অনেক আগের কথা! এই দেশে ঠগি নামে একদল ডাকাতের নাম শোনা যেত। যারা দূরবর্তী মুসাফির/ যাত্রীদের মালামাল লুট করতো। তাদের খুন করতো। তাদের ভয়ে মানুষ যাতায়াত করতে ভয় পেত। যাতায়াত ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতির সাথে সাথে এই ঠগিরা ধীরে ধীরে নির্মূল হয়ে গেল।
হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর নতুন করে ঠগিদের উৎপাত শুরু হয়েছে। আইন শৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি এসব ডাকাতদের সৃষ্টি করেছে। গত পরশু কুষ্টিয়া থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী ঈগল পরিবহনের চলন্ত বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নতুন ঠগিরা লুটপাট ও ধর্ষণ করেছে। মঙ্গলবার দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হওয়ার পর ডাকাত দল বাসটির নিয়ন্ত্র্রণ নেয়। এ ঘটনায় বাসের এক যাত্রী বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে টাঙ্গাইলের মধুপুর থানায় মামলা দায়ের করেছেন। ধর্ষণের শিকার নারীকে মধুপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য তাঁকে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
ঈগল পরিবহন বাসটি ভেড়ামারা লালন শাহ সেতু ও বনপাড়া হয়ে রাত সাড়ে ১১টার দিকে সিরাজগঞ্জে একটি হোটেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সেখানে বিরতি শেষে দিবাগত রাত পৌনে ১২টার দিকে ঢাকার পথে চলতে থাকে। রাত ১২টার দিকে মহাসড়কের ওপর একটি জায়গায় চারজন তরুণ বাসের সামনে থেকে হাত তুলে ইশারা দেন। বাসচালকের সহকারী সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে ওই তরুণদের সঙ্গে কথা বলে। দু-এক মিনিটের মধ্যে তরুণেরা বাসে উঠে পড়ে এবং সুপারভাইজারের সঙ্গে কথা বলে বাসের পেছনের দিকে গিয়ে বসে।
এই চার তরুণের প্রত্যেকের মুখে মাস্ক ছিল। তাদের একজনের পিঠে ব্যাগ ছিল। তারা পেছনে বসার পরপরই মোবাইল টেপাটিপি করতে থাকে। বাস আরও ১৫ মিনিটের মতো চলে। এরপর রাস্তা থেকে আরও পাঁচজন একইভাবে বাসে ওঠে। তাঁরাও কয়েকটি সিটে বসে পড়ে। কয়েক মিনিট পর আরেকটু সামনে গিয়ে আরও দুজন ওঠে। এর পরপরই তারা সবাই বাসের চালককে বাস থামাতে বলে। চালক থামাতে রাজি না হলে তাকে মারধর করে ডাকাতের দল। একজন ডাকাত দ্রুত তাকে সরিয়ে চালকের আসনে বসে বাসের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ১০ ডাকাত বাসের প্রতিটি সিটের পাশে পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারা ছুরি ও কাঁচি পুরুষ যাত্রীদের গলায় ধরে রাখেন। তাদের মধ্যে তিন থেকে চারজন দ্রুত বাসের পর্দা কেটে পুরুষ যাত্রীদের মুখ, হাত ও পা বেঁধে ফেলেন। বাসের মাঝখানের লম্বা জায়গায় মাথা নিচু করে তাঁদের বসিয়ে রাখেন। বাস তখন স্বাভাবিক গতিতে চলতে থাকে। বাসের সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। জানালার গ্লাসগুলো আটকে দেওয়া হয়। ডাকাতেরা প্রত্যেকের কাছে গিয়ে শরীর তল্লাশি করে টাকা, মুঠোফোন এবং নারী যাত্রীদের কাছ থেকে স্বর্ণালংকার লুটে নেয়। একাধিকবার যাত্রীদের শরীর তল্লাশি করে।
এক নারীকে তল্লাশি করার সময় ওই নারী প্রতিবাদ করেন। ওই নারী ডাকাত দলকে বলেন, ‘তোরা যে কাজ করছিস, সেটা ঠিক নয়। আমার এলাকা পাবনায় হলে তোদের দেখে নিতাম।’ এ কথা শোনার পর দুই তরুণ ওই নারীকে মারধর করে এবং শারীরিকভাবে নির্যাতন করে ও লাঞ্চিত করে। তার চিৎকারে সবাই ভয় পায়। কিন্তু কারোই কিছু করার ছিল না।
ডাকাতরা বাসটি বিভিন্ন স্থানে ঘুরিয়ে তিন ঘণ্টার মতো নিয়ন্ত্রণে রাখে তারা। ডাকাত দল সব কাজ শেষ করার পর একে অপরকে ডাকাডাকি করে। রাত তিনটার দিকে ডাকাতেরা টাকা, মুঠোফোন ও স্বর্ণালংকার নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি শুরু করে। বাসের ভেতরে ভাগাভাগি নিয়েও তাদের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা হয়। পরে পথ পরিবর্তন করে টাঙ্গাইল–ময়মনসিংহ সড়কের মধুপুর উপজেলার রক্তিপাড়া জামে মসজিদের কাছে রাস্তার পাশে বালুর ঢিবিতে বাসটি কাত করে রেখে ডাকাত দলের সদস্যরা নিরাপদে চলে যায়। এসময় বাসের ভেতর কোনো যাত্রী মাথা উঁচু করলে বা কথা বলার চেষ্টা করলে তাঁদের ব্যাপক মারধর করা হয়েছে।
ভোরের দিকে যখন পুলিশ আসে, তখন ধর্ষিত নারীসহ কয়েকজন যাত্রীকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। ডাকাতদের নির্ভার আচরণ নির্দেশ করে এদেশে সরকার নেই। আইন শৃঙ্খলা নেই। নেই বিচার ব্যবস্থা। আমরা এক বন্য ও অসভ্য যুগে বসবাস করছি। এখানে কারো কোনো নিরাপত্তা নেই। যাদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা তারাই লুটেরা, তারাই ধর্ষক!
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাতে মধুপুরে চলন্ত বাসে এক ছাত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের পর হত্যা করে পঁচিশমাইল এলাকার রাস্তায় ফেলে দেন আসামিরা। মধুপুর থানা–পুলিশ লাশ উদ্ধার করে বেওয়ারিশ হিসেবে টাঙ্গাইল কবরস্থানে দাফন করে। ২৭ আগস্ট নিহত ছাত্রীর বড় ভাই পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে লাশের ছবি দেখে বোনকে শনাক্ত করেন। ৩১ আগস্ট লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ওই দিন রাতেই তাড়াশ উপজেলার আসানবাড়ি গ্রামের কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়।
এরকম আরো ঘটনা ঘটছে। অল্প কিছু ঘটনাই কেবল আমরা জানতে পারি। গত পরশুর ঘটনাও আমরা জানতাম না যদি একজন যাত্রী সাহস করে মামলা না করতেন!
Discussion about this post