অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
সম্প্রতি পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করেছে ছাত্রদল। কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ ও সাইফ মাহমুদ জুয়েল এর নেতৃত্বে এই কমিটিতে স্থান পেয়েছে ৩০২ জন। এছাড়া ছাত্রদলের নতুন এ কমিটিতে ২২ জনকে সহসভাপতি এবং ১৪৫ জনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ৩৮ জনকে সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক রাখা হয়েছে।
সাংগঠনিক গতি বাড়াতে চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে সভাপতি, সাইফ মাহমুদ জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদলের পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর গত রোববার (১১ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এ কমিটি ঘোষণার পর চলছে তুমুল সমালোচনা। নতুন পদধারীরে কেউ আপত্তি তুলেছেন কেউ আবার প্রকাশ্যে ঘোষনাও দিয়েছেন তিনি ছাত্রদলের কেউ নন। এছাড়া অভিযোগ রয়েছে ঘোষিত কমিটিতে ২০০৩ সালের আগে এসএসসি পাশ করা নেতারাও রয়েছেন। এছাড়া বিবাহিত, অছাত্র রয়েছেন। তারা ২৯ জনের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ দেন। এমন বাস্তবতায় কমিটি অনুমদনের সপ্তাহ না গড়াতেই ৩২ নেতার পদ সাময়িক স্থগিত করে ছাত্রদল। এখন প্রশ্ন উঠেছে যে সাংগঠনিক গতি বাড়াতে এই উদ্যোগ সেই গতি কি ফিরবে ছাত্রদলে? নাকি নির্বাচনের আগে উল্টো দিক হারাবে বিএনপির সহযোগী সংগঠন এই দলটি?
অছাত্র ও অযোগ্য নেতৃত্বে কমিটি
পদ বঞ্চিতদের অভিযোগ আমলে নিয়েই এই পদক্ষেপ বলে দাবি করছে সংগঠনটির সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ। কিন্তু পদধারী নেতারা এই অভিযোগ মানতে না রাজ। তারা বলছেন, অভিযোগ না তুললেও তার পদ স্থগিত রাখা হয়েছে। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারলে দল থেকে পদত্যাগ করবেন বলেও জানিয়েছেন তারা।
পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশিত পদ না পাওয়া নেতাদের অভিযোগ, অযোগ্য, নিষ্ক্রিয়, বিবাহিতসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির পক্ষে দলীয় কোনো কর্মসূচি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই এই কমিটি ভেঙে দিয়ে যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের সমন্বয়ে নতুন কমিটি করা উচিত।
নতুন কমিটিতে যুগ্ম সম্পাদক পদ পেয়েছেন সালেহ মো. আদনান। তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ না তুললেও তার পদও স্থগিত রাখা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ছাত্রদল নেতা জানান, আদনান রাগে, দুঃখে আর অভিমানে মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছেন। আদনানের সাফাই গেয়ে ওই ছাত্রদল নেতা বলেন, আদনানের মতো পরিশ্রমী, ত্যাগী আর যোগ্য নেতার বিরুদ্ধে অহেতুক ষড়যন্ত্র চলছে। এটা শুধু তার জন্য নয়, পুরো সংগঠনের জন্য খুব বিব্রতকর অবস্থা।
নতুন কমিটিতে আরও এক পদধারী আজিজুল হক জিয়ন জানান, তার বিরুদ্ধে বিবাহের অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু কেউ যদি এরকম প্রমাণ দিতে পারেন তাহলে রাজনীতিই ছেড়ে দিবেন এবং যে কোনো শাস্তি মেনে নিবেন।
অন্যদিকে পদবঞ্চিতরা বলছেন, তারা কারো পদ স্থগিত কিংবা বহিস্কারের জন্য আবেদন জানাননি। তারা চেয়েছেন- কমিটিতে যেহেতু এসব নেতারা আসতে পেরেছেন সেহেতু তাদেরকেও যেনো কেন্দ্রীয় কমিটিতে মূল্যায়ন করা হয়।
ঢাবির নতুন কমিটি নিয়েও তীব্র অসন্তোষ
ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নতুন কমিটি নিয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশিত পদ না পাওয়া নেতারা।
