বাংলাদেশে থেমে নেই গুম-খুনের ঘটনা। কক্সবাজারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ওসি প্রদীপ কর্তৃক মেজর সিনহাকে খুন করার ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয় সেনাবাহিনী। এর ফলে বিচারের আওতায় আসে ওসি প্রদীপ। প্রতাপশালী ওসি প্রদীপের ঘটনার পর ক্রসফায়ারের নামে নির্বিচারে খুন বেশ কিছু মাস বন্ধ ছিল। একইসাথে গুমও বন্ধ ছিল। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই তারা আবার পুরনো ফর্মে ফিরে আসে।
করোনা মহামারিকালে রাষ্ট্রের নানা সঙ্কটের মধ্যেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া ক্রসফায়ার বা কথিত বন্দুকযুদ্ধসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বছরের বিভিন্ন সময়ে। এ সময় করোনা মহামারির কারণে রাষ্ট্রের নানা সঙ্কটের মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও গুমের মতো ঘটনাও ঘটেছে।
জাতিসংঘের গুমবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছে বাংলাদেশে গুমের অভিযোগ বেড়েছে। কমিটির সর্ব সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের ২২ মে থেকে এ বছরের ১৩ মে পর্যন্ত এক বছরে কমিটির কাছে আসা বাংলাদেশে গুমের অভিযোগের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৮, যা আগে ছিল ৭৬।
জাতিসংঘের ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স’ নামে পরিচিতি গুমবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটি গত শুক্রবার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আগামী মঙ্গলবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় মানবাধিকার পরিষদে প্রতিবেদনটি পেশ করা হবে। এর আগে আগামীকাল সোমবার কমিটির ১২৮তম সভা শুরু হবে। সভায় ২১টি দেশের ৬৯৬টি গুমের অভিযোগ পর্যালোচনা করা হবে। এসব অভিযোগের মধ্যে অন্তত চারটির বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে প্রতিবেদনের বিবেচ্য সময়ে কমিটি যোগাযোগ করেছিল বলে দেখা যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে কমিটি বিভিন্ন দেশের গুমের অভিযোগ, নিষ্পত্তি হওয়া ও অনিষ্পন্ন অভিযোগের যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশ নির্ধারিত ছয় মাসের মধ্যে আটজনের বিষয়ে কমিটিকে তথ্য দিয়েছে। বাংলাদেশে যে ৮৮ জনের গুমের অভিযোগ কমিটি পেয়েছে, তাদের মধ্যে ২ জন ছিলেন নারী। এখন অনিষ্পন্ন হিসেবে যে ৮১ জনকে পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, তার মধ্যেও ১ জন নারী রয়েছেন। ওই হিসাবে দেখা যায়, তিনজন এখন মুক্ত এবং চারজন আটক আছেন।
গত বছরের ২২ মে থেকে এ বছরের ১৩ মে পর্যন্ত এক বছরে কমিটির কাছে আসা বাংলাদেশে গুমের অভিযোগের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৮, যা আগে ছিল ৭৬। প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিবেচ্য সময়ে কমিটি তিনবার সভায় মিলিত হয়েছে। এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সভায় (১২৬তম) বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছিল।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার, মানবাধিকারকর্মী ও নাগরিক সংগঠনগুলোকে যেকোনো হুমকি থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বের বিষয়েও জোর দিয়েছে কমিটি। কমিটির এ প্রতিবেদনে গুম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের নিবন্ধন নবায়ন না করার সরকারি সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে গুমবিষয়ক সনদের ১৩ নম্বর ঘোষণাটির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হয়, অভিযোগকারী, তার আইনজীবী, সাক্ষী এবং অভিযোগের তদন্তে জড়িত সবাইকে সব ধরনের প্রতিশোধ, হুমকি ও হয়রানি থেকে অবশ্যই সুরক্ষা দিতে হবে।
গত মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সাবেক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেত তার দায়িত্ব ছাড়ার আগে শেষ সফরে ঢাকায় গিয়ে গুম ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো তদন্তে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। কমিশনের পক্ষ থেকে সহায়তা দেওয়ারও প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে গুমের অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে কোনো স্বাধীন তদন্তের ব্যবস্থা করার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করা হয়। এরপর ১২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ৫১তম অধিবেশনে ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার নাদা আল নাশিফ তার বক্তব্যে একই আহ্বান জানান। তবে সরকার নাদা আল নাশিফের আহ্বানের কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
এদিকে পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হারিয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন স্বজনরা। প্রিয়জনের খোঁজ করতে গিয়ে হয়রানি, ভয়ভীতিসহ নানা অমানবিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন। মানবাধিকারকর্মী ও অপরাধ বিশ্নেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে গুম-নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা অনেকটা কমে এসেছে। তবে আগের ঘটনাগুলোর তদন্ত করে রহস্য উন্মোচন না হওয়ায় আইনের শাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
আইনজ্ঞরা বলেন, ‘যে কোনো দেশের নাগরিকের জীবন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের প্রধানতম দায়িত্ব। এ ধরনের ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বলছে, আমরা কিছু জানি না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিখোঁজ হওয়ার অনেকদিন পরে তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। রাষ্ট্রের এ আচরণ সংবিধান পরিপন্থি। বাংলাদেশ যেসব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে স্বাক্ষর করেছে সেগুলোর পরিপন্থি। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বিশেষত হিউম্যান রাইট ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) কয়েক বছর ধরে এসব বিষয়ে আমাদের রাষ্ট্রকে ভর্ৎসনা করছে। আমরা যতই আমাদের ভাবমূর্তি নিয়ে গর্ববোধ করি, এ গুমের ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা ও ভাবমূর্তিকে বিপদগ্রস্ত করছে।’
অপহরণ, গুম, গুপ্তহত্যা, বিচারবহির্ভূত খুন ও হেফাজতে নির্যাতন ও ন্যায়বিচারের সুযোগহীনতার মতো বিষয়গুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের নৃশংসতা ও চরম অপরাধগুলোর অন্যতম। বিশ্লেষকরা বলছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন বিচ্ছিন্নভাবে সংঘটিত হয় না, বরং পরস্পর সম্পৃক্ত; একটি অপরটিকে প্রভাবিত করে এবং চূড়ান্তভাবে আইনের শাসনকে বিপন্ন করে তোলে।
ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করার জন্য গুমকে একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মানুষ আগে যেমন হোটেল, রেস্টুরেন্টে, বাসে, ট্রেনে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতো, তাদের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিলো রাজনৈতিক পরিমণ্ডল নিয়ে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা এমন কোনো আলোচনা হতে দেখি না। তার একটা বড় কারণ হচ্ছে গুমের মত ঘটনা এমন একটা অবস্থায় মানুষকে নিয়ে গিয়েছে মানুষ আর এখন নিজেকে নিরাপদ ভাবছে না।
Discussion about this post