২০১৩ সালের কথা। শাপলা চত্ত্বরে ৫-৬ মে হেফাজতের সমাবেশে গণহত্যা চালায় বাংলাদেশ পুলিশ। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ এই গণহত্যায় নিহত মানুষদের তালিকা প্রকাশ করে এবং নিহত মানুষের সংখ্যা জানায় ৬১।
ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকার এতে খুবই রাগান্বিত হয়। সরকার অধিকারের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের (আইসিটি) ৫৭ ধারার মামলা করে। প্রায় ১০ বছর পর ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে আদিলুর ও নাসিরকে দুই বছর করে কারাদণ্ড দেন ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে তাঁদের ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও ১ মাস করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এই জেল-জরিমানার রায়ের বিরুদ্ধে গত ২৫ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে আপিল করে জামিন চান আদিলুর ও নাসির। বিষয়টি শুনানির জন্য হাইকোর্টের বিচারপতি মো. ইমদাদুল হক আজাদের একক বেঞ্চে ওঠে। আদালতে আদিলুর ও নাসিরের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী, রুহুল আমিন ভূঁইয়া ও মো. আহসানুজ্জামান ফাহিম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল রেজাউল করিম।
ক্রম অনুসারে বিষয়টি উঠলে আদালতকক্ষে থাকা ডায়াসের সামনে গিয়ে দাঁড়ান জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী। তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল রেজাউল করিম বলেন, ‘আমাদেরও বক্তব্য আছে।’ তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে আদালত বলেন, ‘তাঁদের (আপিলকারীদের) আইনজীবীদের আগে বলতে দিন। আপনি আগেই লাফ দিয়ে উঠছেন কেন?…দেশটাকে তো জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছেন।’
পরে আদালত আদিলুর ও নাসিরের আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে তাঁদের জরিমানা স্থগিত ও জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেন। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন, হাইকোর্টের এই আদেশের ফলে আপাতত আদিলুর ও নাসিরের কারামুক্তিতে আইনগত বাধা নেই। ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান নিয়ে অসত্য-বিকৃত তথ্য প্রচারের অভিযোগ এনে আদিলুর ও নাসিরের বিরুদ্ধে মামলাটি হয়েছিল।
আদালতের এমন বক্তব্য বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। এর বিরুদ্ধে কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ এএম আমিন উদ্দিন। ‘দেশটাকে জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছেন’ হাইকোর্টের বিচারপতির এমন মন্তব্য অসাংবিধানিক ও অসৌজন্যমূলক বলে উল্লেখ করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতি হিসেবে তিনি (ইমদাদুল হক আজাদ) শপথ করেছেন, সংবিধান ও আইন সংরক্ষণ করবেন এবং রাগ অনুরাগের বশবর্তী না হয়ে সবার প্রতি সমান আচরণ করবেন। এই অঙ্গীকার থেকে কখনো বিচ্যুত হবেন না। কিন্ত বিচারপতি ইমদাদুল হক আজাদ মামলার শুনানিতে দেশকে জাহান্নামের সঙ্গে তুলনা করে শপথ ভঙ্গ করেছেন। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। রাষ্ট্রের একজন প্রধান আইন কর্মকর্তা হিসেবে বিষয়টি আমি প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে অবহিত করেছি।
অ্যাটর্নি জেনারেল আরো বলেন, দেশের বিচার বিভাগ নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বিভিন্নভাবে বিভিন্ন শ্রেণী-গোষ্ঠী বিচার বিভাগের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে যেসব কথা বলছে, আমি জানি না, উনি উনার (বিচারপতি) কথার মাধ্যমে তাদের লাভবান করতে বলেছেন কিনা, তা খতিয়ে দেখতে হবে।
হাইকোর্টের বিচারপতির বিরুদ্ধে অ্যাটর্নি জেনারেলের দম্ভোক্তি ও বিষোধগারের পর হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. ইমদাদুল হক আজাদকে ডেকে কথা বলেছেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। এ সময় আপিল বিভাগের বিচারপতিরা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে বিচারপতি ইমদাদুল হক আজাদকে কথাবার্তার ক্ষেত্রে যত্নশীল হতে বলেন প্রধান বিচারপতি।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে অ্যাটর্নি জেনারেলের নির্দেশেই প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বিচারপতি ইমদাদুল হক আজাদকে ডেকে সতর্ক করেন। অথচ অ্যাটর্নি জেনারেল যা করেছেন তা আদালত অবমাননার শামিল। বিচারপতি যদি বিচার করে কথাই না বলতে পারেন তবে তিনি কী বিচার করবেন! বিচারক যদি ইচ্ছেমত কথাই না বলতে পারেন তবে বিচারবিভাগের স্বাধীনতা থাকলো কই?
এর আগে কিছু কিছু বিচারপতি সরাসরি রাজনৈতিক প্রোগ্রামেও অংশগ্রহণ করেছেন তখন তাদের সতর্ক করার কেউ ছিল না। বিচারপতি মানেই আওয়ামী লীগের পক্ষে থাকতে হবে? আওয়ামী লীগের সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলতে হবে? প্রধান বিচারপতি কি অ্যাটর্নি জেনারেলের নির্দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করবেন?
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
Discussion about this post