কমিটিতে পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশিত পদ না পাওয়া কয়েকজন নেতা জানান, সভাপতি খোরশেদ ২০০৮-০৯ ও সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ছিলেন। এখন তাঁরা নিয়মিত ছাত্র নন। খোরশেদকে ২০১৬ সালের আগে কখনো ছাত্রদলের কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। আরিফুল ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। তিনি ছাত্রদলে অনেকটা অপরিচিত মুখ। তাঁর যোগ্যতা হলো, তিনি কেন্দ্রীয় এক শীর্ষ নেতার নিজস্ব লোক। এ ছাড়া কমিটিতে যুগ্ম সম্পাদক পদ পাওয়া মাসুম বিল্লাহ (স্যার এ এফ রহমান হল), তারিকুল ইসলাম, নাছির উদ্দিন ও রাজু আহমেদ অতীতে ছাত্রলীগ করতেন। মাসুম ২০১৩ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের হয়ে মারামারিসহ নানা বিতর্কিত ঘটনায় যুক্ত ছিলেন, যা তখন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
ছাত্রদলের এই নেতারা অভিযোগ করেন, নতুন কমিটির সহসভাপতি মশিউর রহমান, যুগ্ম সম্পাদক ইউসুফ হোসেন খান, সহসাংগঠনিক সম্পাদক মাসুদুর রহমান ও সহসাধারণ সম্পাদক আফছার উদ্দিন দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় ছিলেন। মশিউর বিবাহিত। যুগ্ম সম্পাদক আমিনুল ইসলামও বিবাহিত। সহসাধারণ সম্পাদক মুন্সী সোহাগকে অতীতে ছাত্রদলের কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। তবে চলতি বছর তিনি পরপর দুটি পদ পেয়েছেন।
ছাত্রদলের এই নেতারা অভিযোগ করেন, নতুন কমিটির সহসভাপতি মশিউর রহমান, যুগ্ম সম্পাদক ইউসুফ হোসেন খান, সহসাংগঠনিক সম্পাদক মাসুদুর রহমান ও সহসাধারণ সম্পাদক আফছার উদ্দিন দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় ছিলেন। মশিউর বিবাহিত। যুগ্ম সম্পাদক আমিনুল ইসলামও বিবাহিত। সহসাধারণ সম্পাদক মুন্সী সোহাগকে অতীতে ছাত্রদলের কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। তবে চলতি বছর তিনি পরপর দুটি পদ পেয়েছেন।
যুগ্ম সম্পাদক মাসুম বিল্লাহ দাবি করেন, ২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ওই বছরের ডিসেম্বরে ছাত্রদলের কর্মসূচি থেকে গ্রেপ্তার হন। পরের বছর ২৫ ডিসেম্বর তিনি জামিনে মুক্ত হন। তিনি বলেন, মাত্র দেড় মাস স্যার এ এফ রহমান হলে ছিলেন। শুরু থেকেই ছাত্রদলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। আরেক যুগ্ম সম্পাদক তারিকুল ইসলামও দাবি করেন, তিনি কখনো ছাত্রলীগ করেননি। আর যুগ্ম সম্পাদক আমিনুল ইসলামের দাবি, তিনি বিবাহিত নন।
রাজনৈতিক গ্রুপিং
ক্ষুব্ধ নেতারা জানান, শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলে অন্তত ছয়টি পক্ষ রয়েছে। সাধারণত কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ইচ্ছায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কমিটি হয় না। পক্ষগুলোর শীর্ষ নেতাদের মধ্যে সমন্বয় করেই কমিটি করা হয়। কিন্তু এবার প্রথমবারের মতো সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের ইচ্ছানুযায়ী কমিটি গঠন করা হয়েছে। ছাত্রদলের সাংগঠনিক অভিভাবক ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শিগগিরই এই কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটি গঠন করবেন বলে আশা তাদের। প্রয়োজনে তাঁরা আন্দোলনে নামার কথাও ভাবছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটি নিয়ে ওঠা অভিযোগকে ‘রাজনৈতিক গ্রুপিংয়ের বক্তব্য’ বলছেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ঢাবি শাখার সভাপতি খোরশেদ ডাকসুর এজিএস প্রার্থী ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। সাধারণ সম্পাদক আরিফুলও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। সাংগঠনিক কিছু বাধ্যবাধকতা ও মানদণ্ডের কারণে অনেকের মধ্য থেকে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কমিটিতে থাকা কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
