচন কমিশন। এই বছর নির্বাচন কমিশনে অনেকগুলো দল নিবন্ধনের আবেদন করে। এর মধ্যে সব শর্ত পূরণ করে নিবন্ধনের জন্য সবচেয়ে উপযোগী দল ছিল বাংলাদেশ ডেভলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি), এবি পার্টি (আমার বাংলাদেশ পার্টি), গণ অধিকার পরিষদ, বাংলাদেশ লেবার পার্টি।
কিন্তু তাদের বাদ দিয়ে ভুঁইফোঁড় ৫ টি দলকে নিবন্ধন দেয় নির্বাচন কমিশন। তারা হলো তৃণমূল বিএনপি, ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জাসদ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম ও বাংলাদেশ সুপ্রীম পার্টি (বি.এস.পি)। এর মধ্যে তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম মূলত সরকারের গঠিত দল। বিএনপির দলছুটদের বিভিন্ন প্রলোভন ও ভয় দেখিয়ে এই দল তৈরি করা হয়।
বিএনএম ৩০০ আসনে নির্বাচন দিবে বলে জানালেও দিতে পেরেছে মাত্র ৮২ আসনে। এই ৮২ জন প্রার্থীর মধ্যে অর্ধেকেই হলো আওয়ামী লীগের ছোট খাটো নেতা। যারা রাতারাতি আওয়ামী লীগ থেকে বিএনএমের নেতা হয়ে গিয়েছে। বিএনএম থেকে প্রার্থী হওয়া অনেককে সাংবাদিকরা বিএনএমের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তারা উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়। এমনকি তারা বিএনএম-এর চেয়ারম্যানের নাম এবং পার্টি অফিস কোথায় তাও জানাতে ব্যর্থ হয়।
একদিকে নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে বিএনএমের মতো ‘কিংস পার্টি’ তৈরি করা হয়েছে। অন্যদিকে বিশেষ খুনী বাহিনী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে মামলা, হামলা এবং গণগ্রেপ্তার করে প্রধান বিরোধী দলগুলো মাঠ ছাড়া করা হয়েছে। নিম্ন আদালতকে ব্যবহার করে দণ্ড দিয়ে বিএনপি’র নেতাদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। পরিস্থিতি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, বিএনপি চাইলেও নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।
এই পুতুল খেলা টাইপ পাতানো নির্বাচনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রধান প্রতিপক্ষকে মাঠ ছাড়া করা এবং তারা যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে তা নিশ্চিত করা। অন্যদিকে ডামি প্রতিদ্বন্দ্বি দাঁড় করিয়ে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখানো। যতদিন যাচ্ছে ততই শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী রূপ আরো প্রকট হয়ে ধরা দিচ্ছে।
- লেখক ও প্রাবন্ধিক
Discussion about this post