অনিয়মই যেন ছাত্রদলের নীতি
২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর গোপন ভোটে ফজলুর রহমান খোকন সভাপতি ও ইকবাল হোসেন শ্যামল ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালের ২২ ডিসেম্বর ৬০ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করেন তারা। এর পর আড়াই বছরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে ব্যর্থ হন সাবেক কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।
এ ছাড়াও হঠাৎ করে কমিটি ভেঙে পাঁচ সদস্যের নতুন কমিটি করার নেপথ্যে আরো কিছু কারণ আছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক। তারা জানান, ভোটে নির্বাচিত হলেও সাবেক কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সাংগঠনিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।
সাংগঠনিক ব্যর্থতা ছাড়াও সারা দেশের জেলা শাখাসহ ইউনিট কমিটি গঠনে তাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়েছেন দলের হাইকমান্ড। সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ ছিল, সাবেক সাধারণ সম্পাদক শ্যামলের বিরুদ্ধে। কথিত তৃতীয় শক্তির সঙ্গে উত্তরায় কয়েকটি বৈঠকে অংশ নেওয়ার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় তার বিরুদ্ধে। আগের সভাপতি ফজলুর রহমান খোকনের বিরুদ্ধে কমিটি গঠনে কিছু অনিয়মের অভিযোগ ছিলো। কিন্তু সেই মাত্রাও ছাড়িয়ে যায় সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামল।
ছাত্রদল কি পুনরায় অস্তিত্ব হারানোর ভুল করছে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একটা সময় আন্দোলনে ছাত্রদলকে রাস্তায় দেখা যেত। সেখানে দলের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাদের দেখা যাচ্ছে না। খালেদা জিয়া জেলে ও তারেক জিয়ার সাজার বিষয়েও তাদেরকে তেমন কোন ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। মাঝে মাঝে খালেদা জিয়ার জামিনকে কেন্দ্র করে মুখচোরা স্বভাবে দেখা দিয়েছে তারা। এমনকি একাদশ নির্বাচনেও তাদের ভূমিকা ছিলো নাজেহাল।
তারা বলছেন, দলীয় জোটের আন্দোলন সংগ্রামে থাকায় তারা সক্রিয় ছিলো। জামায়াত-শিবিরকে মাঠে নামিয়ে তারা ফায়দা লুটতো। তবে সম্প্রতি জামায়াত শিবির ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করায় চোখে পড়ছে ছাত্রদলের নিশ্ক্রিয়তা। যদিও বিএনপির নীতিনির্ধারকদরা বলছেন, ছাত্রদল, যুবদলসহ অঙ্গ ও সহযোগী বিএনপির সংগঠনগুলোকে এবার ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করছে দলটি। কাউন্সিলে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে এসব সংগঠনের নতুন নেতৃত্ব নির্ধারণ করবে বিএনপি। এছাড়াও ভোটে অনিয়মের অভিযোগ এনে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে প্রার্থীদের মামলার পাশাপাশি আন্দোলন কর্মসূচি নিয়েও মাঠে থাকবে দলটি।
তবে তেমন কোন সম্ভবনা দেখছেনা রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, ছাত্রদল কিংবা ছাত্রলীগ দুই সংগঠনের নীতি একই। ক্ষমতা থাকলে হয়ে ওঠে সন্ত্রাস আর ক্ষমতাচ্যুত হলেই আর খোঁজ মেলেনা। ছাত্রদলের নিজেদের মধ্যে যে ভাঙন তৈরি হয়েছে এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই আবারও অস্তিত্ব হারাবে দলটি।
Discussion about this post